নোয়াখালী প্রতিনিধি: বৃহত্তর নোয়াখালীর কিডনি রোগীদের একমাত্র ভরসাস্থল নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিটে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে সাগর চুরির অভিযোগ ওঠেছে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানের পর কর্তৃপক্ষ ইউনিটটি বন্ধ ঘোষণায় রোগী ও স্থানীয় জনসাধারণ উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ থেকে পরীক্ষা-নিরিক্ষার মেশিন-পত্র সংগ্রহ করে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চালু করা হয় আধুুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট। ইউনিটটি চালুর পর নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর থেকে হাজার হাজার কিডনি রোগী চিকিৎসা নিতে আসে এখানে।
সাম্প্রতিক ইউনিটের ল্যাবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ব্যাতিত সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ডায়ালাইসিস, ক্যাথেটার ও ফিস্টুলা করতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডা. মামুন পারভেজের বিরুদ্ধে কিডনি বিশেষজ্ঞের ভুয়া ডিগ্রী ব্যবহার’সহ সাগর চুরির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন একই হাসপাতালের মেডিসিন ও কিডনী রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো: শাহীদুল ইসলাম।
ডা. মো: শাহীদুল ইসলাম তাঁর অভিযোগে বলেন, ৬ মাস পূর্বে তিনি নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে যোগদান করেন। কিডনী বিষয়ে উচ্চতর এম.ডি ডিগ্রী সম্পন্ন করার কারণে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন তাঁকে কিডনী ডায়ালাইসিস ইউনিটে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য আদেশ প্রদান করেন এবং তত্ত্বাবধায়ক তাঁকে জানান, উক্ত ডায়ালাইসিস ইউনিটের কোনো সরকারী অনুমোদন নেই এবং ইউনিটটি দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে। তাঁকে ইউনিটে চলা বিভিন্ন অনিয়ম নিবড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়।
তিনি বলেন, বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ২ মাস দায়িত্ব পালনকালে আমি দেখতে পাই এ যেন রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র! এখানে পুকুর না সাগর চুরি হয়। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিজস্ব ল্যাব থাকলেও সরকারী নিয়মকে তোয়াক্কা না করে কিডনী ডায়ালাইসিস ইউনিটে স্বতন্ত্রভাবে আরেকটি ল্যাব পরিচালনা করা হয়। প্রতিটি পরীক্ষা-নিরিক্ষার জন্য রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় দুই থেকে তিনগুন টাকা। অতিরিক্ত টাকার জন্য ব্যবহার করা হয় একটি গোপনীয় আলাদা খাতা। এভাবে প্রতি মাসে এই ইউনিট থেকে কমপক্ষে ২০ লক্ষ টাকা অবৈধভাবে আয় হয়। যার ভাগ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ সকল ব্যক্তি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছে খাম যোগে পৌঁছে যায়।
ডা. মো: শাহীদুল ইসলাম আরো বলেন, এ সকল অবৈধ কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন ডা: মামুন পারভেজ। ডা: মামুন পারভেজ একজন সরকারি বেতনভুক্ত কর্মচারী হওয়া স্বত্ত্বেও কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট হতে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা করে নিয়ে আসছেন। প্রকৃতপক্ষে এই ইউনিট থেকে মামুন পারভেজ প্রতি মাসে কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা অবৈধভাবে আয় করেন। ইমার্জেন্সী মেডিকেল অফিসার হিসেবে পোস্টিং হলেও দীর্ঘ সময় ধরে সে উক্ত ডায়ালাইসিস ইউনিটে কাজ করে এ সকল অপকর্ম সাধন করে আসছেন।
শুধু তাই নয়, ডা.মামুন পারভেজের কিডনী বিষয়ে কোনো উচ্চতর ডিগ্রী বা কোর্স না থাকলেও ৬০০ টাকা ভিজিটে কিডনী বিশেষজ্ঞ পরিচয়ে বাইরে চেম্বার করেন এবং নিজেকে কিডনী বিভাগের প্রধান হিসেবে রোগীদের নিকট পরিচয় করিয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের প্ররোচিত করেন। ডা: মামুন পারভেজ বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন নাম্বার এ-৮৮৩১৫ তার নামের পাশে বিভিন্ন ভুয়া ডিগ্রী সিসিডি- ন্যাশনালহার্ট ফাউন্ডেশন, পিজিটি- নিউরো মেডিসিন, পিজিটি- মেডিসিন ও এম.ডি- নেফ্রেলজি (সি) লিখে রোগীদের কাছে কিডনী বিশেষজ্ঞ সেজে ভয়ানক প্রতারণা করে আসছে। এ সকল বিষয়ে মৌখিকভাবে তত্ত্বাবধায়ককে অবহিত করলে তিনি ব্যবস্থা নিবেন বলে জানালেও পরবর্তীতে অসৎ সিন্ডিকেটের চাপে মৌখিক আদেশে আমাকে ডায়ালাইসিস ইউনিট হতে অন্যত্র সরিয়ে দেয়। তার একমাত্র কারণ, আমি এই ইউনিটের সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখখুলি।
তিনি আরো বলেন, একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা ডায়ালাইসিস, ক্যাথেটার ও ফিস্টুলা করার কথা থাকলেও এখানে তা করা হয় টেকনিশিয়ান ইসমাইল দ্বারা। সরকারিভাবে নির্ধারিত ফিস ৫০০ টাকা হলেও, ডায়ালাইসিস ইউনিটে ক্যাথেটার করতে ২৫০০ টাকা এবং ফিস্টুলা করতে ৬০০০ টাকা নেওয়া হয়। এই বিপুল পরিমাণ টাকা ডা: মামুন পারভেজগংরা আত্মসাৎ করেন।
রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, বেসরকারি হসপিটালে কিডনি রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট চালুর পর রোগীরা স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই ইউনিটে সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, টেকনেশিয়ান দ্বারা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা প্রদান, ভুয়া ডিগ্রি পরিচয় দিয়ে ডা. মামুন পারভেজের রোগী দেখাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হচ্ছে। যা কখনোই কাম্য ছিল না। কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিটে দুদকের অভিযানের পর ইউনিটটি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন স্থানীয় বাসিন্দা, রোগী ও তাদের স্বজনরা।
স্থানীয় সুশীল সমাজের লোকজন বলছে, এখানে অনিয়ম-দুর্নীতি দীর্ঘদিনের। সিন্ডিকেট, অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করে গরীব-অসহায় কিডনি রোগীদের সেবায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট পরিচালনা করলে বৃহত্তর নোয়াখালীর অসহায় রোগীরা উপকৃত হবে।
নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক বলছে, কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিট শুরুর পর থেকে এখানে সরকারি সেবার অপব্যবহারের মাধ্যমে অসহায় রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা হচ্ছে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে সরকারি ফির বাহিরে অতিরিক্ত টাকা। কিডনি বিশেষজ্ঞ না হয়েও ডা. মামুন পারভেজ নামের এক ভুয়া ডিগ্রীধারীকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে ওই ইউনিটের সকল কার্যক্রম। যার মাধ্যমে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা লুট করে নেওয়া হচ্ছে।
তবে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে না চাইলেও কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিটে রোগীদের স্বার্থে অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মামুন পারভেজ। তিনি বলেন, ইউনিটটি শুরু থেকে যেভাবে চলছে, আমরাও ঠিক সেইভাবেই চালাচ্ছি। তবে নিজের ভুয়া ডিগ্রির বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি এই ডাক্তার।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নোয়াখালী কার্যালয়ের কোর্ট পরিদর্শক মো. ইদ্রিস সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিটে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। অভিযানকালে বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এবিষয় গুলো প্রতিবেদন আকারে প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করা হবে।
কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিটে কোন দুর্নীতি হচ্ছে না জানিয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ওই ইউনিটে যারা চিকিৎসা নিচ্ছে, তারা একেবারেই গরীব মানুষ। তাদের হায়াতেরও গ্যারান্টি নাই। এই রোগীরা প্রাভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হলে, তাদের সর্বোচ্চ শেষ করতে হবে। এখানে সরকারি ফির অতিরিক্ত যে টাকা নেওয়া হয়, তা গরীব-অসহায় ওই রোগীদের পিছনেই ব্যয় করা হয়। ডা. মামুন পারভেজ ভুয়া ডিগ্রি পরিচয়ে কিডনি রোগী চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, বাহিরে ওই ডাক্তার কি করছে, তা আমার দেখার বিষয় নয়। আমার হাসপতালে কোন অনিয়ম করছেন কিনা আমি তাই দেখবো।
এদিকে, বৃহত্তর নোয়াখালীর কিডনি রোগীদের একমাত্র আস্থা ও ভরসাস্থল কিডনি ডায়ালাইসিস ইউনিটটি বন্ধ নয়, চালু থাকুক সরকারি নিয়মনীতি অনুযায়ী, ব্যবস্থা নেওয়া হোক অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমনটাই প্রত্যাশা নোয়াখালীবাসীর।