রাজধানীর ভাটারা থানা পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় বিষপান করেন ঢাকা ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সিনিয়র লেকচারার ফিরোজা আশরাবী (২৮)। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। পুলিশের দাবি, আশরাবী ঘটনার দুদিন আগে অনলাইন থেকে বিষ সংগ্রহ করেছিলেন এবং তিনি পরিকল্পিতভাবে সেই বিষ পান করে আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ হেফাজতে এই মৃত্যুর ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে—থানায় আটক থাকা অবস্থায় ভিকটিমের কাছে বিষ পৌঁছালো কীভাবে? এ প্রশ্ন ঘিরে তৈরি হয়েছে তীব্র বিতর্ক, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব ও পদ্ধতিগত দুর্বলতা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
থানা পুলিশের হেফাজতে বিষপানের ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ভাটারা থানার এক উপপরিদর্শক (এসআই) ও দুই নারী কনস্টেবলকে বরখাস্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি থানায় আশরাবীর কাছে বিষ পৌঁছে দেওয়ার অভিযোগে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) এক কর্মীসহ তৃতীয় লিঙ্গের দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য— ফিরোজা আশরাবী পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই আত্মহননের পথ বেছে নেন। মূলত পারিবারিক কলহ ও দাম্পত্য সম্পর্কে জটিলতা থেকেই তিনি এ কাজ করেছেন।
ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাকিবুল হাসান একটি অনলাইনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘গত ৭ জুলাই অনলাইনের মাধ্যমে রাসায়নিক বিষ সংগ্রহ করে বাসায় রেখে ছিলেন আশরাবী। ৯ জুলাই দিবাগত রাতে পল্লবীতে তার স্বামী ইলিয়াছ কামাল রিসাদের বাসায় তার (রিসাদ) পুরুষাঙ্গ কেটে দেন আশরাবী। পরে তিনি নিজেই ওই রাতে রিসাদকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান।’
ওসি আরও বলেন, ‘পরদিন ১০ জুলাই সকালে রিসাদের স্বজনরা হাসপাতালে আশরাবীকে ঘিরে রাখেন। তখন আশরাবী ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশের সহযোগিতা চান। এরই মধ্যে রিসাদের পুরুষাঙ্গ কাটার অভিযোগে তার বোন পল্লবী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরে বিকাল ৪টার দিকে পল্লবী থানার অনুরোধে ভাটারা থানা পুলিশ আশরাবীকে এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। তখনও পল্লবী থানার রিকুইজিশন না থাকায় তাকে ভাটারা থানার নারী ও শিশু সহায়তা কক্ষে রাখা হয়।’
পুলিশ আরও জানায়, আশরাবীকে আটক করে থানায় আনার সময় তিনি আইনি সহায়তা চেয়ে ব্লাস্টের প্রধান প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট মাহাপাড়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ইনহেলার আনার অনুরোধ জানান। এরপর ব্লাস্টের একজন ফিল্ড অফিসার সোভা ও তার সঙ্গী কণা আশরাবীর বাসা থেকে একটি ব্যাগ এনে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে তাকে দেন।
পুলিশ জানায়, সন্ধ্যার দিকে আশরাবীর কাছে সেই ব্যাগ আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ওষুধ খাওয়ার কথা বলে ব্যাগে থাকা বিষ পান করেন। তাৎক্ষণিকভাবে বিষের গন্ধ পেয়ে থানার দুজন নারী কনস্টেবল সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা নাসিমা ও শারমিন ঝাঁপিয়ে পড়ে বিষের বোতলটি ছুড়ে ফেললেও ততক্ষণে আশরাবী কিছুটা বিষ পান করে ফেলেন। এরপর তাকে দ্রুত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে তার পাকস্থলী পরিষ্কার করানো হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন ১১ জুলাই সন্ধ্যায় আশরাবী মারা যান।
পারিবারিক কলহ এবং পূর্ব পরিকল্পনার ইঙ্গিত
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ফিরোজা আশরাবী ঢাকা ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সিনিয়র লেকচারার ও ইলিয়াছ কামাল রিসাদ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। গত মার্চ মাসে তারা বিয়ে করেন। তবে রিসাদের আগের স্ত্রী কানাডা প্রবাসী এবং আশরাবীর আগেও একটি বিয়ে হয়েছিল। এ কারণে তাদের দুজনের পরিবারই এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি। অপরদিকে রিসাদের ‘একাধিক সম্পর্ক’ থাকার বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কলহ চলে আসছিল।
পুলিশ ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ৯ জুলাই রাত ১১টার দিকে আশরাবী রিসার্চ সংক্রান্ত জরুরি কাগজ দেখানোর অজুহাতে পল্লবীতে স্বামী ইলিয়াস কামাল রিসাদের বাসায় যান। পরে কৌশলে চায়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়ে কামালকে অজ্ঞান করেন। পরে অচেতন রিসাদের গোপনাঙ্গে আঘাত করেন আশরাবী। রাত সাড়ে ৩টার দিকে রিসাদ জ্ঞান ফিরে দেখেন তার পুরুষাঙ্গ কাটা। ওই অবস্থায় সে রাতেই রিসাদকে হাসপাতালে নিয়ে যান আশরাবী।
এ ঘটনায় পল্লবী থানায় আশরাবীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন রিসাদের বোন ফারিস্তা কামাল আধোরা। তিনি বলেন, ‘‘পরিকল্পিতভাবেই রিসাদকে হত্যার উদ্দেশে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে আশরাবী। তিনি আটকের পর বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন।’’
এ বিষয়ে পল্লবীর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিউল আলম বলেন, ১০ জুলাই বিকালে ভুক্তভোগী রিসাদের বোন বাদী হয়ে আমাদের থানায় আশরাবীর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। পরে পুলিশ সদস্যরা আশরাবীকে আনতে যাওয়ার সময় খবর আসে—তিনি বিষপান করে কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। প্রথমে আমরা সেখানে যাই এবং পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
অনলাইন থেকে বিষ কিনে ব্লাস্ট কর্মীর মাধ্যমে থানায় আনা হয়
থানায় বিষপানে সহকারী অধ্যাপক ফিরোজা আশরাবীর মৃত্যুর পর তার মোবাইল ফোনে ৭ জুলাই বিষ কেনার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। ওসি রাকিবুল হাসান বলেন, ‘আশরাবী সব কিছুই করেছেন তার পরিকল্পনা অনুযায়ী। তিনি আটকের পর ব্লাস্টের কাছে আইনি সহায়তার সুযোগ নিয়ে বাসা থেকে বিষ এনে পান করেছেন।’ এ বিষয়ে পুলিশের কৌশলগত ভুল ছিল বলে স্বীকার করে ওসি রাকিবুল হাসান বলেন, ‘তিনি যেহেতু একজন শিক্ষক, পিএইচডি করা, তার কৌশল ধরতে আমাদের কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে আমাদের দায়িত্বে কোনও গাফিলতি ছিল না। হয়তো শিক্ষককে সম্মান দেখাতে গিয়ে তার সঙ্গে কড়া ব্যবহার করেননি আমাদের নারী পুলিশ সদস্যরা।’
যদিও এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তাৎক্ষণিকভাবে ভাটারা থানার তৎকালীন ডিউটি অফিসার এসআই জামাল হোসেন ও আশরাবীকে পাহারা দেওয়া দুই নারী কনস্টেবল শারমিন ও নাসিমাকে (অন্তঃসত্তা) সাময়িক বরখাস্ত করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে।
ব্লাস্টের এক কর্মীসহ তৃতীয় লিঙ্গের দুজনের বিরুদ্ধে মামলা
পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আশরাবীর কাছে বিষ পৌঁছে দেয় বেসরকারি সংস্থা ব্লাস্টের ফিল্ড অফিসার সোভা ও কণা (দুজনই তৃতীয় লিঙ্গের)। এ ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে সোভা ও কণার বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। শুক্রবার (১১ জুলাই) তাদের গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ভাটারা থানার আত্মহত্যায় প্ররোচনা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ফিরোজা আশরাবী থানায় আটক থাকা অবস্থায় ব্লাস্টের এক কর্মীসহ দুজন তার কাছে বিষ পৌঁছে দেন। প্রাথমিকভাবে তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমরা বিষয়টি আরও তদন্ত করে দেখছি।’
ব্লাস্টের সঙ্গে আশরাবীর পরিচয় কীভাবে
পুলিশ জানায়, আশরাবী যেহেতু একজন উচ্চশিক্ষিত নারী, তিনি অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতেন। এছাড়া রিসাদের সঙ্গে তার মনোমালিন্য থাকায় দীর্ঘদিন ধরে আইনি পরামর্শের জন্য তিনি ব্লাস্টের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেই সূত্রে তিনি আটকের পর কৌশলে ব্লাস্টের মাধ্যমে বাসা থেকে বিষ এনে পান করেছেন।
ব্লাস্টের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়া যায়নি। পরে ব্লাস্টের প্রধান প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট মাহাপাড়ার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। অপরদিকে ব্লাস্টের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, “এ বিষয়ে যেহেতু একটি মামলা হয়েছে, তাই এটি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেখা হচ্ছে।”
ঘটনার জেরে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কোনও ব্যক্তির আত্মহত্যা শুধু ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়, বরং পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গুরুতর ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। উৎস: বাংলা ট্রিবিউন।