অপূর্ব চৌধুরী: [২] পুরান ঢাকার বিরতিহীন যানজট, ঘিঞ্জি রাস্তা কিংবা মাত্রাতিরিক্ত ভিড় সবকিছুর মধ্যে কেবল একটি জায়গাতেই যেন স্বস্তি খুঁজে পান সাধারণ মানুষ। সেটি হচ্ছে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো বাহাদুর শাহ পার্ক। একটুকরো সবুজের সমারোহও এই পার্কটি। বছরের পর বছর গেলেও পার্কটির সাথে পুরান ঢাকাবাসীর সম্পর্ক রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন।
[৩] ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮ শতকের শেষের দিকে এখানে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল। এই ক্লাবকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছিল আন্টাঘর। আর বিলিয়ার্ড বলকে অভিহিত করা হত আন্টা নামে। সেখানেই ছিল একটি ময়দান। ১৮৫৮ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানেই একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার। এরপর থেকেই এই স্থানটির নাম হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক।
[৪] সিপাহী বিদ্রোহের (১৮৫৭ সাল) পর একটি প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজ শাসকরা অনেক সিপাহীকে ফাঁসি দেয়। তাদের লাশ সেই ময়দানের বিভিন্ন গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ১৯৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক।
[৫] এই পার্ক এখন মিশে গেছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের সাথে। দীর্ঘ সংস্কার কাজে পরিসর পাল্টায় পার্কটির৷ বাড়ে হাঁটা ও বসার জায়গা। তবে গত বছরের অক্টোবরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ‘ফুড ভ্যান’ প্রকল্প নামে দরপত্র আহ্বান করে বাহাদুর শাহ পার্কে খাবারের দোকানের জন্য ইজারা দেয়। ঠিকাদার পার্কের উন্মুক্ত অংশটিতে দোকানের অবকাঠামো নির্মাণ করে৷ বিষয়টি নিয়ে শুরুতেই সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ জানালেও কাজ হয়নি। ফলে পার্কের মধ্যে রান্না করায় চারদিকের গাছপালার ওপরও পড়ছে এর বিরূপ প্রভাব।
[৬] তবে সজীবতার ছোয়া নিতে এখনো পুরান ঢাকাবাসীর কাছে একমাত্র ভরসা এই বাহাদুর শাহ পার্ক। সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে পার্কে আসেন আশেপাশের বিভিন্ন স্থানের প্রবীণ ব্যক্তি ও মধ্যবয়সীরা। পাখির ডাকের সাথে সাথে তাদের শরীরচর্চা চলতে থাকে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে পার্কে মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকে।
[৭] পার্কের চারদিকে গড়ে উঠা প্রায় অর্ধশত ভাসমান দোকানীরা তাদের দোকান খুলেন। চা, ফলমূল, আখের রস, ঝালমুড়ি, আইসক্রিমের দোকানের পাশাপাশি পার্কে থাকে স্বাস্থ্যবিষয়ক বুথ। ওজন মাপা, রক্তচাপ মাপা, রক্তের গ্রুপ নির্ণয়সহ বিভিন্ন সুযোগ থাকে পার্কে।
[৮] কেউ বসে থাকেন একা, কেউবা আবার গ্রুপ আড্ডায় মগ্ন থাকেন। আশেপাশে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্যও বাহাদুর শাহ পার্কটি অন্যতম প্রিয় জায়গা আড্ডা দেওয়ার। আর এজন্যই বেলা বাড়ার সাথে সাথে অন্যান্যদের সাথে শিক্ষার্থীদের গ্রুপ আড্ডাও বেড়ে যায়। বিকাল কিংবা সন্ধ্যা যখনই সুযোগ মিলে পার্কেই চলে আড্ডার খুনসুটি।
[৯] রাতের বেলায়ও পার্কটি জনসমাগমে পূর্ণ হয়ে উঠে। আর সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে সপরিবারে পার্কে আসেন অনেকে। তবে পার্কের ভেতরে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল টয়লেট। পার্কের পাশেই বাস স্ট্যান্ড থাকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লঞ্চ দিয়ে ঢাকায় আসা লোকজনও এই পার্কে বসেই বিশ্রাম নেন।
[১০] পুরান ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা তাপস বিশ্বাস বলেন, এই যান্ত্রিক শহরের মধ্যে পার্কটির সবুজ পরিবেশ আমাদের কিছুটা হলেও সজীবতা দেয়। বিকালে পাখির ডাকও প্রকৃতি প্রেমীদের মন ছুয়ে যায়৷ যখনই সুযোগ পাই বন্ধুবান্ধব মিলে আসি এখানে। গাছপালা বেষ্টিত এমন জায়গা শহরে খুব কমই থাকে।
[১১] জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন বলেন, ক্লাস শেষে সময় পেলে মাঝেমধ্যে বাহাদুর শাহ পার্কে যাই। ফুচকা খেতে গিয়েছি কয়েকবার। একটা প্রশান্তি লাগে পার্কে গাছপালার ছায়া থাকায়। পরিবেশ খুব নির্মল না হলেও মানুষের একটা আত্মিক সম্পর্ক বিদ্যমান পার্কটির।
প্রতিনিধি/একে