সাজিয়া আক্তার: চাকরির ইন্টারভিউ, চিকিৎসা, ট্রেনিংসহ অনেক গুরুত্বর্পূণকাজে ঢাকায় এসে অনেককেই হিমশিম খেতে হয় একটু থাকার জায়গার জন্য। সেখানে হোটেলের কথা ভাবলে টাকা খরচের পাশাপাশি ভাবতে হয় নিরাপত্তা নিয়েও। তাদের চিন্তামুক্ত করতে ‘সুখী কিশোরগঞ্জে’র বিভিন্ন সেবামূলক উদ্যোগের একটি হলো ‘কিশোরগঞ্জ মেহমানখানা’। যেখানে কিশোরগঞ্জবাসীদের পাশাপাশি বর্তমানে ময়মনসিংহের নান্দাইল, নেত্রকোনার কেন্দুয়া ও নরসিংদীর মনোহরদীর বাসিন্দারাও এ মেহমানখানায় বিনামূল্যে থাকার সুযোগ পাচ্ছে।
রাজধানীর গ্রিনরোডে কমফোর্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাছে এই মেহমান খানায় একদিনে থাকার ব্যবস্থা আছে ১৫ থেকে ২০ জনের মত। মেহমানখানায় ১৬ মাসে থাকার সুযোগ পেয়েছেন প্রায় ২ হাজার মেহমান। ২০২১ সালের অক্টোবরে যাত্রা শুরু এ মেহমানখানার। মধ্যরাতে ফ্লাইট আছে, বিদেশে যাবেন, তারাও সুযোগ পাচ্ছেন মেহমানখানায় থাকার।
চারটি ঘরে চৌকি ও তোশক বিছানো। নেই আসবাবের বাহুল্য। মেহমানদের জন্য পরিষ্কার চাদর ও বালিশের কভার রেডি করে রাখা। চারটি ঘরের একটি ঘরে নারীরা স্বজনের সঙ্গে থাকার সুযোগ পান। এ ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া বাথরুম আছে। অন্য ঘরগুলোতে পুরুষ মেহমানেরা থাকেন।
সুখী কিশোরগঞ্জের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী লুৎফুল্লাহ হোসেন পাভেল। তিনি জানালেন, সুখী কিশোরগঞ্জ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি গ্রুপ। তার এ উদ্যোগে পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি বন্ধু ও ফেসবুকের অন্যরাও যুক্ত হচ্ছেন। বর্তমান বাড়ির মালিক বেশ কম দামেই বাড়িটি ভাড়া দিয়েছেন। আগামী ছয় মাস মেহমানখানার খরচ কে কে দিতে ইচ্ছুক, এমন ২৫ জন দাতার নাম জানতে চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর ২৫ জন দাতাই পাওয়া গেছে, যারা মাসে দুই হাজার করে টাকা দেন। ছয় মাসের খরচের জন্য আর কোনো চিন্তা করতে হয় না।
এই উদ্যোক্তা আরো জানান, নারীদের থাকার জন্য আপাতত একটি ঘর আছে। নারীর সঙ্গে স্বামী ও সন্তান বা ভাই—এমন আরেকটি পরিবার এলে নারী ও শিশুদের জন্য কক্ষ ছেড়ে দিয়ে দেখা যায়, আরেক পরিবারের পুরুষ সদস্যরা অন্য কক্ষে গিয়ে থাকেন। যেহেতু রান্নাঘর ও বাসনপত্র আছে, কোনো পরিবার রান্না করলে দুই পরিবারের সদস্যরাই তা খান। এভাবেই মিলেমিশে থাকেন তারা।
লুৎফুল্লাহ হোসেন বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থেই মেহমানদের বিভিন্ন তথ্য যাচাইবাছাই করা হয়। মেহমানখানার বিষয়ে স্থানীয় থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে থানা থেকেও জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন তথ্য নেওয়ার কথা বলে দিয়েছে। চাকরিপ্রার্থী বা চিকিৎসার জন্য আসা ব্যক্তির সঙ্গে অন্য যে সদস্যরা আসবেন, তাদের সঙ্গে সম্পর্কসহ বিভিন্ন তথ্য জেনে নেওয়া হয়। রোগী ও চাকরিপ্রার্থীর ক্ষেত্রে প্রেসক্রিপশনের ছবি, চাকরির ইন্টারভিউ কার্ড, ছবিসহ বিভিন্ন তথ্য দেখেই মেহমানদের স্বাগত জানানো হচ্ছে। তিন রাত সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে থাকতে পারবেন, তবে ক্যানসার রোগী বা জটিল সমস্যায় আসা ব্যক্তিদের তিন রাতের পরও থাকতে হলে আবার একটি আবেদন করতে হয়। সে ক্ষেত্রে পাঁচ রাত থাকতে পারেন তারা।
মেহমানখানার বাসাভাড়া, ব্যবস্থাপক, পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বেতনসহ বিভিন্ন খরচ বাবদ মাসে গড়ে ৪০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। দাতাদের কে কত টাকা দিচ্ছেন, তার নামসহ গ্রুপে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেউ নাম প্রকাশ করতে না চাইলে তার নামের আংশিক অংশ, ফোনের শেষ তিনটি সংখ্যা জানিয়ে দেওয়া হয়। কারও নাম বাদ গেলে তিনি আবার গ্রুপে জানান। টাকাপয়সার হিসাব রাখার জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আছেন, যার ব্যক্তিজীবন নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই।
এক প্রশ্নের উত্তরে লুৎফুল্লাহ হোসেন বলেন, এ উদ্যোগগুলো থেকে নিজেও সুখী হতে পারছি। শান্তি পাচ্ছি। ফেসবুককে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে চাচ্ছি। একইভাবে যারা দান করছেন, তার ফলাফল চোখের সামনে দেখতে পারছেন। আমরা চাই, এভাবেই একদিন শুধু সুখী কিশোরগঞ্জ নয়, সুখী বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
এই উদ্যোক্তা জানান, এরপর কিশোরগঞ্জে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি, কিশোরগঞ্জ অক্সিজেন সাপোর্ট ব্যাংক, গ্রামের মানুষদের করোনার টিকা নিতে সুরক্ষা অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দেওয়াসহ একের পর এক উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ করছেন। এখন স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ না পেলে অস্থির হয়ে যান। স্বেচ্ছাসেবকদের পরিবারের সদস্যরাও বিভিন্ন উদ্যোগে যুক্ত হচ্ছেন। এসব উদ্যোগ নিতে নিতেই মেহমানখানার কথা মাথায় আসে।
মেহমানখানায় যারা আসেন, হয় তারা এ গ্রুপের সদস্য বা পরিচিত কেউ থেকেছেন তার কাছ থেকে খবর পেয়ে এসেছেন। এভাবেই এর পরিচিতি বাড়ছে। আর উদ্যোগটি এখন আর শুধু একটি উদ্যোগের মধ্যে আটকে নেই, অনেকেই নিজেদের এলাকার জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন। রাজধানীর শ্যামলীসহ বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের মেহমানখানা গড়ে উঠছে। মেহমানেরা নিজেদের ফেসবুকেও মেহমানখানায় থাকার সময়ের গল্পগুলো লিখছেন।
মেহমানখানার ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্বে আছেন তানভীর রহমান। মেহমানেরা আসার আগে থেকেই তার দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। যারা আসতে চান, তারা প্রথমে তানভীর রহমানের মুঠোফোনে (০১৭১ ৪৭৭০১৮৯) ফোন করেন। তারপর যিনি আসতে চান, তাকে জাতীয় পরিচয়পত্র, কোনো একজনের রেফারেন্স, রেফারেন্স দেওয়া ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র ও ফোন নম্বর পাঠাতে বলেন। যে ব্যক্তির রেফারেন্স দেওয়া, তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সব তথ্য ঠিক থাকলে মেহমান হিসেবে যিনি থাকতে চাচ্ছেন, তাকে মুঠোফোনে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বার্তা পাঠান তানভীর। তারপর মেহমান ঢাকায় এসে সেই বার্তা দেখালে তাকে স্বাগত জানান। মেহমানেরা আসার পর তাদের দেখভালও করতে হয় তানভীর আহমেদকে। তানভীর রহমান তার ফেসবুকে লিখেছেন, কিশোরগঞ্জ মেহমানখানায় আপনাদের রিসিভ (স্বাগত) করার জন্য অপেক্ষায় রইলাম। নিচে মেহমানখানার ভিডিওচিত্র দেয়া হলো।
ভিডিওটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন
এসএ/এসএ