সাজিদ ইউসুফ শাহ, একটিপ্রবন্ধে হুদভয় লিখেছেন, "১৯৭১সালের বিশাল আত্মসমর্পন পশ্চিমপাকিস্তানিদের মানহানি করে। কিন্তু, এমনকি দ্বি-তি তত্ত্বছিটকে পড়লেও পাকিস্তানের অপ্রতিরোধ্য সংখ্যাগরিষ্ঠরাতাদের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করতে রাজি ছিলনা। পশ্চিমশাখা নিজেদের নামকরণ করে পাকিস্তান, অনেকেই ভেবেছিল এটা সাময়িক।তারা বলেছিল বাংলাদেশ কখনোইঅর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকতে পারবেনা এবং বিনীতভাবে নিজেকেফিরিয়ে নিতে বলবে।"
কিন্তুপাকিস্তানের সেই ইচ্ছা অবশ্যবাস্তবে পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে স্বাধীনতার৫০তম বছর উদযাপনে করছে, তখন সমগ্র বিশ্ব প্রত্যক্ষ্য করছে যে দেশটি আর্থ-সামাজিক-মানবিক সূচকে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে।
১. বাংলাদেশ, পরবর্তী এশিয়ান টাইগার হিসাবে অভিক্ষিপ্তহচ্ছে, অন্যান্যের মধ্যে বৈদেশিক রিজার্ভ, মাথাপিছু বাহ্যিক ঋণ, গড় আয়ুএবং মহিলা শ্রমশক্তির অংশগ্রহণেরহারসহ অসংখ্য সূচকে পাকিস্তানকেছাড়িয়ে গেছে।
৩. ২০২১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানাতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান স্বাধীনতার ৫০তমবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখেছিলেন। ঢাকা খুব ভালভাবেই এর জবাব দিয়েছে।
যাইহোক, সম্পর্ক উন্নত করতে "কাঁটা" অপসারণ করা দরকার।
"পাকিস্তানের প্রকাশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিবহুদিন ধরে বাকি রয়েছে... কোনো জাতি তার অন্ধকারঅতীতের মুখোমুখি না হয়ে এগিয়েযেতে পারে না।"
৪. পাকিস্তানের পূর্ববর্তী পদক্ষেপগুলিতে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে বিরক্ত হয়েছে উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে রেজুলেশন গৃহীত হয়েছিল, যেখানে১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কিছু ব্যক্তিকে দোষীসাব্যস্ত করে ফাঁসি দেওয়া হয়। হাসিনা ওয়াজেদ ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু করার পর তথাকথিত ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচার পুনরায় শুরু করার পর পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যাবাসনের জন্য ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সর্বদাই ১৯৭১ সালের বিচ্ছিন্নতার তিক্ত অতীতকে একটি বন্ধ অধ্যায় বলে মনে করে।
৫. একদিকে পাকিস্তান শান্তি চাওয়ার ভান করে কিন্তু অন্যদিকে গোয়েন্দাসংস্থা-আইএসআই তার ’দালাল’ পাবলিক নিউজের একজন উপস্থাপিকা মারিয়া জাদুনকে দিয়ে সবসময় মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্য অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের প্রকৃত সত্য আজও রহস্যে ঘেরা। যাইহোক, এটা নিশ্চিত যে ১৫ আগস্টের গণহত্যার পেছনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী-আইএসআই এবং বাংলাদেশেতাদের সহযোগীরা জড়িত যারা কার্যত বঙ্গবন্ধু এবং তার পুরোপরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এর আগে, ইসলামাবাদ ভিত্তিকএকটি বিশেষ থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ডসিকিউরিটি স্টাডিজ’ নীতি সংক্রান্ত সংলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছিল, এর চুড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিল অতীতকে ভুলে যাওয়া। তারা বোঝাতে চেয়েছিল এখন ক্ষমা চাওয়া কতটা প্রাসঙ্গিক!
৬. দৃশ্যত বাংলাদেশের সাথে নতুন করে সম্পর্ক তৈরির জন্য পাকিস্তানের আইএসআই একটি প্রচেষ্টা বা প্রয়াস চালায়। ৯ নভেম্বর 'পাকিস্তান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ কনফারেন্স'-এর প্রথম সংস্করণের আয়োজন করে এবং পরবর্তীতে১৯ নভেম্বর ২০২১-এ 'খেলখেল মে' সিনেমার মুক্তি দেয় যেখানে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।ফিজ্জা আলি মির্জা প্রযোজিত এবংনাবিল কোরেশি পরিচালিত, ছবিটি দুটি পাকিস্তানি প্রজন্মকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে - যে প্রজন্ম ১৯৭১ সালের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে এবং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং তরুণ প্রজন্ম, যাদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যারা সরকারী রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং পূর্বে লুকানো যুদ্ধের বিভিষীকা বা ভয়াবহতা উদ্ঘাটনকরতে চায়।
৭. আইএসআই অন্যান্য ব্যর্থ প্রচেষ্টা যেমন পাকিস্তানী নাটক সিরিজ ‘জোবিচার গায়ে’ র মাধ্যমেতার আক্রমণাত্মক অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে। ১২ডিসেম্বর প্রিমিয়ার করা নাটকটিতে নির্লজ্জভাবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত বিবরণ চিত্রিত করা হয়।প্রতিবাদী ছাত্রদের দেখানো হয়।এর পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাদের ন্যায়নিষ্ঠ ভদ্রলোক হিসাবে দেখানো হয়। স্বাধীনতার মাসে সাধারণ বাংলাদেশিদের অনুভূতির সাথে খেলা করে, পাকিস্তান একটি ডকুমেন্টারি "সেপারেশন অফ ইস্ট পাকিস্তান: দ্য আনটোল্ড স্টোরি" ১৬ ডিসেম্বর প্রদর্শন করে। ইভোলিউশনমিডিয়ার প্রযোজিত, নির্বাহী প্রযোজক জাভেদ জব্বারের লেখা ডকুমেন্টারটিতে কিছু কিছু জায়গায়সীমা অতিক্রম এবং কিছু নৃশংসতারকথা স্বীকার করা হয়েছে কিন্তু তা ভয়াবহ বা খুববেশি অতিরিক্ত নয়।
৮. নিজেদের তিক্ত পরাজয় বা চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক ক্রিকেট সিরিজের সময় তথাকথিত পাকসমর্থকদের সাথে যা ঘটেছিল তা ভুলে গিয়ে পাকিস্তান 'পাকিস্তান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ কনফারেন্স' ২য় সংস্করণের মাধ্যমে তাদের অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এটি ২ জানুয়ারী, ২০২২ তারিখে লাহোরে অনুষ্ঠিত হয়।
৯. অধিকাংশ জাতি তাদের গৌরবের সময়ের চেয়ে দুর্যোগের মুহূর্তগুলিকে বেশি মনে রাখে। এটা শিখতে এবং ভবিষ্যতের বিপর্যয় এড়াতে সাহায্য করে। জাতীয় দুর্যোগের সাথে সাথে পূর্বপাকিস্তানে পাকিস্তানের ব্যর্থ দুঃসাহসিক কাজ সাম্প্রতিক সময়ে যেকোনো দেশের ওপর নিপতিত সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিগুলোর মধ্যে অন্যতম অবস্থানে রয়েছে। ১৯৭১সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের আত্মসমর্পণের সাথে সাথে দেশটিতার অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা, ভূখণ্ডের এক তৃতীয়াংশ এবং অনেক প্রভাব প্রতিপত্তি হারায়। কিন্তু অধিকাংশ পাকিস্তানি সেই দুঃখজনক দিনটিকে মনে রাখার বা তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেয়ে সেটি ভুলে বসে আছে।
১০. পরাজয়ের পরপরই, যা পাকিস্তানিদের বিস্মিত করেছিল কারণ এর প্রতিটি দিক জনগণের কাছে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, বাংলাদেশ সৃষ্টির কারণ উদ্ঘাটনে গোটাপরিস্থিতি তদন্ত করার জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে কমিশন একটি বিস্তৃত প্রতিবেদন তৈরি করে, যা আজ অবধি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি পাকিস্তান। কমিশনের তদন্ত ফল তিন দশক পর ফাঁস হয়। তবে তা পুণরায় উপেক্ষিত হওয়ার আগেই শুধু পাকিস্তানের মিডিয়াতে আলোচনার জন্য ফাঁস হয়। হামুদকমিশনের রিপোর্টে সেই সময়ে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের স্বার্থপর ব্যক্তি হিসাবে প্রকাশ করা হয় যারা ব্যক্তিগত লাভের জন্য দেশের ভবিষ্যতকে ঝুঁকিতে ফেলতে ইচ্ছুক। তবে সবচেয়ে বেশি উন্মোচিত হয় সেনাবাহিনীর কর্মকান্ড। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং তার নিকটতম সহযোগীদেরকে দুশ্চরিত্রের লোক হিসাবে বর্ণনা করা হয়।
১১. পাকিস্তানকে বিশ্বাস করা যায় না বুঝতে পেরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে ওআইসির বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিতে ইসলামাবাদে তার সফর বাতিল করেন যা ১৯ ডিসেম্বর নির্ধারিত ছিল। যদি শাহরিয়ার পাকিস্তান সফর করতেন তবে তা গত নয় বছরে এবং শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম পাকিস্তান সফর হত।
১২. পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে মুজিববর্ষ উদযাপনের মধ্যে গত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় ঢাকায় অনুশীলনকালে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উত্তোলন বাংলাদেশের জাতীয় চেতনায় একটি বড় আঘাত ছিল। সুশীল সামাজিক সংস্থা নির্মূল কমিটি এই পদক্ষেপের নিন্দা করে এবং বলে যে এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করার জন্য 'ইচ্ছাকৃত' অসম্মানজনক কাজ।
১৩. সাম্প্রতিক সময়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশীর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হল একই বছরে দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দ্বিপাক্ষিক সফর। শুধুমাত্র ২০২১ সালে ভারত থেকে ১১-১২টি দ্বিপাক্ষিক সফর সংগঠিত হয়, যা অতীতে কখনও ঘটেনি, এটাই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শক্তি প্রদর্শন করে। ২০২১সালের ১৫ থেকে ১৭ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি রাম নাথ কোভিন্দ বাংলাদেশ সফর করেন যা ছিল কোভিড মহামারী প্রাদুর্ভাবের পর তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। রাষ্ট্রপতিপুনর্ব্যক্ত করেন যে ভারতের ‘প্রথম প্রতিবেশী’ নীতিতে বাংলাদেশের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উন্নয়ন অংশীদারিত্ব সবচেয়ে ব্যাপক। একইসময়ে আমাদের সম্পর্কের সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলো পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট পরিপক্ক। ৫০বছর আগে ভারত ও বাংলাদেশ একটি বিশেষ বন্ধুত্বের সূচনা করে যা ভাষা, আত্মীয়তা, ধর্ম এবং সাংস্কৃতিক নীতির পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল।
লেখক: ভারতের সাংবাদিক ও কলামিস্ট।