আসাদুজ্জামান সম্রাট, গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন থেকে ফিরে: ২৬তম বিশ^জলবায়ু সম্মেলনে প্রেসার গ্রুপগুলোর মধ্যে সবচে’ বেশি দৃষ্টি কেড়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনডিজিনিয়াস পিপলস্ ফোরাম অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ’। সম্মেলনের প্রতিদিনই তাদের নানা কর্মসূচি ছিল। সারা পৃথিবীর আদিবাসীদের সঙ্গে এবার সবচে’ বেশি আদিবাসী এসেছিল লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে। বিশেষ করে পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত অ্যামাজনের আদিবাসীদের নানা প্রতিবাদে ফুটে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবন-জীবিকা হারানোর শঙ্কা। তাদের কণ্ঠে ছিল অ্যামাজন বাচানোর করুণ আকুতি।
কথা বলছিলাম, নেটিভ অ্যামাজন অপারেশনের অবজারভার রোমানচিল গেন্টিল কোর্তেয়ার সঙ্গে। বলছিলেন, পুরো অ্যামাজন ঘিরে বসবাস করে চারশ’রও বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। যার আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ অ্যামাজনকে ঘিরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবের ফলে তাদের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে। কোর্তেয়ার মতে, প্রতিদিন যেভাবে অ্যামাজন উজাড় হচ্ছে তাতে আদিবাসীদের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
ইনডিজিনয়িাস ওয়ার্ক সেন্টারের অবজারভারের বিশাল নামটি পড়তে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। ‘জোসিলিয়া ডেনিজা জ্যাগসো ইনাসিও জ্যাকোডসন চিল্ড’ নামের এই জলবায়ু কর্মী জানালেন, এবারের সম্মেলনে অ্যামাজন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আদিবাসীদের সবচে’ বেশি সংখ্যক সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন। আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব পোষাক পরিধান করে সম্মেলনস্থলে এসে নানা প্রতীকি কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। কথা বলতে চাইলে এদের বেশিরভাগই ‘নো ইংলিশ’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। প্রত্যেকটি আদিবাসী গোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। এমন একটি গ্রুপের সঙ্গে কথা হয় দোভাষীর মাধ্যমে। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনডিজিনিয়াস পিপলস্ ফোরাম অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ’ এদের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য দোভাষীর ব্যবস্থা রেখেছেন। ইনসিও জ্যাকোডসন জানালেন, অ্যামাজন বন যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে তাদের হয়তো আমাদের জীবদ্দশাতেই তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এর সঙ্গে আদিবাসী অনেক গোষ্ঠী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। যাদের সম্পর্কে কোনদিন জানতে পারবেনা পৃথিবীর মানুষ।
এবারের জলবায়ু সম্মেলনের অ্যামাজনের আদিবাসীদের উচ্চকিত কণ্ঠ যেভাবে সবার সবার দৃষ্টি কেড়েছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় সমালোচনা এমনকি মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছেন আদিবাসী এক জলবায়ু কর্মী। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছেন আমাজন রেইনফরেস্টের আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি জাই সুরুই। ২৪ বছর বয়সী এই জলবায়ু কর্মী বেড়ে উঠেছেন আমাজন রেইনফরেস্টের আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে। তিনি তার বক্তব্যে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্ব নেতাদের সামনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব তুলে ধরেন। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বক্তৃতা দিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের মাঝে বেশ প্রশংসিতও হয়েছেন তিনি। পুরো সম্মেলন জুড়ে আলোচনায় ছিলেন তিনি।
তবে বক্তৃতার পর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বলসানারো প্রকাশ্যে তার সমালোচনা করেন। প্রেসিডেন্টের মতে জাই সুরুই 'ব্রাজিলকে আক্রমণ' করে পুরো বিশ্বের সামনে বক্তৃতা দিয়েছেন, যা দেশের ভাবমূর্তিতে আঘাত হেনেছে। প্রকাশ্যে সমালোনার শিকার হওয়ার পর অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে গালমন্দ করেছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সুরুই। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আমি ঠিক কথাই বলেছি; আর এ কারণেই তারা আমাকে আক্রমণ করেছে।’ ব্রাজিলের রন্ডোনিয়ার জাই সুরুই ওই রাজ্যের আদিবাসী যুব আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি ছোটবেলা থেকেই একজন জলবায়ু কর্মী হয়ে ওঠেন এবং বর্তমানে সারা বিশ্বে তিনি বন উজাড়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
পৃথিবীর ফুসফুস নামে খ্যাত অ্যামাজন জঙ্গল। যা ব্রাজিলের সীমান্ত ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছে আশপাশের আরও নয়টি দেশে। বহু শতাব্দী ধরে অ্যামাজনের জঙ্গলে আদিবাসী মূলবাসীদের বসবাস। যার মধ্যে বেশ কিছু জনজাতি এখন বিলুপ্তপ্রায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যামাজন জঙ্গলে প্রায় ৬০০টি জনজাতি গোষ্ঠীর বসবাস। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীবিধৌত অঞ্চলে অবস্থিত এক বিশাল বনভূমি আমাজন। ৭০ লাখ বর্গকিলোমিটার অববাহিকা পরিবেষ্টিত এই অরণ্যের প্রায় ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার মূলত আর্দ্র জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত। ৯টি দেশজুড়ে এই অরণ্য বিস্তৃত। আমাজনের ৬০ শতাংশ রয়েছে ব্রাজিলে, ১৩ শতাংশ পেরুতে এবং বাকি অংশ রয়েছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম ও ফরাসি গায়ানায়। পৃথিবীজুড়ে যে রেইনফরেস্ট তার অর্ধেকই আমাজনে। এবারের সম্মেলন থেকে প্রতিটি দেশ থেকে আদিবাসীরা যোগ দিয়েছেন। আদিবাসীরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পোষাক ছাড়াও পাখির পালক দিয়ে বানানো বিশেষ মুকুট মাথায় পড়েছিলেন। ব্রাজিলের জলবায়ু কর্মীদের সবার মাথায় এমন রঙ-বেরঙের মুকুট সবার দৃষ্টি কেড়েছে।
ধরিত্রী বাচাতে সদ্য সমাপ্ত এই সম্মেলনে বন ও পরিবেশ রক্ষায় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বোলসোনারো প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এর মধ্যেই জানা গেলো আমাজনে রেকর্ড পরিমাণ বনভূমি নিধন হয়েছে গত অক্টোবরেই। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরো শহরের আয়তনের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা অর্থাৎ ৮৭৭ বর্গকিলোমিটার বা ৩৩৯ বর্গ মাইল আমাজনের রেইনফরেস্ট উজাড় হয়েছে। ২০১৬ সালে ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ (আইএনপিই) বন উজাড়ের তথ্য নথিভুক্ত করা শুরুর পর থেকে অক্টোবরে বনভূমি নিধনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। গত বছরের তুলনায় অক্টোবরেই বননিধনের পরিমাণ ৫ শতাংশ বেড়ে গেছে।
২০২০ সালে বেআইনিভাবে খননকাজ এবং গাছ কেটে কৃষি জমি তৈরি করার কারণে বননিধন চরমভাবে বেড়ে গেছে। ২০২০ সালে যে পরিমাণ বন ধ্বংস হয়েছে, ২০২১ সালেও একইভাবে আরও ৭ হাজার ৮৮০ বর্গকিলোমটিার বন উজাড় হয়েছে বছর শেষ হতে না হতেই। গ্লাসগো সম্মেলনকে ঘিরে ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমি নিধনের ইতি টানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিল অন্যতম। যদিও এই চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি। দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো ২০২৮ সালের মধ্যে অবৈধভাবে বন উজাড় ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, বোলসোনারোর আমলেই খনন কাজ আর কৃষি জমি তৈরির জন্য বননিধন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে যথেস্ট সন্দেহ রয়েছে।
গ্রিনপিস অ্যামাজন ক্যাম্পেইনের মুখপাত্র রোমুলো বাতিস্তা বলেন, বননিধন এবং আগুন লাগার ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং আদিবাসী ও স্থানীয়দের মধ্যে সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে। এই প্রতিশ্রুতি আদৌ বাস্তবতার কোনো পরিবর্তন করবে না। উল্টো আদিবাসীরা হুমকির মুখে পড়বে। আদিবাসীরা না থাকলে অ্যামাজন বনের অস্তিত্বও একদিন বিলীন হবে। সে দিনটি হয়তো খুব বেশি দূরে নয়।
আইএনপিইর তথ্য-উপাত্ত বলছে, অ্যামাজনে চলতি বছরের শুধু অক্টোবর মাসেই ১১ হাজার পাঁচশ’রও বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ছিল ১৭ হাজার তিন শ’। কিন্তু ২০১৯ সালের পর এসব ঘটনা দ্রুত বেড়েছে এবং তখন ছিল সাত হাজার নয়শ’টি। ২০১৯ সালে জেইর বোলসোনারো ক্ষমতায় বসার পর আমাজনের ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার খোয়া গেছে এক বছরেই, যার আয়তন প্রায় লেবাননের সমান। গত দশকে এটা ছিল ৬ হাজার পাঁচশ বর্গকিলোমিটার। ফলে আমাজনের আদিবাসীরা জেইর বোলসোনারোর এসব প্রতিশ্রুতিতে খুব একটা আশ^স্ত হতে পারছেন না।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, চিরহরিৎ বনাঞ্চলসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আদিবাসী মানুষেরা হচ্ছেন সেরা তত্ত্বাবধানকারী। এই সম্মেলনেও পৃথিবীর ভূমি ও বনাঞ্চল রক্ষায় তাদের ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে আদিবাসী কমিউনিটিগুলোকে ১.৭ বিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা। তবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলো অবৈধভাবে গাছ কাটা ও খনি পরিচালনার মতো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত পরিবেশগত অপরাধীদের কাছ থেকে ক্রমাগতভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। গত বছর মেক্সিকোতে আদিবাসীদের ওপর যে ৩০টি প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে, তার অর্ধেকই ছিল জলবায়ু ইস্যুতে। পরিবেশবাদী ও আদিবাসী নেতৃবৃন্দের ওপর সহিংসতার ক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকাই সবচেয়ে ভয়ানক অঞ্চল। অ্যামাজন রক্ষায় এসব ইস্যুতেও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন নেটিভ অ্যামাজন অপারেশনের অবজারভার রোমানচিল গেন্টিল কোর্তেয়া।