লুৎফর রহমান রিটন
আমার পাঠশালার নাম ছিলো নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। এটা ছিলো গুলিস্তান আর ঠাটারি বাজারের মাঝখানে। নবাবপুর রোড আর কাপ্তান বাজার লাগোয়া ব্যস্ত সড়কের ওপরে। এলাকাটা ঘিঞ্জি। সারাক্ষণ ভিড় হৈচৈ আর চিৎকার চ্যাঁচামেচির সঙ্গে যুক্ত থাকতো গাড়ির হর্ণ আর রিকশার টুংটাং বেল। আমাদের বাড়িটি ছিলো ওয়ারি হেয়ার স্ট্রিটে। হেয়ার স্ট্রিট থেকে পায়ে হেঁটে উত্তর মৈশুণ্ডি-বনগ্রাম-বিসিসি রোড ধরে ঠাটারি বাজারের ভেজা থকথকে কাদা-মাটি আর একদঙ্গল হাটুরে পাবলিককে অতিক্রম করে অপরিসর রাস্তার ওপর এলোপাতাড়ি ভাবে পার্ক করে রাখা রিকশা ঠেলাগাড়ি আর গাদাগাদা চালের বস্তা আটার বস্তার স্তুপ পেরিয়ে আমাকে পৌঁছুতে হতো পাঠশালায়। তো যাবার পথে বিসিসি রোডের ওপর বাঁ পাশে এক সারিতে দুতিনটে মিষ্টির দোকান পড়তো। এর একটার নাম ছিলো ‘নিত্যলাল সুইট মিট’। নিত্যলালের ভাইপো নিতাই আমার সহপাঠী ছিলো। সেই সুবাদে এই দোকানটার মালিক এবং কর্মচারীরা আমাকে চিনতো। সেই স্কুল লাইফে পকেটে টাকা-পয়সা খুব একটা না থাকলেও ঠাটারি বাজারের নিত্যলাল সুইটমিটে আমার প্রায় নিত্যদিনের প্রিয় খাদ্য ছিলো দই- এর সঙ্গে বুন্দিয়া। এক টাকার দই আর আট আনার বুন্দিয়া, মোট দেড় টাকার প্যাকেজ। প্রায় নিয়মিত, বলতে গেলে রোজই খেতাম রসে টইটম্বুর এই খুদে খুদে মনিমুক্তোগুলো।
দোকানের মালিক নিতাইর কাকা বিশাল ভুঁড়িয়াল লোকটা একটা স্যান্ডোগেঞ্জি পরে ক্যাশবাক্সের পাশে বসে সারাক্ষণ তালের পাখা নাড়িয়ে নিজেকে বাতাস করতে করতে নিখুঁত দৃষ্টিতে তদারকি করতেন সবকিছু। আমার বুন্দিয়া প্রীতিতে খুশি হয়ে কর্মচারীদের মাঝে মধ্যেই এক্সট্রা কিছু বুন্দিয়া আমার প্লেটে তুলে দিতো বলতেন বোনাস হিশেবে। আমার সঙ্গে এটা সেটা নিয়ে আলাপ জুড়ে দিতেন। আমার চটাংচটাং কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে মোটা ফ্রেমের চশমা পরা লোকটা তাঁর থলথলে ভুঁড়িতে ঢেউ তুলে হাসতে হাসতে মাঝে মধ্যেই সদ্য তৈরি হওয়া কোনো একটা মিষ্টির একটা নমুনা কপি আমাকে খেতে দিতেন। আমি খেতে না চাইলে জোর করতেন-‘আরে খাও মিয়া খাও পয়সা লাগবো না।’ উজ্জ্বল সোনালি-হলুদ রঙা বুন্দিয়াগুলোর মাঝখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মিশিয়ে দেয়া থাকতো সামান্য কিছু গাঢ় কমলা কিংবা লালচে কিছু বুন্দিয়া। তাতে করে বুন্দিয়ার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেতো কয়েক লাখ গুণ। সেই ছেলেবেলায় সেই বুন্দিয়া খাবার সময় চামচে ঠেলে ঠেলে লালগুলোকে সাইড করে রাখতাম পিরিচে। তারপর একবারে মুখে পুড়তাম চামচভর্তি লাল লাল বুন্দিয়া। মনে হতো স্বাদে খানিকটা পার্থক্য আছে। এবং এটা খানিকটা অধিক টেস্টি। তখনো বুঝতাম না ওটা ফুড কালারের কেরামতি। দিন যায় বছর যায়। সোনালি-হলুদ-লালের সঙ্গে যুক্ত হয় অল্পসংখ্যক সবুজ রঙের বুন্দিয়া। আমি হামলে পড়ি। আমার সামনে পরিবেশিত পিরিচ টাইপের ছোট্ট বাটিতে মজাদার দই- এর ওপর ল্যাপ্টালেপ্টি দিয়ে গড়াগড়ি খায় মাল্টিকালার বুন্দিয়ার অনিন্দ্যসুন্দর রূপের অপরূপ ক্যারিশম্যাটিক মোহময় ভুবন।
আমি বড় হই। আমার সঙ্গে বড় হয় বুন্দিয়াও। আমি ম্যাট্রিক পাশ করার সময় বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করি বুন্দিয়ার সাইজ ধিরে ধিরে বড় হয়ে গেছে। আগের সেই খুদে চমৎকার শেপের জায়গায় বরই বিচির চাইতেও বেশি বড় হয়ে উঠলো তারা। আমাকে হতাশ করে দিয়ে এক পর্যায়ে ওগুলো আকারে একেকটা হয়ে উঠলো প্রায় বিড়িং বা মার্বেলের সমান। বুন্দিয়ার ওরকম সৌন্দর্যহানীর প্রতিবাদ হিশেবে আমি বুন্দিয়া খাওয়াই ছেড়ে দিলাম একদিন। নিতাইর কাকাকে বললাম- আপনার এই ডাজ্ঞি সাইজের ঢাউস বুন্দিয়ার খ্যাতা পুড়ি...। নিজেকে অবিরাম বাতাস করতে করতে লোকটা তাঁর থলথলে ভুঁড়ি কাঁপিয়ে হাসে- ভাতিজা তুমি বড় হইতাছো আর বুন্দিয়া কি হালায় গিট্পাকাইয়া বইয়া থাকবোনি? নিত্যলাল আমলে না নিলেও আমার সেদিনের সেই প্রতিবাদকে নিত্যলাল ঘোষদের ভগবান আমলে নিয়েছিলেন। একটু আগে ‘গুগল ঘোষ’- এর কাছে কিছু বুন্দিয়া চাইলাম। অবাক কাণ্ড গুগল ঘোষ আমাকে ছেলেবেলার সেই খুদে খুদে গোল্ডেন প্লাস রেড বুন্দিয়াই সরবরাহ করেছে! বুন্দিয়া বেটা, জিতে রাহো বেটা...অটোয়া ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩। লেখক : ছড়াকার
আপনার মতামত লিখুন :