তুষার আবদুল্লাহ: একজন শুভাকাক্সক্ষী ফোন দিয়ে প্রশ্ন রাখলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন দু’জন সাংবাদিক, এ নিয়ে আপনারা যে গর্ব প্রকাশ করছেন, অভিনন্দন জানাচ্ছেন, এই গর্ব ও অভিনন্দন জানানোর যোগ্যতা কি আপনাদের আছে? আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখি নেই বলে মনে করছেন কেন? তিনি বললেন, আপনারা এখন সাংবাদিকতা করছেন না। পেশাগতভাবে আপনাদের জনসংযোগ কর্মকর্তা বলা যেতে পারে। সরকারি, বেসরকারি দুই ভুবনেই আপনারা জনসংযোগে দক্ষতা দেখাচ্ছেন। সরকার, সরকারের দফতরের এতোটাই ‘কাওয়ালী গান’ গাইছেন যে, সরকার বিব্রতবোধ করে। দফতরগুলোও হতবাক হয়ে যায়। আনুগত্য প্রত্যাশিত, কিন্তু জলোচ্ছ¡াস সয়ে যাওয়া মুশকিল। আপনারা তোষামদের সকল বাঁধ খুলে দিয়ে বসে আছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির নেক নজর পেতেও আপনারা দিলখোলা তোষামদের ‘জিকির আজকার’ করে যাচ্ছেন।
নগদ ‘তবারকে’ও শুকরিয়া নেই। আরো আরো ‘ফায়দা’ চাই আপনাদের। যে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, সেখানে পুঁজি যার বা যাদের তাদের ‘সম্রাট’ বা ‘পীরতুল্য’ করে খাদেমের ভ‚মিকায়, নিজেদের দেখার পরও কি মনে হয় আপনারা সাংবাদিকতা করছেন? আমি অকপটে উত্তর দিই, পুকুরের জল কচুরিপানায় ঢাকা থাকলেই, জল পচে গেছে, জলের রং কালো এমন ধারণা করা ঠিক হবে না। এখানে সাংবাদিকতা হচ্ছে না এমন গড় মন্তব্য করা ঠিক হবে না। যদি এই কোভিডকালের কথাই বলি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির খবর, সাংবাদিকরাই সামনে নিয়ে এসেছেন। রূপপুরের বালিশ কেনা কাহিনির মতো অনিয়মের খবরটি গণমাধ্যমই প্রকাশ করেছে। মন্ত্রী, আমলা, কর্মচারী, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের টাকার পাহাড় তৈরি বা টাকা উড়িয়ে বিদেশ নিয়ে যাওয়ার খবর সাংবাদিকরাই খুঁজে এনেছেন।
তারাই জানিয়েছেন ই-কমার্সের প্রতারণার খবর। মাদক বিরোধী অভিযানে অপহরণ করে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের সংবাদগুলো পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশন এবং অনলাইনে নিয়ে এসেছেন গণমাধ্যমকর্মীরাই। তবে কেউ যে খবরের অপমৃত্যু ঘটায়নি, সেই কথাও অস্বীকার করবো না। সকল দেশে সকল সরকার গণমাধ্যমকে নিজ নিজ কৌশলে দমিয়ে বা আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করে। সকল গণমাধ্যমকেই নিজের প্রচারযন্ত্র ভাবতে চায়। কোথাও তারা সফল হয়, কোথাও আধা বা সিকি ভাগ কিংবা এক আনা, দুই আনা হলেও হয়। একেবারে সফল হয়নি এমন নজির পাওয়া মুশকিল। বাহ্যিকভাবে যে গণমাধ্যমগুলোকে স্বাধীন বলে ঠাওর হয়, বুঝতে হবে সেখানকার সরকার, রাজনৈতিক দল, শিল্পগোষ্ঠীর সহিষ্ণুতা আপেক্ষিকভাবে বেশি। তারা তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এখানে বলে রাখা ভালো সকল দায় সরকারি দল বা সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। বিরোধীদল বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলও অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে। যার সামষ্টিক প্রভাব রাষ্ট্রের বিভিন্ন দফতর, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সকল স্তরের জনপ্রতিনিধি এবং ব্যক্তি পর্যন্ত বিস্তার পায়। সুতরাং আমরা যারা গণমাধ্যমে কাজ করছি, তারা সমাজের অসহিষ্ণু আবহাওয়াকে জয় করেই কাজ করছি। তবে আমাদের এখানে সাংবাদিকদের ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার সংস্কৃতি চালু হয়েছে একটা।
শুধু যে রাষ্ট্র ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চাচ্ছে তা নয়। সামাজিক, আর্থিক ক্ষমতার উত্তাপেরও কাঙালি আমরা। লোভাতুর হওয়ার ষোলোআনা কাঙালিপনা রয়েছে আমাদের। তাই সরকার, রাজনীতি, সামরিক-বেসামরিক আমলা, পুঁজিপতি না চাইলেও আমরা স্বেচ্ছায় ভোগ নিয়ে হাজির হচ্ছি। নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছি কোনটি সংবাদ হবে কোনটি হবে না। ক্ষমতার মানুষগুলোকে নিজে থেকেই টিপস দিচ্ছি, কীভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সুতরাং কাউকে দায়ী না করে নিজ কাঁধে দায় তুলে রাখা ভালো। সেই দায় নিয়েই বলতে চাই নোবেল জয়ী সাংবাদিকদের আমরা অভিনন্দন জানানোর শতভাগ যোগ্যতা রাখি। কারণ মামলা, হত্যা, নির্যাতন, চাকরি হারানোর ভয়, বেতন-ভাতা বঞ্চিত থেকেও আমরা নতুন-পুরাতন দুই গণমাধ্যমেই গণমানুষের কথা বলে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। অনুগ্রহ করে কচুরিপানা সরিয়ে স্বচ্ছ জল দেখুন। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
আপনার মতামত লিখুন :