অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন : ‘Four urgent steps to put students on track for successful learning’ এই শিরোনামে দেশের সেরা স্কলারদের লেখা একটি আর্টিকেল ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কারা লিখেছে? অধ্যাপক জাফর ইকবাল, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, অধ্যাপক কায়কোবাদ, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রমুখ। এই আর্টিকেলের প্রথম চার লাইন হলো: দেশের একদল বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রণীত নতুন কাররিকুলাম এবং শিক্ষার মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং একইসঙ্গে ২০২৩ সাল থেকে চালু হতে যাওয়া নতুন এই কাররিকুলাম ও পদ্ধতির সাফল্যের জন্য চারটি উপদেশমালা দিয়েছেন। ডঙড শিক্ষাবিদরা। ডঙড। মন্ত্রণালয়কে এভাবে প্রশংসা করে এরকম তোষামোদি মার্কা লেখার পর আমার মতো চুনোপুঁটির কনসার্ন কি আর ধোপে টিকবে? আমি যাহাই বলি না কেন সেটা হবে অরণ্যে রোদন। এই বাংলাদেশে কেবল আমার স্ত্রী আমার কনসার্নকে সম্পূর্ণ বুঝতে পেরেছে এবং সম্পূর্ণ একমত। তাছাড়া আমার লেখালেখির কারণে কিছু শিক্ষার্থীও মনে হয় বিষয়টা বুঝতে পেরেছে। তবে আনন্দের ব্যাপার হলো কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আজকে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত সুন্দর করে বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন বলেই এতো সুন্দর একটি স্টেটাস লিখতে পেরেছেন। দেশসেরা শিক্ষাবিদরা মন্ত্রণালয় প্রণীত নতুন কাররিকুলামে কোনো সমস্যা দেখেননি। দেখেছেন কিছু চ্যালেঞ্জ। চারটি সুপারিশ হলো সেই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলার জন্য।
লেখাটি পড়লে মনে হয় নবম দশম শ্রেণি থেকে উচ্চতর গণিত উঠিয়ে দেওয়া ঠিক হয়েছে। লেখাটি পড়লে মনে হয় নবম দশম শ্রেণিতে আগের এক তৃতীয়াংশ পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও রসায়ন নিয়ে একটি বিজ্ঞান বিষয় রাখা ঠিক আছে। তাদের লেখাটি পড়লে মনে হয় নবম দশম শ্রেণি পড়ালেখাকে স্কিল এবং প্রযুক্তি শেখা ভিত্তিক করাই ঠিক আছে। তাদের লেখাটি পড়লে মনে হয় ১০টি বিষয় পড়লেও ৫টি বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়াই খুব সুন্দর সিদ্ধান্ত। তারা খুশি যে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ উঠিয়ে দিয়ে সবাইকে তখন থেকে একই বিষয় পড়তে বাধ্য করা হবে। এই উঠিয়ে দেওয়াকেই তারা ইউনিফর্ম শিক্ষা ভাবছেন। কি বলে এবং কি ভাষায় তাদের ভর্তসনা করলে ঠিক হবে বুঝতেছি না। দেশ সেরা শিক্ষাবিদরা যদি এরকম লেভেলের তোষামোদি করে তাহলে দেশ নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। তার মানে এসএসসিতে এসব পড়ে যখন উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞান শাখায় পড়তে যাবে তখন শিক্ষার্থীদের কি হবে ভেবে আমার এখনই কান্না পায়। এতোদিন গিনিতে অলিম্পিয়াড ও ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা দারুণ করছিলো। সেসব এখন ইতিহাস হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়েও আমরা পদার্থবিজ্ঞান পড়া বা বোঝার জন্য যথেষ্ট ভালো মানের শিক্ষার্থী পাবো না।
আমিতো এই বিষয়ে আমার মতামত দিয়ে অনেকগুলো লেখা ইতিমধ্যেই লিখেছি। নিচে ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমার ছোট ভাই এবং বন্ধু আলতাফ হোসেন রাসেলের (Altaf Hossain Russell) লেখাটি সকলের জন্য শেয়ার করছি। ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল সংকট আমলাতান্ত্রিক ও সা¤প্রদায়িক প্রভাব, একটির সঙ্গে অন্যটি যেন পরম আত্মীয়তায় জড়িয়ে গেছে। ২০০৯ সালের আগে প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনটা ছিলো, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূল ধারায় আনার। সেখানে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপে নতুন সিলেবাস উল্টো বিজ্ঞান শিক্ষাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিলো। সূক্ষভাবে খেয়াল করলে দেখবেন, এই ধাবৎধমব শিক্ষায় মাদ্রাসার মতো জগাখিচুরি মার্কা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভরে যাবে। বর্তমান সিলেবাসে সাইন্সের একজন ছাত্র যে মাত্রায় বিজ্ঞান, বিশেষত গাণিতিক বিজ্ঞান পড়ে তাতেই উন্নত বিশ্বে পিএইচডি করতে গেলে এমনকি অর্থনীতির মতো সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়েও হিমশিম খেতে হয় ‘এখানে বলে রাখা ভালো, আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে অর্থনীতি এখনscience stream এ পড়ানো হয়, মানে মানবিকে বিজ্ঞানের আধিপত্য বেড়ে যাচ্ছে’। এখন যদি নতুন সিলেবাসে সেই বিজ্ঞানকে আরও কমানো হয় তাহলে অবস্থা কি দাঁড়াবে? সরকারি কর্মকর্তাদের সমস্যা খুব বেশি হবে না, কারণ তারা সরকারি টাকায় বিদেশ থেকে একপ্রকার ডিগ্রি কিনে আনতে পারবে। এমন কি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় Business Perspective থেকে কোনো প্রকার একটা ডিগ্রি দিয়ে দেবে।
উন্নত দেশেও তৃতীয় বিশ্বের লুটেরা অর্থ থেকে মুনাফা করার জন্য অনেক ফাঁক রেখে দেয়, এই ফাঁক দিয়ে শুধু অর্থটা আটকে রাখে, ডিগ্রিটা ছেড়ে দেয়। কিন্তু যারা afford করতে পারবে না, তারা ডিগ্রি করতে পারবে না। এটা তো নতুন কোনো কথা নয় যে, বিজ্ঞান থেকে ছাত্ররা যেকোনো সময় মানবিকে যেতে পারে, উল্টোটা যেকোনো সময় সম্ভব নয়। তাহলে সেই নীতিতে basement টা তো বেশি করে বিজ্ঞানভিত্তিক হতে হবে। যে দেশে ভালো ছাত্ররা গণিত বিষয়ে পড়তে চায় না ‘অন্য দেশে শুধু বিখ্যাত ছাত্ররা গণিত পড়ছে তা নয়, কিন্তু তারা তাদের স্ব স্ব বিষয়ে গণিত গুরুত্ব দিয়ে পড়ে’, শিক্ষাবিদরা শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে পারছে না ভাবছে আমলারা, বিশেষ এজেন্সির দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি পেয়েও সরকারি কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে দেয়, বিসিএসের সব শেষ চয়েস শিক্ষা, সেখানে এই শিক্ষাকে বাঁচাবেন কী করে। যেখানে দেশের অর্থনৈতিক বা সামগ্রিক উন্নয়নটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার কথা ছিলো, তা না হয়ে সেখানে উল্টো আমাদের শিক্ষার অধঃপতনটাই অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়েছে। এই অধঃপতন একসময় রাজনীতিবিদদের নজরদারিতে থাকলেও এখন আর তা নেই, আমলারা এর জিম্মাদারি করছে। সমস্যাটা সব পক্ষ থেকেই হচ্ছে, একদিকে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্র,অন্যদিকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের বহুমাত্রিক রুচির পরিবর্তন, দীর্ঘদিনের উল্টো থেরাপিতে ভালোটা গ্রহণ করার রুচিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে পৃথিবী বিখ্যাত একজন প্রভাবশালী চিন্তক নোয়াম চমস্কি খুবই প্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন। সে বিষয়ে বিস্তারিত আর বললাম না। শুধু বলি, সরকার, রাজনীতি ও প্রশাসনের সবচেয়ে আলোচিত হস্তক্ষেপের বাইরে থাকা সর্বোচ্চ মেধাবীদের একটি প্রতিষ্ঠান যেমন বুয়েটও কিন্তু বিশ্ব র্যাংকিং এ ভালো অবস্থানে থাকতে পারছে না। আমার জানামতে, এখনো বুয়েট মেধা ক্রম অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ দেয়। এখানে একটা তবে আছে, তারা তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে এটা মেইনটেইন করে। কিন্তু মৌলিক বিজ্ঞানের শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের মান-মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। সে কারণে বুয়েটেও গণিতসহ মৌলিক বিজ্ঞানের ভালো শিক্ষক থাকে না। ঢাবির গণিতের মেধাবী ছাত্র নিজের বিভাগে সুযোগ পেলে সে বুয়েটের গণিতে শিক্ষকতা করতে যাবে না, কিছু ব্যতিক্রম বাদে তাকে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব নিয়ে থাকার অবস্থা হবে। এমনটি কি পৃথিবীর কোথাও দেখা যাবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ এই সংকীর্ণ রাস্তায় হেঁটেছে অনেক দূর। বুয়েটও প্রযুক্তির practice যে বিজ্ঞান সেটা ঢ়ৎধপঃরপব করে না। এখানে সরকারের কোনো দায় নেই, বুয়েটে মেধাবী ছাত্র ও শিক্ষকের অভাব নেই, পৃথিবী বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি করা শিক্ষকেরও অভাব নেই। অভাব হচ্ছে, মেনে নেওয়ার যে আবিষ্কারটা হচ্ছে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিটা কাঠামো বাস্তবায়ন। মৌলিক বিজ্ঞান ছাড়া ডাক্তারি পড়ে যেমন নার্স হওয়া যায় তেমন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে টেকনিশিয়ান হওয়া যায়। সেটা কি এতো বিদেশ ফেরত শিক্ষক ও গবেষকরা জানেন না? অবশ্যই জানেন, কিন্তু তাতে যে অর্থের হিসেবে লাভ নেই। সরাসরি সরকারের প্রচুর গবেষণা অনুদান না থাকলেও শিক্ষকদের বিভিন্ন বৈধ উপায়ে আয় কিন্তু একেবারে কম নয়। তারা মানে আমরা কেউ উপরে উঠতে চাই না। একপক্ষ অন্যপক্ষে দোষারোপ করছে। দেশে গবেষণা নেই, কিছু মানুষ গবেষণা করলেও দেখা যায় তাদের সিংহভাগ প্রকৃত গবেষক নয় বরং প্রকাশনা শিকারী। এ এক দীর্ঘ কাহিনী, অন্য লেখায় বলবো। ইউটিউবে ঢুকলে ভারতেরও অনেক সা¤প্রদায়িক চ্যানেল পাওয়া যায়। কিন্তু পাশাপাশি তাদের অনেক একাডেমিক জনপ্রিয় চ্যানেল আছে। আমার জানামতে অহেতুক কিছু মোটিভেশনাল স্পিকার ছাড়া বাংলাদেশের ভালো মানুষ ও ভালো একাডেমিক কাজের কোনো জনপ্রিয় চ্যানেল নেই। ভারতের জনতার সঙ্গে আমাদের জনতার সাংস্কৃতিক মান একেবারে খারাপ নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালোও। কিন্তু ভারতের মেধাবী ছাত্রদের সঙ্গে আমাদের মেধাবী ছাত্রদের সাংস্কৃতিক অবস্থার তুলনা করলে আমরা অনেক পিছিয়ে। তাদের অন্তত সর্বোচ্চ শিক্ষিতরা আমাদের সর্বোচ্চ মেধাবীদের মতো অন্ধকার ছড়ায় না। - Altaf Hossain Russell। লেখক : শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়