খালিদ আহমেদ : [২] শনিবার (০২ অক্টোবর) সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর স্ত্রী নাসিমা এ কথা বলেন।
[৩] সে সময় মধ্যবয়সী এ নারীর পরনে ছিল অর্ধেক মুখ ঢাকা ঐতিহ্যবাহী রাখাইন পোশাক। কিছুক্ষণের মধ্যে বড় মেয়ে শামীমা তার সঙ্গে যোগ দেন। শোকাহত মা-মেয়ের চোখে-মুখে ছিল ভয়।
[৪] নাসিমা জানান, বন্দুকধারীদের মধ্যে তিনি ৩ জনকে দেখতে পেয়েছিলেন। তারা বয়সে তরুণ। পরনে ছিল লুঙ্গি। তাদের মুখ ঢাকা ছিল না।
[৫] নাসিমা বলেন, ‘আমি তাদের কাউকে চিনি না, তারা বন্দুক চালাচ্ছিল।’
[৬] ১৯৭৪ সালে জন্ম নেওয়া মুহিব ছিলেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান। বুধবার রাত সাড়ে ৮ টার দিকে তার কার্যালয়ের ভেতরে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
[৭] ৩০ ফুট বাই ১০ ফুটের ওই কার্যালয়টি মুহিবের বাসা থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে। শুক্রবার সেটি তালাবদ্ধ ছিল।
[৮] ওই ভয়াবহ সন্ধ্যার কথা স্মরণ করে নাসিমা জানান, রাতের খাবার শেষ করার পর মুহিবের কিছু অনুসারী তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তারা তার সঙ্গে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন।
[৯] মুহিব তখন তার অনুসারীদের বলেছিলেন যে, ভালো দিন আসছে। প্রত্যাবাসনের কাজ দ্রুত শুরু হতে পারে। প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে যাওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে।
[১০] এরপর কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মুহিব তাদের কার্যালয়ের দিকে যেতে বলেন।
[১১] ‘এর পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি গুলির শব্দ শুনতে পাই। মনে হচ্ছিল এটা মেইন রোডের দিক থেকে এসেছে (বাসা থেকে প্রায় ১০০ ফুট দূরত্বে),’ বলেন নাসিমা।
[১২] মুহিবের ১৮ বছরের মেয়ে শামীমা তখন ঘরের বাইরে গিয়ে দেখতে পান মানুষজন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে।
[১৩] শামীমা জানান, এরপর তিনি তার বাবার অফিসের দিকে যান। কাছাকাছি পৌঁছাতে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি তাকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়।
[১৪] শামীমা বলেন, ‘উঠে দাঁড়িয়ে আমি অফিসে ঢুকে দেখি মেঝেতে লুটিয়ে থাকা বাবার শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমি তার মাথা তুলে ধরি। তখন তার মুখ খোলা ছিল। চোখ দুটি ছিল বন্ধ।’
[১৫] মুহিবের স্ত্রী নাসিমা জানান, তার স্বামীর সঙ্গে ১০ থেকে ১২ জন লোক ছিল। কিন্তু বন্দুকধারীরা গুলি শুরু করতেই তারা পালিয়ে যান।
[১৫] অভিযোগ করে নাসিমা বলেন, হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পরেও মুহিবকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তার কোনো অনুসারীই এগিয়ে আসেনি।
[১৬] মুহিবের এই বিশ্বাস ছিল যে, কোনো রোহিঙ্গা কখনো তার ক্ষতি করবে না- এমন মন্তব্য করে নাসিমা বলেন, ‘নিজ জনগোষ্ঠীর মানুষের প্রতি তার আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। কারণ তিনি সারাজীবন তাদের জন্য লড়াই করেছেন।’
[১৭] মুহিব ছিলেন একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। তিনি মিয়ানমারের আকিয়াব কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। নাসিমার ভাষ্য, মুহিব নিজের পরিবারের চাইতে তার গোষ্ঠীর মানুষের জন্য বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। এসেছি আকিয়াব নামের একটা শহর থেকে। মুহিব উচ্চশিক্ষার জন্য আকিয়াবে আসার পর সে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসে। পরে আমাদের বিয়ে হয়।’
[১৮] মিয়ানমারেও মুহিব রোহিঙ্গাদের নেতা ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে আসার পর তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পান।
[১৯] নাসিমা বলেন, ‘আমার পরিবারের কোনো সদস্য কিংবা তার (মুহিব) ভাইয়েরা নেতা হওয়ার যোগ্য নন। এ ক্ষেত্রে আমিও কোনো ভূমিকা নেব না।’
[২০] এ কথার সূত্র ধরে মুহিবের মেয়ে শামীমা বলেন, ‘নিরাপত্তা ছাড়া আমরা কিছুই চাই না। আমি আমার পরিবারের নিরাপত্তা চাই। আমরা বিচার চাই না। আমি চাই আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ হোক।’
[২১] ফিরে আসার সময় প্রতিবেদকরা দেখতে পান, বাবার খোঁজে মুহিবের ৮ বছরের শিশুকন্যা আফনান তার অফিসের ভেতর উঁকি দিচ্ছে। মানসিক প্রতিবন্ধী এ শিশুর জিজ্ঞাসা, ‘আমার বাবা কোথায় গেছে? কখন আসবে?’ সম্পাদনা : ভিকটর রোজারিও