শিরোনাম
◈ রাজধানীতে ককটেল তৈরির গোপন ঘাঁটি আটক, পুলিশ বলছে টার্গেট ছিল ১৭ নভেম্বর ◈ নারী কাবাডি বিশ্বকাপে অংশ নিতে ঢাকায় ভারত ও জাঞ্জিবার দল ◈ কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ৩ জানুয়ারি ◈ বাংলাদেশকে বিধস্ত ক‌রে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে পাকিস্তান ◈ রাতে আন্তর্জা‌তিক প্রী‌তি ম‌্যা‌চে আর্জেন্টিনার লড়াই, প্রতিপক্ষ অ্যাঙ্গোলা ◈ সব ব্যাংককে সতর্কতা: প্রার্থীর ঋণ-তথ্য সঠিকভাবে সিআইবিতে হালনাগাদ করতে হবে ◈ যুবদের আত্মরক্ষা প্রশিক্ষণে সরকারের ২৮ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন ◈ দ‌ক্ষিণ আ‌ফ্রিকার টোয়েন্টিতে আরও ভারতীয় ক্রিকেটার চান গ্রা‌য়েম স্মিথ  ◈ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ২ দাবি না মানলে কলম বিরতির হুঁশিয়ারি বিচারকদের ◈ নারীদের বাদ দিয়ে উন্নয়নের চিন্তা করা ভুল: সেনাপ্রধান

প্রকাশিত : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ০৯:১৬ সকাল
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১০:৫৬ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অসাধু আইপিটিভি: সাংবাদিকতার নামে চাঁদাবাজি !

ডেইলি স্টার: গাবতলী বাস টার্মিনালের ঠিক উল্টো পাশে, দুইটা বাস কাউন্টারের মাঝে লুকিয়ে থাকা জরাজীর্ণ নীল রঙের দালানটি এক অখ্যাত হোটেল। সরু একটি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় হোটেলটির কামরাগুলোয়। ন্যুনতম সুবিধা ছাড়া এখানে কিছুই পাওয়ার গতি নেই।

এ ধরনের হোটেলগুলো যৌনকর্মীদের পছন্দের জায়গা হিসেবে বিবেচিত, আর স্বভাবতই, এসব জায়গায় পুলিশি অভিযান এবং চাঁদাবাজির ঝুঁকি বেশি থাকে।

তবে হোটেলের নিয়মিত চাঁদাবাজদের মধ্যে রয়েছে একদল মানুষ, যারা সাধারণত চাঁদাবাজির জন্য খুব একটা পরিচিত নয়। তারা হলেন একদল স্বঘোষিত সাংবাদিক।

হোটেলের ম্যানেজার একজন মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক। তিনি তার জামার পকেট থেকে একগাদা বিজনেস কার্ড বের করলেন।

নিজের ও হোটেলের নাম প্রকাশ না করার শর্তে ম্যানেজার বললেন, 'পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী ওই স্বঘোষিত সাংবাদিকরা ২০০ থেকে ৫০০ টাকা দাবি করেন। সম্পাদকদের ১০০০ টাকা দিতে হয়। প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১০ বার তারা আমাদের এখানে আসেন। আমি যদি তাদের টাকা না দেই, তাহলে তারা অভিযান চালানোর জন্য পুলিশকে ডেকে আনবে। তারপর তারা অভিযানের ভিডিও করে তা প্রচার করবেন।'

এই তথাকথিত প্রতিবেদক ও সম্পাদকদের অনেকেই একটি নতুন ধরনের গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত। অনলাইন টিভি চ্যানেল নামে পরিচিত এই মাধ্যম একটা অতি সাধারণ সার্ভার ব্যবহার করে তাদের অনুষ্ঠানগুলো প্রচার করে, যা তাদের ওয়েবসাইট অথবা ডেডিকেটেড স্ট্রিমিং অ্যাপ ও স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেখা যায়।

মানুষের মুখে মুখে এগুলো আইপিটিভি নামে পরিচিত। এই নামকরণের পেছনে রয়েছে তাদের ব্যবহৃত 'আইপি' বা ইন্টারনেট প্রটোকল প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে তারা তাদের অনুষ্ঠানগুলো সম্প্রচার করে থাকে।

এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জোর দিয়ে বলবেন, এসব অনলাইন টিভি চ্যানেলের আয়ের মূল উৎস হচ্ছে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর করা অনুষ্ঠান এবং অনেক ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি।

আইনত, আইপিটিভি চ্যানেলে সংবাদ সম্প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা-২০১৭ (২০২০ সালে পরিমার্জিত) তে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, আইপিটিভি শুধুমাত্র বিনোদনমূলক অথবা তথ্যবহুল অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারবে।

তবে কয়েক সপ্তাহ এই চ্যানেলগুলো দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন, বেশিরভাগ আইপিটিভি ও অনলাইন চ্যানেলগুলো সুস্পষ্টভাবে এই আইন লঙ্ঘন করছে।

বেশ কিছু আইপিটিভির অনুষ্ঠানসূচির একটি বড় অংশ জুড়ে থাকে 'সংবাদ'। কিছু চ্যানেলে দিনে বেশ কয়েকবার সংবাদ প্রচারিত হয়। সংবাদপাঠক-পাঠিকা, স্টুডিও ও বুম মাইক্রোফোন সহ সংবাদদাতাও ব্যবহার করে তারা।

যেভাবে আইপিটিভি পরিচালিত হয়

এ ধরনের চ্যানেলগুলোর আয়ের মডেল মূলত 'সংবাদদাতা ভিত্তিক ব্যবসা'র ওপর নির্ভরশীল বলে নিশ্চিত করেছেন একাধিক আইপিটিভি মালিক। তবে তারা প্রত্যেকেই জোর দিয়ে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তারা সহকর্মীদের প্রতিহিংসার হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

'সংবাদদাতা ভিত্তিক ব্যবসা' আসলে কী? এটি হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠানের সংবাদদাতাদের ব্যবহার করে সংবাদ ও বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করার বিষয়টি, যা প্রায়ই অন্য কোন সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় করা হয়। এই পুরো কাজটি করা হয় অনানুষ্ঠানিকভাবে এবং এখান থেকে সংবাদদাতারা লাভের ভাগ পেয়ে থাকেন।

অনেকসময় সংবাদদাতারা কোনো বিষয়ে সংবাদ প্রচারের জন্য কোন একটি মহলের কাছ থেকে টাকা পান। তারপর তারা সংবাদটি সম্প্রচার করার জন্য সম্পাদকদের টাকার ভাগ দেন।

এধরনের সবগুলো প্রতিষ্ঠানই সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন জন কর্মী দিয়ে চালানো হয়, যাদের মধ্যে সাধারণত একজন সম্পাদক থাকেন। তবে তারা প্রায়ই উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ফ্রিল্যান্স সংবাদদাতা নিয়োগ দেন। তাদের কাছে বিজনেস কার্ড ও প্রেস কার্ড থাকে, কিন্তু চুক্তিবদ্ধ না হওয়াতে তারা শুধু প্রয়োজনমাফিক কাজ করেন। প্রায় ৬০০ চ্যানেল কার্যকর থাকলেও এ ধরনের 'সাংবাদিকের' প্রকৃত সংখ্যা কত, তা জানার কোন উপায় নেই। তবে বাস্তবতার নিরিখে আন্দাজ করা যায়, তাদের সংখ্যা কয়েক হাজার হতে পারে।

অনুমোদিত মূলধারার প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্পনসর্ড কন্টেন্টের ক্ষেত্রে বিভিন্ন তকমা থাকে, যেমন 'সহযোগিতায়', 'স্পন্সর করেছেন', অথবা 'পাওয়ার্ড বাই', ইত্যাদি। কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলোকে আলাদা ক্রোড়পত্র হিসেবে প্রকাশ করা হয়। স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

বিভিন্ন আইপিটিভির ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের সংবাদদাতাদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না এবং তারা কীভাবে আয় করবেন, সেটা তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়।

একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও আইপিটিভি চ্যানেল 'আলিফটিভি'র সত্ত্বাধিকারী জামাল উদ্দিন জামান বলেন, 'আমার আগে সংবাদদাতা ছিল, এখন আর নেই। কারণ তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে আমরা সংবাদ প্রচার করতে পারব না। যেহেতু আমার কোনো আয় নেই, আমি সংবাদদাতাদের পারিশ্রমিক দিতে পারছি না।'

তার মিরপুরের অফিসে বসে জামান আরও বলেন, 'সংবাদদাতারা আমার সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। যদি তারা কোনো সংবাদ প্রচারের জন্য আমার কাছে তদবির করেন, তাহলে আমি তাদের অনুরোধ রক্ষা করি।'

মিরপুরে যে ভবনে তার অফিস এর বাইরে-ভেতরে কোনটাই রং করা হয়নি এখনো এবং সিঁড়িগুলো নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে। পাঁচ তলা দালানের বাকি তলাগুলো নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

আলিফটিভির অফিস একই সঙ্গে বিজ্ঞাপন স্টুডিও এবং প্রোডাকশন হাউজ হিসেবেও কাজ করে। জামাল জানান, 'আমার একজন প্রডিউসার আছে এবং একজন ডিরেক্টর আছে, যিনি একই সঙ্গে ক্যামেরাম্যান ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। আমার দুজন সংবাদ পাঠক অন্য জায়গায় স্থায়ী চাকরি করেন এবং এখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। তাদের একজন ব্যাংকে কর্মরত।'

তার আয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে জামাল জানান, 'আমি শুধুমাত্র নাটক ও বিজ্ঞাপন থেকে আয় করি।'

তিনি এটা প্রমাণ করার জন্য ব্যাগ থেকে একগাদা লিফলেট বের করেন।

আলিফটিভির ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সংবাদদাতা উবায়দুল্লাহ রুমি ব্যাখ্যা করেন কেন তিনি বিনা পারিশ্রমিকে প্রতিষ্ঠানটির জন্য কাজ করছেন। তিনি বলেন, 'আমি এখনো শিখছি। আমাকে বলা হয়েছিল আমি কিছু সম্মানী পাবো, কিন্তু এখনো আমি সেটি পাইনি। অন্য কোনো আইপিটিভিতে সংবাদদাতা হিসেবে যোগ দিতে গেলে তাদেরকে টাকা দিতে হতো। কিন্তু আলিফটিভিকে আমার কোনো টাকা দিতে হয়নি।'

বেশিরভাগ আইপিটিভির ক্ষেত্রে সংবাদ অনুষ্ঠানের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে থাকে প্রচারণামূলক জনসংযোগ কন্টেন্ট।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজনৈতিক প্রার্থী ও দলের সদস্যদের ব্যক্তিগত অর্জনকে ফলাও করে প্রচার করা হয়, যেমন কম্বল বিতরণের মতো ছোট অনুষ্ঠান অথবা সরকারের ভিজিএফ প্রকল্পের চাল বিতরণের সংবাদ।

একটি অনলাইন টিভিতে গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রচারিত ভিডিওতে শোনা যায়, 'আমি হাজী মো. মোক্তার হোসেন, তারানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী। আমাদের আগে কোনো সড়ক ছিল না। আমি দুটি সড়ক নির্মাণ করেছিৃ।'

একঘেয়ে কণ্ঠে পুরো ১২ মিনিট ধরে মোক্তার হোসেন এলাকায় তার বিভিন্ন উদ্যোগের ব্যাপারে বলে যান।

গাবতলীর সেই হোটেলের রিসেপশন ডেস্কে এই টিভির বিজনেস কার্ডও পাওয়া গেছে। কিন্তু আমরা এই তথ্যের সূত্রকে সুরক্ষিত রাখার জন্য টিভি চ্যানেলের নাম প্রকাশ করছি না।

ইউটিউবে চ্যানেলটির প্রায় ৫৬ হাজার সাবস্ক্রাইবার আছে। টিকাটুলির হাটখোলা সড়কে তাদের একটি অফিসও আছে। চ্যানেলে মোক্তারের ভিডিওর মতো অসংখ্য ভিডিও আপলোড করা হয়েছে। দীর্ঘ, ব্যক্তিগত সাক্ষাতকারগুলোকে আত্মপ্রচার ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

একইভাবে আলিফটিভির উবায়দুল্লাহ রুমী'র বেশিরভাগ বাইলাইনে স্থানীয় প্রতিনিধিদের আয়োজন করা কোন অনুষ্ঠান বা কার্যক্রমের জনসংযোগ বার্তা, যেমন ইউএনওর বিদায়ী অনুষ্ঠান অথবা খাদ্য ও মাছের পোনা বিতরণ, ইত্যাদি।

উবায়দুল্লাহ দাবি করেন, 'আমি ইতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করে মানুষকে ইতিবাচক কাজে উদ্বুদ্ধ করি।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের মতে, বিনা বেতনের সংবাদদাতা ও স্পন্সর্ড কন্টেন্টের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাবে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে।'

উদাহরণ হিসেবে জেএ টিভির একটি ঘটনার কথা বলা যায়। জেএ টিভি ২৩ জুন, ২০২১ এ দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে নিয়ে ৩ মিনিটের প্রতিবেদন প্রচার করে, তখন স্কুল থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রধান শিক্ষক আব্দুল মোতালেব বাবু মাস্টার ছাত্রদের কাছ থেকে নিবন্ধন ফি হিসেবে মাথাপিছু ৪৫০ টাকা আদায় করেন। প্রধানশিক্ষক দাবি করেন এটি মহামারির সময়ের বকেয়া সেশন ফি।

প্রতিবেদনে বেশ কিছু স্থানীয় ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, যারা জানান এটি নিবন্ধন ফি নেওয়ার নামে চাঁদাবাজির ঘটনা। একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, প্রধান শিক্ষক তাকে বলেন, 'আপনি যদি ফিস দিয়ে মেয়েকে স্কুলে রাখতে না পারেন, তাহলে আপনার উচিত এমন কারো কাছে তার বিয়ে দেওয়া, যে এই ফিস পরিশোধ করতে পারবে।'

তবে প্রধান শিক্ষক জোর দিয়ে টেলিভিশন ক্যামেরায় বলতে থাকেন, সংগৃহীত টাকা সেশন ফির জন্য এবং তাকে একটি মহল জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদের জের ধরে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।

জেএ টিভির একজন প্রতিবেদক ঢাকা থেকে গিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে এই সমস্যাটি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেন। টিভির সম্পাদক কিবরিয়া চৌধুরী বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

প্রতিবেদনটি প্রচারিত হওয়ার পর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক আযম একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, প্রতিবেদকের অসাধু উদ্দেশ্য রয়েছে। তিনি বলেন, 'কোনো স্থানীয় সাংবাদিক তাকে চেনেন না। কোনো স্থানীয় সাংবাদিক এই সংবাদ প্রচার করেনি। এই সাংবাদিক ঢাকা থেকে এসে টাকার বিনিময়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।'

কিবরিয়া চৌধুরী এই অভিযোগ নাকচ করেন। তিনি বলেন, 'আমরা সব নিয়মকানুন মেনে চলেছি। আমি নিজে প্রধানশিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি স্থানীয়দের সবার সঙ্গে কথা বলেছি। আমি সেখানে একজন প্রতিবেদক পাঠিয়েছি কারণ স্থানীয় সংবাদদাতারা সব সময় এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেন না'

অফিস থেকে প্রতিবেদকের যাতায়াতের খরচ বহন করা হয়েছে কী না, জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান।

আইপিটিভি সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সবার নজরে আসে হেলেনা জাহাঙ্গীর নামের একজন ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হওয়ার পর। তার বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগের একটি ছিল জয়যাত্রা টিভি নামের একটি চাঁদাবাজি-নির্ভর আইপিটিভি পরিচালনা করার অভিযোগ।

একটি নীরব ডিজিটাল বিপ্লব

সকল আইপিটিভি লাইসেন্সবিহীন। তথ্য মন্ত্রণালয় নিবন্ধনের আহ্বান জানানোর পর বেশ কয়েকটি চ্যানেল লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে। তবে মন্ত্রণালয় গত চার বছর ধরে তাদের আবেদনের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত জানায়নি।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (টিভি-২) সুলতানা রাজিয়া বলেন, এই মুহূর্তে মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদনের অপেক্ষায় ৬০০টি আইপিটিভি আবেদনপত্র রয়েছে।

জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা-২০১৭ তে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, কোন গণমাধ্যম তার সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে লাইসেন্স না নিয়ে পরিচালিত হতে পারবে না। এই সংবাদদাতা যতগুলো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেন, তারা সবাই জানান, তারা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন এবং কয়েক মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছর ধরে তারা সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।

জেএটিভি ও আলিফটিভি উভয়েই পরিচালনার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে বলে দাবি জানায়।

তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ মঙ্গলবারে জানান, মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে আইপিটিভির নিবন্ধন করে এই অনিয়ন্ত্রিত খাতে শৃঙ্খলা নিয়ে আসা।

তবে তথ্য মন্ত্রণালয় লাইসেন্স নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই গত রবিবারে বিটিআরসি বৈধ লাইসেন্স না থাকার অভিযোগে ৫৯টি আইপিটিভি বন্ধ করে দিয়েছে।

তথ্য মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে বা তাদের সঙ্গে কোন ধরনের আলোচনা না করেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে বিটিআরসি, নিশ্চিত করেছেন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা।

মন্ত্রী জানান, মন্ত্রণালয় থেকে শুধুমাত্র আইপিটিভি'র নিবন্ধন করা হয়, কিন্তু তারা বিটিআরসি'র কাছ থেকে ডোমেইন বরাদ্দ পান। 'এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কীভাবে ডোমেইন বরাদ্দ পেলো? আমার মতে এখন থেকে ডোমেইন বরাদ্দ দেওয়ার আগে তাদের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ', জানান মন্ত্রী।

আইপিটিভি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরুল কায়সার দাবি করেন, প্রথম আইপিটিভি চ্যানেলের প্রচার শুরু হয় ২০১১ সালে। 'আমি বাংলা২১টিভি ডোমেইন কিনি এবং পরে জাগোবিডি লঞ্চ করি', বলেন তিনি। এই মুহূর্তে দেশে টিভি চ্যানেল স্ট্রিম করার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলোর অন্যতম জাগোবিডি।

তিনি দাবি করেন, 'আমাদের জাতীয় টিভি হচ্ছে প্রথম স্যাটেলাইট চ্যানেলে, যেটি ২০১৪ সাল থেকে ইন্টারনেট প্রটোকল প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের কন্টেন্টগুলো অনলাইনে স্ট্রিম করতে শুরু করে।' তারপর থেকে সকল স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো তাদের নিজ নিজ ইন্টারনেট স্ট্রিমিং সেবা শুরু করেছে।

এছাড়াও, মাত্র এক দশকের ব্যবধানে আইপিটিভির সংখ্যা এক থেকে প্রায় ৬০০তে পৌঁছে গেছে।

সকল অনিবন্ধিত গণমাধ্যমের আয়ের একমাত্র উৎস চাঁদাবাজি, উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া এরকম কথা বলা যুক্তিসংগত নয়। মূলধারার বাইরে থেকে ইন্টারনেট টেলিভিশনগুলো এমন সব দর্শকদের মনোরঞ্জন করছে, যাদেরকে প্রথাগত গণমাধ্যম এড়িয়ে যায়, এবং এভাবেই নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দেশে এক ডজনেরও কম মানুষ আছেন, যারা পেশাদার ভিত্তিতে আইপিটিভি চ্যানেল চালু করে সেটার সার্ভার ও স্ট্রিমিং সেবা পরিচালনা করতে পারেন।

'আইপিটিভি টেকমাস্টার' নামে পরিচিত নাজমুল হাসান একটি চমকপ্রদ ভিডিও তৈরি করেছেন, যার শিরোনাম '২০ হাজার টাকায় আইপিটিভি চালান।'

তিনি ব্যাখ্যা করেন, 'বস্তুত আপনার একটি ভালো মানের কম্পিউটার এবং ভাল ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন হবে।'

হাসান জানান, এরপর কিছু সফটওয়্যার ইন্সটল করতে হবে, যার মধ্যে এনকোডিং, সুইচিং ও স্ট্রিমিং এর সফটওয়্যার অন্তর্ভুক্ত। তারপর আপনার প্রয়োজন হবে স্ট্রিমিং সার্ভার, যেখানে আপনি পিসি থেকে কন্টেন্ট পাঠাবেন। স্ট্রিমিং সার্ভার আপনার ওয়েবসাইট ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে কন্টেন্ট দেখাবে।

তিনি জানান, 'আপনার যদি একটি কম্পিউটার থাকে, তাহলে সব মিলিয়ে আপনাকে ৫০ হাজার টাকা খরচ করতে হবে সেটিকে প্রস্তুত করার জন্য। সার্ভার স্পেসের জন্য আপনাকে মাসে ২০ হাজার টাকা করে খরচ করতে হবে।'

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস আইপিটিভির কারণে গণমাধ্যমের কলেবর বাড়ার বিষয়টির প্রশংসা করেছেন। তিনি আরও বলেন, 'মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু এই স্বাধীনতার সঙ্গে আসে একটি নৈতিক গণমাধ্যম হবার দায়িত্ব।'

সিনিয়র সাংবাদিক আমানুল্লাহ মন্তব্য করেন, সাংবাদিকতার সঙ্গে সব সময়ই চাঁদাবাজির যোগসূত্র ছিল। 'এখন শুধুমাত্র এর রূপের পরিবর্তন হয়েছে', বলেন তিনি।

তিনি আরও জানান, পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে নৈতিকতা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখতে হবে। সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রেও তাকে এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে।

'যদি সাংবাদিক তার নৈতিকতা বজায় রাখতে না পারেন, তাহলে মিথ্যা সংবাদ থেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে, যা আজকের দুনিয়ায় অহরহ হচ্ছে', বলেন আমানুল্লাহ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়