আফরোজা সরকার: উত্তর অঞ্চলে মূলত দারিদ্র্যপীড়িত ও দরিদ্র্রের হার অনেক বেশি। একটি সংসারে যে পরিমাণ ব্যয় করতে হয়, তা একজন পুরুষের একারপক্ষে মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রীরাও কাজে অংশ নিয়েছেন । তবে এই বিষয়টি বিশেষজ্ঞরা পজিটিভ দিক বলে মনে করছেন। তারা মনে করছেন, নারীদের কর্মসংস্থান তৈরি পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বীও হয়েছে।
অন্যদিকে রংপুরের প্রান্তিক এলাকাগুলোতেও প্রতিটি ঘরে রয়েছেন শ্রমজীবী নারী। এই অঞ্চলে এখন ধীরে ধীরে কর্মজীবনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। শহরের তুলনায় গ্রামে বিভিন্ন পেশায় নারীর অংশগ্রহণও বর্তমানে হুহু করে বেড়ে চলছে।
মরিয়ম নামে এক গৃহিনী ইউমেঅআইকে জানান, ক্যাম্প ও আশপাশের কিছু কাপড় ব্যবসায়ী শোরুম মালিকদের কাছ থেকে পুঁতি, পাথর ও চুমকিসহ পোশাক কারুকাজের বিভিন্ন উপাদান এনে তাদের কাছে সরবরাহ করেন। তারা শুধু সেসব দিয়ে শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিচ, ওড়নায় নতুন নতুন ডিজাইনের কারুাজ করেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন শাড়ি ও পোশাকের জন্য বিভিন্ন মজুরি আছে। আবার কাজের তারতম্যের ওপরও মজুরি কমবেশি হয়ে থাকে বলেও জানান তিনি।
একটি সুতি শাড়িতে কাজ করলে ১৫০ থেকে ২শ’ টাকা পাওয়া যায়। আবার জরজেট শাড়িতে কাজ করলে ৩শ’ টাকা পাওয়া যায়। তবে কাতান শাড়ির মজুরি এক হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। লেহেঙ্গা ও থ্রিপিচের কাজের মজুরি নির্ভর করে কাপড়ের মানের ওপর।
রংপুরে রয়েছে অনেক মধ্যবয়সী নারী মনোয়ারা বেগম। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার বালুয়াভাটা এলাকায় বাড়ি তার। স্বামী খোকন মিয়া বাসের চেইন মাস্টার দুই ছেলে নিয়ে তাদের সংসার। টানাপোড়েনের সংসারে চার বছর আগে স্বামী-স্ত্রী মিলে স্থানীয় নিজ বাড়িতে পোশাক কারখানার কাজ শুরু করেন এবং রংপুর ও সৈয়দপুর থেকে পোশাক এনে বাড়িতেই তা বিক্রি শুরু করেন। খেয়েপরে বড় ছেলরে ভার্সিটির লেখাপড়ার খরচ ছেট ছেলের পড়াশোনার খরচ সবে স্বামী স্ত্রী মিলে যোগান দেয়। তিনি স্বপ্ন দেখেন বড় ছেলে ডাক্টার গড়ার জন্য ডাক্তারি লাইনে পড়াশোনা করাচ্ছেন। আর ছোট ছেলে এবারে এসএসসি পরিক্ষার্থী। এইসবেই চলে স্বামী স্ত্রী দুজনেই কাজ করে। এখন আর আগের অভাব নেই তাদের ঘরে।
এক নারী ফাতেমা নাম বেগম শিল্পী । তিনিও কাজ করেন বদরগঞ্জ উপজেলার সাব রেজিস্টার আফিসে মাষ্টার রোলে। বিয়ে হয়েছিলেন দিনাজপুর জেলায়, স্বামী নেশাগ্রস্থ হওয়ায় এক সন্তানের মা হয়েও স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য হয়। ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়িতে বসবাস শুরু করেন, ছেলেকে বড় করা, লেখাপড়া খরচ সবকিছুই তাকেই করতে হচ্ছে । মষ্টার রোলে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নকল নবিশ এর কাজ করে। বর্তমানে ছেলে এইসএসসি তে পড়াশোনা । এখানে কাজ করে তার মাসে সর্বনিম্ন আয় ১০ হাজার টাকা। সে এখন স্বাবলম্বী হয়েছেন।
রংপুর বিভাগের কর্মজীবী অন্তত ৩০ জন নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় ইউমেনআই। তাদের সবার প্রায় একই কথা। সংসাবর ব্যয়বেশি আয় কম,একজনের উপার্জনের টাকা দিয়ে সংসার টানাপোড়েনের উপর দিয়ে চলায়, আমরা সংসারের অভাব-অনটন ঘোচানোর পাশাপাশি সচ্ছলতা ফেরাতে কাজ করেন তারা।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ যৌথভাবে এক গবেষণায় বলেছে, রংপুর বিভাগে নারী শ্রমিকের শতকরা হার ৩৮, যা দেশে সবচেয়ে বেশি।
রংপুরে নারীরা কৃষিতেও পিছিয়ে নেই। পুরুষের পাশাপাশি তাল মিলিয়ে এক সাথে কাজ করে যাচ্ছে। যেমন ধান কাটা, বীজ বোনা ও আলু উৎপাদনেও অনেক ভুমিকা রয়েছে নারীদের।
রংপুরে নারী শ্রমজীবী বেশি কেন?
রংপুর উইমেন্স চেম্বারের প্রেসিডেন্ট আনোয়ারা ফেরদৌসী পলি বলেন, বিভাগে সব জেলার পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই. তবে মনে হয় অন্যরাও বলেতে পারবে না।শুধু রংপুরেই ৫ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং নারী ব্যবসায়ী রয়েছেন। নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে। স্বল্প পুঁজি নিয়ে তারা ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন। পুরুষশাসিত সমাজে তারা কর্মক্ষেত্রে টিকে আছেন।
মাঠেঘাটে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা অবশ্যই ইতিবাচক। নারীর অনানুষ্ঠানিক কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হওয়া দরকার। তিনি বলেন, ‘আমি চাই কোনো নারী যেন বেকার না থাকেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। তাদের সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে একজনের দেখাদেখি অন্যরাও এগিয়ে আসবেন।
নারী শ্রমিকরা কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। রংপুর কারুপণ্য লিমিটেডের জনসংযোগ পরামশর্ক মাহবুব রহমান হাবু জানান, আমার কারখানায় ৪ হাজার নারী শ্রমিক কাজ করে।