শিরোনাম
◈ পূর্বাচল প্লট জালিয়াতি মামলায় সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫ বছরের কারাদণ্ড ◈ পূর্বাচল প্লট দুর্নীতির তিন মামলায় শেখ হাসিনার ২১ বছরের কারাদণ্ড ◈ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ, তবে তৃতীয় দেশে পাঠাতে চায় ভারত; যুক্তরাষ্ট্রে যেতে আগ্রহী শেখ হাসিনা ◈ জাতীয় নির্বাচনের আগে যে তিন চ্যালেঞ্জের মু‌খোমু‌খি বিএনপি ◈ বেহাল দশা লিভারপু‌লের, নি‌জের মাঠেই হে‌রে গে‌লো ডাচ ক্লাবের কাছে ◈ ব্রিটেনে ন্যূনতম মজুরি বাড়ল: আগামী এপ্রিল থেকে ঘণ্টায় বাড়বে সব বয়সের শ্রমিকদের আয় ◈ বায়ার্ন মিউনিখকে ৩-১ গো‌লে হারা‌লো আ‌র্সেনাল ◈ তারেক রহমান এখনও ভোটার নন, ডিসেম্বরে দেশে এসেই ভোটার হবেন: দলীয় সূত্র ◈ ফিফা নিষেধাজ্ঞা স্থগিত কর‌লো, বিশ্বকাপের শুরু থেকেই খেলতে পারবেন রোনালদো ◈ কেন বিবিসির বিরুদ্ধে ট্রাম্পের মানহানি মামলা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে

প্রকাশিত : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ০৩:৩৩ রাত
আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ০৩:৩৭ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

করোনা: বাল্যবিয়ের কারণে শিক্ষাঙ্গনে আর ফেরা হচ্ছে না তাদের

নিউজ ডেস্ক: চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার মিলি আখতার। লেখাপড়া শেষে চাকরি করে দরিদ্র সংসারের হাল ধরে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। সেই স্বপ্ন থেকেই গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল। সামনে পরীক্ষা- সেই ভাবনা থেকে প্রস্তুতিও ছিল ভালো। এখনও ঘরের কোনে টেবিলে থরে থরে সাজানো রয়েছে তার প্রিয় বই-খাতা। কিন্তু মিলির আর ক্লাসে যাওয়া হবে না। দেড় বছর পর স্কুল খুললেও মিলিকে থাকতে হবে শ্বশুরবাড়িতে। করোনাকালে পরিবার জোর করে তাকে বিয়ে দিয়েছে।

গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত চরাঞ্চল-ঘেঁষা মিলির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পশ্চিম ফুলমতি উচ্চ বিদ্যালয়ের এমন আরও ১৫ কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে, এ জেলার শুধু রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলাতেই গত ১৪ মাসে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১৬৭ কন্যাশিশু। গত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে কুড়িগ্রাম জেলায় বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১ হাজার ২৭২ কন্যাশিশু। এই সাত মাসে দেশের ২১টি জেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ে হয়েছে বলে জানিয়েছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।

সংস্থাটির 'বাল্যবিয়ের অবস্থা দ্রুত বিশ্নেষণ: করোনাকাল ২০২০' শীর্ষক ওই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১৩ হাজার ৮৮৬ কন্যাশিশু। এর মধ্যে ৫ হাজার ৮৯ জন অপ্রত্যাশিতভাবে গর্ভ ধারণ করেছে। যেসব মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার, তাদের মধ্যে ৫০ দশমিক ৬ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৬-১৭ বছর বয়সে। ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সে। ১ দশমিক ৭ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১০-১২ বছর বয়সে। বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে বরগুনায়; ১ হাজার ৫১২টি। এর পর কুড়িগ্রামে ১ হাজার ২৭২, নীলফামারীতে ১ হাজার ২২২, লক্ষ্মীপুরে ১ হাজার ৪১ এবং কুষ্টিয়ায় ৮৮৪ জন।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার নাজিমখাঁ, চাকিরপাশা, ধরনীবাড়ী ও দুর্গাপুর ইউনিয়নে বাল্যবিয়ের হার বেশি। এসব এলাকায় প্রায় ২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি বাদে সবই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শাহিনুর রহমান শাহিন জানান, করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লোকাইয়া আখতার, তাসনিফা নিষাদ, আকলিমা, খাদিজা, রেখা, বন্যাসহ বেশিরভাগ কন্যাশিশুর বিয়ে হয়েছে। এরা প্রত্যেকেই পশ্চিম ফুলমতি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

স্থানীয় মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতির বরাত দিয়ে উলিপুর প্রতিনিধি মোন্নাফ আলী জানান, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ে বেশি হয়েছে। লকডাউনের পর থেকে উলিপুরে সহস্রাধিক বাল্যবিয়ে হয়েছে। এসব বিয়ে জনপ্রতিনিধি ও কাজিদের যোগসাজশে ভুয়া খসড়া ফরমে রেজিস্ট্রি দেখিয়ে করা হচ্ছে। বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও দেড় হাজার শিশু শিক্ষার্থী।

উলিপুরের ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় সহস্রাধিক বাল্যবিয়ে হলেও শিশু ও নারীবিষয়ক দপ্তরে এর কোনো রেকর্ড নেই। তবে বেসরকারি এক সংস্থার রেকর্ডে ৬২৭টি বাল্যবিয়ে হওয়ার তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে। এ সময় সংস্থাটি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করেছে ১২২টি। এ ছাড়া তাদের জরিপে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে ১ হাজার ২৪৫জন এতিম ও দরিদ্র শিশু শিক্ষার্থী।

দুর্গাপুর কুঠির পাড়া গ্রামের আশরাফুল ইসলামের মেয়ে দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আশামণি, গোড়াই বামনপাড়া গ্রামের খোকন মিয়ার মেয়ে গোড়াই পাঁচপীর উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী শাম্মী ও দক্ষিণ মধুপুর গ্রামের নিখিল চন্দ্রের মেয়ে ধরনীবাড়ী মধুপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী কণা রানী জানায়, তাদের লেখাপড়া করার ইচ্ছা থাকলেও অসচেতন বাবা-মায়ের কাছে তারা অসহায় ও জিম্মি। তাই তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া হয়।

দুর্গাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উৎপল কান্তি সরকার বলেন, 'দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক কন্যাশিশুর বিয়ে হয়েছে। এ কারণে সপ্তম থেকে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী সংকট দেখা দিতে পারে।

এ ইউনিয়নের কাজি মো. মজিবর রহমান দাবি করেন, 'আমি বাল্যবিয়ে করাই না। তাই অভিভাবকরা আমার কাছে না এসে কুড়িগ্রামে গিয়ে ভুয়া ফরমে রেজিস্ট্রি করেছে।'

ফুলবাড়ী উপজেলার চারটি ইউনিয়ন সীমান্তঘেঁষা। ধরলার চরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাব প্রকট। নদীভাঙন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে অনেক পরিবারকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্যের কারণে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে এ অঞ্চলে। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে সমানভাবে পরিবারের জন্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারে- সেই বোধটি অনেকের মাঝে না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

অবশ্য প্রশাসন বাল্যবিয়ে রোধকল্পে শাস্তিও দিয়েছে এই সময়ের মধ্যে। আড়াই বছর আগে উপজেলার নওদাবশ গ্রামের সামছুল হকের মেয়ে আলো খাতুনকে বাল্যবিয়ে দেওয়ার অপরাধে কনের ফুফা রিয়াজুল ইসলাম ও বরের খালু নূর আলমকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সংশ্নিষ্ট এলাকায় বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ চরাঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংকট রয়েছে। তার মধ্যে করোনা মহামারিতে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই সময়ে দারিদ্র্য, দুর্দশা, যৌন হয়রানি- এমন অসংখ্য কারণ দেখিয়ে অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে শিশুদের। এসব বিয়ের অধিকাংশই কাজিদের রেজিস্টারের বাইরে রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে পরবর্তী সময়ে মূল রেজিস্টারের অন্তর্ভুক্ত করা হবে- এমন চুক্তিতে বাল্যবিয়ে হয়েছে অনেক পরিবারে।

পশ্চিম ফুলমতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজিজার রহমান বলেন, 'করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। এই সুযোগে অনেক অভিভাবক কন্যাশিশুদের বিয়ে দিয়েছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ এসএসসি পরীক্ষার্থী। বাকিরা নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী।'

একই অভিযোগ করেন রাঙামাটি সরদারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল বাতেন সরদার ও উত্তর কুটিচন্দ্রখানা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম হিনু। তারা বলেন, অভিভাবকদের বাল্যবিয়ে না দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গোপনে দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের কন্যাশিশুদের বিয়ে দিচ্ছে।

ফুলবাড়ী উপজেলার বিল্ডিং বেটার ফিউচার ফর গার্লস (বিবিএফজি) প্রকল্পের সমন্বয়কারী ঝরনা বেগম জানান, চলতি বছরের আট মাসে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা হয়েছে ৮টি। তরুণরা সংগঠিত হয়ে এসব বিয়ে ঠেকিয়েছে। প্রকল্পে ইমাম ও ঘটকদের প্রশিক্ষণ এবং যেসব বাবা বিয়ে না দিয়ে মেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন, তাদেরও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

এ উপজেলায় ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা (এইচআর এলএস) কর্মসূচির কর্মকর্তা শামিমা আখতার জানান, ফুলবাড়ী উপজেলায় গত দেড় বছরে ১১৬ জন নারী অভিযোগ করেছেন। তার মধ্যে মীমাংসা করা হয়েছে ৬৭টি। বেশিরভাগই অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী ও দরিদ্র পরিবারের।

আগস্টেই ৩ উপজেলায় ১৯ বাল্যবিয়ে: পিপলস্‌ ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশন (পপি) সূত্রে জানা যায়, এক মাসেই কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলাসহ হোসেনপুর ও পাকুন্দিয়ায় ১৯ জন কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ে হয়েছে। উত্তর পুমদী গ্রামের ১৫ বছর বয়সী সানজিদা, ১৭ বছরের তানিয়া সুলতানা; জগদলের ১৫ বছর বয়সী অন্তরা, গোকুলনগরের ১৬ বছর বয়সী হাসি, কালটিয়া গ্রামের ১৪ বছর বয়সী তানিয়া ও আশামণির মতো অনেকেই স্কুল খোলার এক মাস আগেই বাল্যবিয়ে করতে বাধ্য হয়।

গণমাধ্যমে উঠে আসে না অনেক তথ্য: নারীর অধিকার আদায়ে কাজ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। এ সংগঠনটি দেশের ১৩টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নারী ও কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে। তাদের হিসাবে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত মাত্র ১০৮টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটে। বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯৭। ২০১২ থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ গত সাত বছরে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটে ৭৬৮টি।

নারী অধিকারকর্মীরা বলেন, পুরুষ শাসিত এ সমাজে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন আরও অনেক দিন চালিয়ে যেতে হবে। একজন পুরুষ নিজের আয়ের সংস্থান করার পর পরিবার তাকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত নিলেও নারীর ক্ষেত্রে সেটি হয়ে ওঠে না। গত কয়েক বছরে বাল্যবিয়ের সংখ্যা কমে এলেও চলমান করোনা সংকটে সেটি আগের অবস্থানে ফিরে গেছে।

মহিলা পরিষদ সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আইন করা হলেও সেটির প্রয়োগ কম। চলতি এ দুর্যোগকালে দেশে বাল্যবিয়ের সংখ্যা অনেক বাড়লেও গণমাধ্যমে প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে আরও সচেতন হতে হবে। সূত্র: সমকাল

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়