ভিকটর কে. রোজারিও: শুক্রবার (১০ সেপ্টেম্বর), আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি করো’। বিশ্বে আত্মহত্যা প্রতিরোধে ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা দিবসটি পালন করে আসছে।
২০০৩ সাল থেকে দিবসটি পালন করা শুরু হলেও ২০১১ সালে প্রায় ৪০টি দেশ এ দিবসটি উদযাপন করে। সাম্প্রতিককালে চারদিক থেকেই অসংখ্য আত্মহত্যার সংবাদ দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। হতে পারে সংখ্যাটি আগে থেকেই এমনই ছিলো। মিডিয়ার সহজলভ্যতায় এখন হয়ত বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ এ দিবস পালিত হচ্ছে। যা-ই হোক, ব্যাপারটা ভাবাচ্ছে। শুনছি, অমুকের মেয়ে, তমুকের স্ত্রী-ছেলে গলায় ফাঁস লাগিয়ে, নয়ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে...। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ফেসবুকে ভাসছে আত্মহণনকারী মানুষটির হাস্যোদিনের স্থিরচিত্র। সকালে-বিকালে এ দৃশ্য দেখতে আর ভালো লাগছে না। প্রশ্ন হলো, কেন দেখতে হচ্ছে এ দৃশ্য।
বাংলাদেশে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। গত এক যুগে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে আত্মহত্যায় মৃত্যুহার প্রতি লাখ মানুষে কমপক্ষে ৭.৮ থেকে ৩৯.৬ জন। বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে বোঝা যায় যে দেশে আত্মহত্যার হার বাড়ছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সাম্প্রতিককালে মানুষ অনেক বেশি হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রভাবে কর্ম হারানো, ব্যবসায় ক্ষতি, কর্মহীনতার আলস্য, দাম্পত্য কলহ, অনৈতিক জীবনাচার এসবের প্রধানতম কারণ। আরও আরও উন্নত জীবনের আশায় পাগলপ্রায় হয়ে ছুটতে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ নিজের ঘরে ঢুকে দেখতে পেয়েছে, এ ঘরটার কিছুই প্রায় সে চেনে না। এটা বড় জটিল সমীকরণ। ঘরের মানুষটির অবস্থাও তথৈইবচ! সন্তানরা বাবাকে এ চেহারায় দেখেনি কখনও।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে আট লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। সংস্থাটির মতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। এছাড়াও প্রায় ১৫ থেকে ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এর মধ্যে নারী-পুরুষ-শিশু সব বয়সের মানুষ রয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করে ২১ বছর থেকে ৩০ বছরের নারী। এ বয়সী কিছু পুরুষও নানা কারণে আত্মহনন করে।
সম্প্রতি ঢাকার একটি থানায় মামলা রজ্জু করতে এসেছিলেন একজন নারী। তার দাবি, তার স্বামী তাকে ঘরের বাইরে যেতে বাঁধা দেন। পরে জানা গেলো, উক্ত স্বামী বেচারা স্ত্রীর বেপরোয়া জীবন-যাপনে বাঁধা দিয়েছিলেন।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে জাপানে। আগে সংখ্যাটি নিদারুণভাবে বেশি ছিলো এবং তা বৈশ্বিক ভাবনার বিষয়ে পরিণত হয়েছিলো। এটা হওয়ার অন্যতম কারণ ছিলো জাপানিদের আত্ম-সম্মান বোধ। এ বোধ অনেক উচুস্তরের। এটা ঐতিহাসিক জাপানি চারিত্রিক বৈশিষ্ট যে, যুদ্ধে হেরে গেলে প্রতিপক্ষের হাতে হত হওয়ার বদলে তুমি নিজেকে হত্যা করো। জাতি-গোত্রের বৈশিষ্টচ্যুতির শাস্তিও তা-ই ছিলো। ঐতিহ্যগতভাবেই জাপান বা আধুনিক জাপানে এ প্রবণতা রয়েই গিয়েছিলো। কিন্তু নানা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে পরিসংক্ষানচিত্রের রেখা নিম্নমুখি করেছে জাপান।
সেজন্য তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাগাতার প্রচার-প্রচারণা, ছাত্র-ছাত্রীদের কাউন্সেলিং-মতবিনিময় করেছে। সন্তানদের সাথে পিতা-মাতা, অভিভাবকদের আরও আরও নিবিড় ও অধিকতর যত্মশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। ফলাফল হাতে-নাতেই পাওয়া গেছে। আমাদের চেনা সমাজে হঠাৎ করেই যে আত্মমারণ খেলা শুরু হয়েছে, তারও নিশ্চয়ই এক বা একাধিক যৌক্তিক কারণ আছে। সামান্য একটি মোবাইলের জন্য, একটা পাখি ড্রেসের জন্য কেন আমাদের সন্তানরা আত্মহত্যা করবে? দাম্পত্যকলহগুলো কেন হচ্ছে? কারণগুলো অনুসন্ধান করা দরকার। সমাজের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই সে দায়িত্ব নেবেন। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারবে না।
আত্মহত্যা যে করে, সে আসলে নিজেকে চেনে না, নিজের অসীম শক্তি সম্পর্কে জানে না। নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি এবং চারপাশ বা প্রতিবেশীর প্রতি তার কোন ভালোবাসা থাকে না। অর্থাৎ, নিজেকে সে ভালোই বাসতে শেখেনি কখনও। দায়িত্ববোধ তো আরও বহু দূরের কথা।
আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে পরিবারের একটা বড় দায় থাকে। হয়তো পরিবার কখনও তাকে পৃথিবীতে তার আগমনের বিবরণ এবং এখানে তার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কিছুই জানায়নি। মানুষ অনেক আশা নিয়ে, অনেক পরিকল্পনা করে অনেক ভাবনা ভেবে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলো। নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, বিদ্যালয় আমাদের সন্তানদের ‘মানুষ’ বানাতে পারে না। অবশেষে মানুষ কিন্তু আবার পরিবারে ফিরছে। মানুষের বোধ ফিরেছে যে, বিদ্যালয় আমাদেরকে বর্ণ এবং বর্ণমালা সংশ্লিষ্ট কিছু জিনিস শেখায়। আর কিছু শিষ্টাচার। বাঙালি সেটাও শেখেনি। বাকীটা পরিবার থেকেই শিখতে হয়।
কাছের মানুষকে, পরিবারের মানুষকে জীবনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শেখান, ভালোবাসতে শেখান। নিজেকে ভালোবাসুন। পৃথিবীটা তখন অপূর্ব, অনন্য, মাধুরীময় হয়ে উঠবে। শুভকামনা সবার জন্য।