শিরোনাম
◈ সাতক্ষীরায় এমপি দোলনের গাড়িতে হামলা ◈ চুয়াডাঙ্গার পরিস্থিতি এখন মরুভূমির মতো, তাপমাত্রা ৪১ দশমিক  ৫ ডিগ্রি ◈ ফরিদপুরে পঞ্চপল্লীতে গণপিটুনিতে ২ ভাই নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১ ◈ মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ ভারতে লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোট পড়েছে ৫৯.৭ শতাংশ  ◈ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী ◈ দাম বেড়েছে আলু, ডিম, আদা ও রসুনের, কমেছে মুরগির  ◈ প্রার্থী নির্যাতনের বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, হস্তক্ষেপ করবো না: পলক ◈ ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন শেষ করতে চায় পেট্রোবাংলা ◈ বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপির নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী

প্রকাশিত : ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১১:৩৭ দুপুর
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৫১ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

ড. নজরুল ইসলাম: ঢাকা গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ষাট বছর

ড. নজরুল ইসলাম : ১৯৫৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ আরমানিটোলা থেকে ধানমন্ডি এলাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার সাথে সাথে ট্রেনিং কলেজ সংলগ্ন একটা স্কুলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৫৮ সালে সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ধানমন্ডিতে স্থানান্তরিত হবে। পরবর্তীতে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে একটি নতুন স্কুল স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয় যার নাম রাখা হয় গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল। নামটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে গৃহীত হয়েছিল। সেখানে অনেক উনিভার্সিটির কলেজ অফ এডুকেশনের সঙ্গে ল্যাবরেটরি স্কুল নামে একটা স্কুল থাকে। এরকম একটা ভাবনা থেকেই গড়ে উঠেছিলো আমাদের ল্যাবরেটরি স্কুল। উদ্দেশ্য ছিল এখানে নূতন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, সেই সঙ্গে চলবে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এক কথায় এটা হবে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ল্যাবরেটরি।

ঢাকা গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। স্কুল উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন জনশিক্ষা পরিচালক শামসুল হক সাহেব। পরদিন ইত্তেফাকে ব্যানার হেডিং দিয়ে ছাপা হয়েছিল - “বাংলা ভাষার মাধুর্যমন্ডিত পরিবেশে নব-বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু।” ছাত্র সংখ্যা ছিল ১৫৭ জন। শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ১৪ জন। খান মুহম্মদ সালেক স্যার ছিলেন প্রধান শিক্ষক। ক্লাস ছিল অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। আমি ভর্তি হই তৃতীয় শ্রেণীতে। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের বিশাল অডিটোরিয়ামে আমাদের ভর্তি পরীক্ষা হয়েছিল। খুব সম্ভবত ১৯৬১ সালের জুলাই মাসে। সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই। তবে অনুমান করতে পারি, আসনের তুলনায় প্রার্থীর সংখ্যা ছিলো অনেক গুন বেশি। তারপর ছিলো কঠিন ইন্টারভিউ।

প্রথম দিনগুলো কেটেছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ভাবে। নতুন স্কুল ভবন, নতুন ক্লাসরুম, নতুন চেয়ার টেবিল, নতুন সহপাঠী, নতুন পরিবেশ। আমাদের সবার আলাদা আলাদা চেয়ার টেবিল ছিল, যা কিনা তখনকার দিনে ছিল বিরল। ল্যাবরেটরি হাই স্কুল ১০.৭ একর জমির উপর অবস্থিত। কিন্তু শুরুতে আমাদের খেলার মাঠ ছিলোনা। ১৯৫৮ সালে স্কুল স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের পরপরই সরকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন জমি দখল করে নেয়। ধানমন্ডি ছিল ঢাকার অভিজাত এলাকা। এই জমির প্রতি নজর ছিল অনেকেরই। সরকারের পরিকল্পনা বানচাল করার জন্য কিছু লোক সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। তারা চেষ্টা করেছিল নতুন স্কুলটা যেন ট্রেনিং কলেজ সীমানার মধ্যে স্থাপিত হয়। পরিকল্পনা বানচাল করার জন্য অনেকে জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করে দেয়। জমিটা এমনিতেই ছিল নিচু এবং ডোবা-নালায় ভরা। পুকুর এবং ডোবা ভরাট করে খেলার উপযোগী মাঠ তৈরি করতে অনেকটা সময় লেগে ছিল।

ছাত্রদের মাঝে বিভিন্ন ধরণের প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য আমাদের চারটি হাউসে ভাগ করা হয়েছিল। হাউসগুলোর নাম রাখা হয়েছিল মুসলিম বিশ্বের চারজন প্রখ্যাত মনীষীর নামে – আল-বিরুনি (পাÐিত্যের প্রতীক), আল-মামুন (সুশাসনের প্রতীক), ওমর খৈয়াম (তারুণ্যের প্রতীক) এবং সালাহ্উদ্দীন (বীরত্বের প্রতীক)। প্রতিটি হাউসের আলাদা প্রতীকী রঙ ছিল - যথাক্রমে হলুদ, নীল, সবুজ এবং লাল। ভর্তির সময়কার রোল নম্বর হিসাবে ছাত্রদের হাউস নির্ধারিত হতো। স্কুলের ব্যাজ ছিল যা আমরা বিশেষ দিনে পরতাম। প্লাস্টিকের তৈরি এই ব্যাজগুলো ছিল খুবই আকর্ষণীয়। অনেকটা ক্যারামের স্ট্রাইকারের মতন। হাউসের সঙ্গে মিলিয়ে রং রাখা হয়েছিলো হলুদ, নীল, সবুজ এবং লাল। ব্যাজের উপর ছিল আমাদের স্কুলের মনোগ্রাম। মনোগ্রামের শিল্পী ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদন।

কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে আমরা বেড়ে উঠেছি। আমাদের ইউনিফর্ম ছিল সাদা শার্ট আর নেভী বøæ প্যান্ট, দুটোই সুতির। উনিফর্মের ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি ছিল। সঠিক ইউনিফর্ম না পরে আসলে কাওকে ক্লাস করতে দেয়া হতো না। ক্লাস শুরু হতো এসেমবিø দিয়ে। আমরা প্যারেড করে আমাদের খেলার মাঠে এসেমবিøতে যেতাম। এসেমবিøতে থাকতো জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সূরা ফাতেহা পাঠ, ওয়াদা বা শপথ বাক্য পাঠ আর পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত। উর্দু ভাষায় লেখা জাতীয় সংগীতের কিছুই বুঝতাম না। তাই প্রথম দুই এক লাইনের পর আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে আসত। আমাদের শিক্ষকরা হাতের ইশারায় আওয়াজ উঁচু করার আহŸান জানাতেন। কোনো কোনো দিন হালকা ধরনের ব্যায়ামও করানো হতো। জরুরি ঘোষণা থাকলে তাও জানানো হতো এসেম্বলীতে।
ল্যাবরেটরি স্কুলের সঙ্গে আমার একটা বিশেষ সংযোগ আছে। আমি এই স্কুলের প্রথম ছাত্র। একটা স্কুলের “প্রথম ছাত্র” হয় কি করে? সালেক স্যার তাঁর ‘মানুষ গড়ার মোহন মায়ায়’ বইতে এ ভাবে লিখেছেন - “উদ্বোধনের পর দুমাস কেটে গেল। নভেম্বর এসে পড়েছে। দেখা গেলো, যে ছেলেটির নাম ভর্তির খাতায় এক নম্বরে সেই নজরুল ইসলাম একটা সোয়েটার পরে এসেছে। সে সোয়েটারের নিচের অংশে ঘুরিয়ে লেখা হয়েছে আলো, আরও আলো। সেদিন কি আনন্দ আর উত্তেজনা আমাদের।“ প্রসঙ্গত, 'আলো, আরও আলো' হচ্ছে ল্যাবরেটরি স্কুলের নীতিবাক্য।

প্রথম প্রথম ল্যাবরেটরি স্কুলের নাম তেমন কেওই জানতো না। বরঞ্চ ল্যাবরেটরি স্কুল নাম শুনে অনেকে ভাবতো এটা আবার কি ধরণের নাম। ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্ররা এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম অংশ নেয় ১৯৬৪ সালে। সে বছর দিলীপ ভাই মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান পান। পাশের হার ছিল ১০০%। তখন থেকে সবাই ল্যাবরেটরি স্কুলকে চিনতে শুরু করে। এরপর, পর পর চার বছর প্রথম স্থান অধিকার করে চমক লাগিয়ে দেয় ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্ররা। ১৯৬৫ সালে বাদল ভাই এবং শফিক ভাই যুগ্ম ভাবে, ১৯৬৬ সালে মাহমুদ ভাই, ১৯৬৭ সালে শিবলী ভাই এবং ১৯৬৮ সালে মোত্তালেব ভাই। শিবলী ভাই আর্টসের ছাত্র হয়েও সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হয়ে ছিলেন। এই ভাল রেজাল্টের বদৌলতে ল্যাবরেটরি স্কুলের নাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সবচে ভাল রেজাল্ট হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। মেধা তালিকায় প্রথম ২০ জনের মধ্যে ১৭ জন ছিল ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের ছাত্র। আমি শুরু থেকে এমন একটা আইকনিক প্রতিষ্ঠানের অংশ হতে পেরে গৌরবান্বিত বোধ করছি।

ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র সংখ্যা কত হতে পারে তা অনুমান করা কঠিন। আজ বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার প্রাক্তন ছাত্র ছড়িয়ে আছে। আমরা সবাই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণী। কেননা আমাদের জীবনের বুনিয়াদ এখানেই গড়ে উঠেছিল। আর এর পেছনে ছিলেন 'মানুষ গড়ার কারিগর' আমাদের শিক্ষকবৃন্দ। আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ল্যাবরেটরি স্কুলের সকল প্রাক্তন এবং বর্তমান শিক্ষকবৃন্দকে।
লেখক: ড. নজরুল ইসলাম, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়