লিহান লিমা: [২] ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি মেইলের ‘ইউরোপিয় ইউনিয়নের নেতারা নিজেদের হাত রক্তে রঞ্জিত করেছেন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, আফ্রিকা অঞ্চলে প্রাণহানির বিপর্যয় এড়াতে দামে সুলভ এবং সহজে সংরক্ষণযোগ্য অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কার্যকরী হলেও ইউরোপিয় ইউনিয়নের নেতারা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে এই টিকা নিয়ে ভিত্তিহীন আশঙ্কা ছড়িয়েছেন।
[৩] অক্সফোর্ডের টিকা গ্রহণের পর রক্ত জমাট বাঁধার বিরল কয়েকটি ঘটনা নিয়ে ইউরোপিয় ইউনিয়নের আশঙ্কার পর আফ্রিকার দেশগুলো সস্তা এবং সহজে সংরক্ষণ যোগ্য অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিতে প্রত্যাখ্যান করে।
[৪] আফ্রিকার দেশ নামিবিয়ার রাজধানী উইন্ডহো’তে মৃত্যুহার রেকর্ড ছাড়িয়েছে। নামিবিয়ার ২৫ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ১ শতাংশের কম ব্যক্তি দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন। তিউনেশিয়ার পর কোভিডে মাথাপিছু মৃত্যুহারে দেশটি বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। গত সপ্তাহে নামিবিয়াতে উল্লেখযোগ্য মাত্রার অক্সফোর্ডের টিকা পাঠানোর ঘোষণা দেয় নেদারল্যান্ড। সেই সঙ্গে সুরিনাম, কেপ ভার্দে এবং ইন্দোনেশিয়ায় অক্সফোর্ডের টিকা দান করার ঘোষণা দেয় দেশটি। প্রতিবেদনে জানা যায়, নেদারল্যান্ডে হিমাগারে বিপুল পরিমাণ অক্সফোর্ডের টিকা পড়ে আছে। কারণ ডাচ নাগরিকরা এই সংস্থার বদলে ফাইজার ও মর্ডানার টিকা নিতে চাইছেন। নামিবিয়ার এক নাগরিক নেদারল্যান্ড থেকে আসা অক্সফোর্ডের টিকা নিয়ে মন্তব্য করেন, ‘আমরা ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছি।’
[৫] নামিবিয়া ছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকাসহ অনেক উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর ধারণা হলো, ধনী দেশগুলো এই টিকা দিতে চায় না বিধায়ই তা এখন তা তাদের পাঠানো হচ্ছে। তাই অনেক দেশটি এই টিকা নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে বা প্রত্যাখ্যান করছে।
[৬] নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়নে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। অক্সফোর্ড-বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ইনস্টিটিউটের প্রকল্প ব্যবস্থাপক অ্যাডাম রিচি বলেন, ইইউ যখন নিজস্ব টিকা কর্মসূচী গ্রহণ করে তখন অক্সফোর্ডের টিকাকে বলির পাঁঠা বানানো হয়। ম্যাক্রোঁ নিজে এক সাক্ষাতকারে এই টিকা ফেলে দেয়ার কথা বলেন এবং ৬৫-উর্ধ্বদের জন্য এই টিকা অর্ধেক অকার্যকারী বলে মন্তব্য করেন। পরে ইইউ মেডিক্যাল এজেন্সি এক বিবৃতিতে টিকার কার্যকারীতা ও নিরাপত্তার কথা জানালেও ততক্ষণে ম্যাক্রোঁর মন্তব্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং সন্দেহ তৈরি হয়। ফরাসি নিয়ন্ত্রকরা বয়স্কদের এই টিকা দান বন্ধ করেন। ডাক্তার মিলিনা ওয়েহেনকেল বলেন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার ওপর ম্যাক্রোঁর আক্রমণের সঙ্গে ব্রেক্সিটের অর্থ প্রদানে বিলম্ব বা টিকার সরবরাহে দেরী সম্পৃক্ত বলে আমি মনে করি। তার মন্তব্যের কারণে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
[৭] এরপর আনা হয় রক্ত জমাট বাঁধার গল্প। যা সারা বিশ্বে ছড়ানোর পর গত মাসে স্পেনের গবেষকরা দেখান, অক্সফোর্ডের টিকায় রক্ত জমাট বাঁধার হার ফাইজারের টিকার মতোই। কিন্তু ক্ষতি ততক্ষণে যা হওয়ার হয়েছে। এক ডজন ইউরোপিয় দেশ অক্সফোর্ডের টিকার ব্যবহার বন্ধ করে। মের্কেল প্রথম ডোজ অক্সফোর্ডের টিকা নিলেও দ্বিতীয় ডোজ মর্ডানার টিকা নেয়ায় বিশ্বে পুনরায় অক্সফোর্ডের টিকা প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বিশ্বজুড়ে বিকল্প অনেক টিকা চলে আসার পর ইউরোপিয় দেশগুলো অন্যায্যবাবে অক্সফোর্ডের টিকা প্রত্যাখ্যান করে তা অনুদান হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাঠাতে শুরু করে।
[৮] অফ্রিকায় ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ টিকা পেয়েছেন। কিন্তু সরবরাহের ঘাটতি, সন্দেহ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে অক্সফোর্ডের টিকাদানের লক্ষ্যগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মে মাসে মালাউইতে ১৯ হাজার অক্সফোর্ডের টিকা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় ফেলে দেয়া হয়। দেশটি আফ্রিকান ইউনিয়ন থেকে ১ লাখ ২ হাজার টিকা পেলেও মানুষের সন্দেহের কারণে বাকি টিকা দেয়া যায় নি। রাজধানী লিলংওয়ের এক দোকানদার বলেন, ‘আমি শুনেছি এই টিকা নেয়ার রক্ত জমাট বেঁধে অনেক লোক মারা গিয়েছে। তাহলে আমাদের কেনো এটি দেয়া হচ্ছে?’
[৯] আরেকটি বিষয় হলো, ইউরোপিয় মেডিক্যাল এজেন্সি কোভিশিল্ডের অনুমোদন দিতে দেরী করে। ফ্রান্স জুলাই পর্যন্ত এটিকে স্বীকৃতি দেয় নি এবং যারা কমপক্ষে এক ডোজ কোভিশিল্ড নিয়েছেন তাদের টিকা গ্রহণ না করা ব্যক্তিদের মতোই কোয়ারেন্টাইনের শর্ত দেয়া হয়।
[১০] উগান্ডায় মার্চ মাসে ১০ লাখ কোভিশিল্ড দেয়া হলেও মে পর্যন্ত দেয়া হয় মাত্র এক চতুর্থাংশ। আফ্রিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ জানায়, মানুষ টিকা নিতে এসে জিজ্ঞেস করছে, তাদের কি সবচেয়ে খারাপ টিকাটা দেয়া হচ্ছে? আফ্রিকা মহাদেশের বেশিরভাগ মানুষই থাকা সত্ত্বেও অক্সফোর্ডের টিকা নিতে চাইছেন না। বেটা ধরনের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত কম কার্যকারীতার অভিযোগে দক্ষিণ আফ্রিকা অর্ডারকৃত ১৫ লাখ অক্সফোর্ডের টিকা বিক্রি করে দেয়। অথচ দেশটির ৬ কোটির মধ্যে মাত্র ২৭লাখ টিকা নিয়েছেন।
[১১] ইইউর’সঙ্গে ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনের রাজনীতি শুরুর যাত্রাপথেই মহামারী হামলে পড়ে। মহামারীর একদম শুরুর দিকে প্রথমে অক্সফোর্ড এবং কিছুদিন পরফ াইজারের টিকা বিশ্ববাসীর মনে আশা যোগায় কিন্তু ফাইজারে টিকার সঙ্গে অক্সফোর্ডের টিকার মূল্য ও সংরক্ষণ পদ্ধতির অনেক পার্থক্র ছিলো।
[১২] ইইউতে ফাইজারের প্রতি ডোজ টিকার মূল্য ১৪.৭০ ডলার। এই টিকা মাইনাস ৮০ থেকে ৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে রাখতে হয়। অন্যদিকে অক্সর্ফোড শুরু থেকেই মুনাফা না করার ঘোষণা দেয়। এই টিকার প্রতি ডোজের মূল্য ৩ ডলার এবং এটি সাধারণ ঘরোয়া ফ্রিজেই দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করতে হয়। অন্যদিকে মর্ডানার টিকার এক ডোজের মূল্য ১৮ ডলার এবং জনসনের টিকার মূল্য ৮.৫০ ডলার।
[১৩] ইইউ অতিরিক্ত দামে ফাইজার-মর্ডানার টিকা কিনলেও অক্সফোর্ডের টিকার দাম কমানোর জন্য মরিয়ে হয়ে প্রচেষ্টা করে এবং আড়াই ডলারে এটি কিনতে সফল হয়। চাহিদা বেশি থাকায় সঠিক সময়ে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ব্রাসেলসে চুক্তি মোতাবেক সময়সীমার মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডোজ দিতে পারে নি। তখন সংস্থাটির বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেয় ইইউ। ইইউ আরো বলে, সদস্য দেশগুলোতে এই সংস্থার যে টিকা উৎপাদিত হচ্ছে তার চালান বন্ধ করে দেয়া হবে।
[১৪] গত সপ্তাহে ‘দ্য পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স’ গ্রুপ জানায়, বিশ্বজুড়ে টিকা দেয়ার খরচ কমপক্ষে ৫ গুণ বেশি সস্তা হবে যদি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো একচেটিয়া লাভ থেকে বিরত থাকা। জোটটি ফাইজার ও মর্ডানার ওপর সরকারগুলোর কাছে উৎপাদন খরচের চেয়ে ৪১ বিলিয়ন বেশি ডলার নেয়ার অভিযোগ করে। ফাইজার গত এক বছরে টিকা থেকে ২১.৪ বিলিয়ন ডলার লাভ করেছে এবং গত মাসে তারা বুস্টার ডোজের দাম বাড়াতে দেশগুলোকে প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা বিক্রি থেকে লাভ করেছে ৬৪৩ পাউন্ড। ফাইজার উচ্চ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর থেকে বেশি লাভ এবং নিম্ন ও নিম্ন মধ্য আয়ের দেশগুলোতে অলাভজনক মূল্যে বিক্রি করে।
[১৫] অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রধান নির্বাহী পাস্কাল সরিওত বলেন, ‘আমরা ইইউর সঙ্গে নিষ্পত্তিমূলক আলোচনা এগিয়ে নিতে চাই। সব সমালোচনা সত্ত্বেও আমরা ইউরোপে টিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী।’ অক্সফোর্ডের টিকার উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তি বলেন, ‘ম্যাক্রোঁসহ অন্যান্যরা টিকা নিয়ে সন্দেহ বপনের কারণে আফ্রিকা এতো মৃত্যু দেখেছে। তাদের লজ্জা হওয়া উচিত।’