শাহীন চৌধুরী ডলি: ফ্রিজ হচ্ছে কৃত্রিমভাবে খাদ্য - পানীয় ঠাণ্ডা করে সংরক্ষণ করার যন্ত্র। গত দুই দশকে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপনের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের চাহিদায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদার শীর্ষে অবস্থান করছে ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটর। প্রয়োজনীয় এবং স্টাইলিশ গৃহস্থালী পণ্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফ্রিজ ও রেফ্রিজারেটর। অনেকেই ফ্রিজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েও বেশ চিন্তায় থাকেন, কোন ব্রান্ডের ফ্রিজ কিনবেন? ফ্রস্ট নাকি নন ফ্রস্ট ফ্রিজ কিনবেন? বিদ্যুতের বিল কেমন আসবে?
আপনার ঘরের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট রেফ্রিজারেটর হল যেটা আপনার গৃহস্থালীর প্রয়োজনের সাথে মানায়।ফ্রিজ কিনলে আপনার পরিবার কত বড় সেটা ভেবে ফ্রিজ কিনুন। ফ্রস্ট এবং নন ফ্রস্ট ফ্রিজের কার্যকারিতা জেনে সিদ্ধান্ত নিন কোনটা কিনতে চান৷ সাধারণত ফ্রিজগুলোতে নরমাল এবং ডিপ - এই দুটো অংশ থাকে৷
ফ্রস্ট ফ্রিজ :-
১. ডিপে রাখা খাবার জমে যায়
২. খাবার ব্যবহারের আগে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়
৩. বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরেও ৫-৬ ঘন্টা সংরক্ষিত খাবার ভালো থাকে।
৪. বিদ্যুৎ খরচ অনেকাংশে কম
৫.ডিপের অংশে জমা হওয়া বরফ মাঝে মাঝে পরিস্কার করতে হয়৷
নন ফ্রস্ট ফ্রিজ :-
১. ডিপের অংশে কোন বরফ জমবে না৷
২. ডিপে রাখা মাছ- মাংস বের করলে অল্প সময়ের মধ্যে জমাট বাঁধা অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে এবং কিছু সময়ের মধ্যে ধুয়ে ব্যবহার করা যাবে৷
৩. এখন প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে তাই ডিপের দরজা বারবার না খুললে কয়েকঘন্টা খাবার ভালো থাকবে৷
৪.বিদ্যুৎ খরচ কিছুটা বেশি৷
ভালো ফ্রিজ ক্রয়ে কিছু বিষয়ে লক্ষ্য রাখুন :-
আপনি যদি ভালো ফ্রিজ চিনতে না পারেন তাহলে দেশী বা বিদেশী যেকোনো ভালো ব্রান্ডের ফ্রিজ গুলোতে কি কি কম্পোনেন্ট থাকে তা জেনে রাখলে ফ্রিজ কিনে ঠকবেন না। গ্যারান্টিসহ ফ্রিজ কিনবেন তাহলে ক্রয়ের পর কম্প্রেসার, খুচরা যন্ত্রাংশসহ ফ্রি সার্ভিসের সুবিধা পাবেন। ফ্রিজ ক্রয়ের আগে দেখে ও জেনে নিন সেটার কনডেন্সার কিসের তৈরি। কপার কনডেন্সার দিয়ে তৈরি করা ফ্রিজ কিনবেন। আপনি বিক্রেতার কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবেন। কপার কনডেনসার যুক্ত ফ্রিজ অনেক টেকসই এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হয়। ফ্রিজের গ্যাস লিকেজ হয় না৷ মরিচা পড়ে না, ক্যাপেলরী জ্যাম হয় না আর খাবার দ্রুত ঠান্ডা হয়৷
একটি ফ্রিজের কম্প্রেসার হচ্ছে ফ্রিজের মূল মেশিন৷ কম্প্রেসরের উপরে নির্ভর করে ফ্রিজটি কতটা ভালো সার্ভিস দিবে এবং কত সময় টিকবে। ফ্রিজের কম্প্রেসর খারাপ হলে বিদ্যুৎ খরচ বাড়িয়ে দিবে৷ এখন বাজারের নামী ব্যান্ডগুলোতে ইনভার্টার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে৷ ইইন্টেলিজেন্ট ইনভার্টার প্রযুক্তির ফ্রিজ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী। ফ্রিজ কেনার আগে অবশ্যই কম্প্রেসরের দক্ষতা দেখে নেওয়া উচিত। যে ফ্রিজের কম্প্রেসর যত ভালো, সে ফ্রিজের কার্যক্ষমতা তত ভালো।
ইনভার্টার প্রযুক্তির কম্প্রেসারযুক্ত ও উন্নত মানের কপার বাইন্ডিং ওয়্যার দ্বারা তৈরিকৃত কগম্ প্রেস হলো উন্নত কম্প্রেসার। এটা চেনা সাধারণ ক্রেতার পক্ষে সহজ ব্যাপার না৷ এক্ষেত্রে বিশ্বস্ত নামী কোম্পানির ব্রান্ডের গ্যারান্টিযুক্ত ফ্রিজ কিনতে পারেন৷ এতে ক্রয়মূল্য কিছুটা বেশি হলেও ভালো মানের ফ্রিজ পাওয়ার নিশ্চিয়তা থাকে। যতটুকু সম্ভব দীর্ঘমেয়াদের ওয়ারেন্টিযুক্ত নেয়া ভালো। বাজারে বিভিন্ন ধরনের ফ্রিজের উপর দশ বছর মেয়াদি ওয়ারেন্টির ফ্রিজ রয়েছে।
খাবারের সাথে স্বাস্থ্য সরাসরি যুক্ত। এইজন্যই প্রবাদ আছে, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল৷ ফ্রিজের যেখানে খাবার সংরক্ষণ করবেন সেটি যেন স্বাস্থ্যসম্মত হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে ফ্রিজ কিনবেন। এখনকার ফ্রিজগুলোতে নন সিএফসি গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে যা পরিবেশবান্ধব। আয়োনাইজার প্রযুক্তি থাকায় ফ্রিজে সংরক্ষিত খাবারের গায়ে কোন ব্যাকটেরিয়া জীবাণু জন্মাতে পারে না। খাবারের আদ্রতা ও সজীবতা দীর্ঘদিন ধরে রাখতে নো ফ্রস্ট ফ্রিজ সবচেয়ে কার্যকর। নো ফ্রস্ট ফ্রিজ পরিস্কার করতে ফ্রিজ বন্ধ না করলেও চলে। এছাড়া সবজির সজীবতা রক্ষা করতে ফ্রিজের ভেজিটেবল বক্সে আদ্রতা বজায় থাকে যা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে ফ্রিজের ডিজাইন ও রঙ গুরুত্বপূর্ণ। সাধ ও সাধ্যের সমন্বয়ে দুই দরজা, ডোর ইন ডোর বা সাইড বাই সাইড ডিজাইনের ফ্রিজ কিনতে পারেন৷ এসব ফ্রিজে ওয়াটার ডিস্পেন্সার সুবিধা আছে। ওয়াটার ডিস্পেন্সারটি ফ্রিজের বাইরের দিকে থাকে তাই ঠান্ডা পানির প্রয়োজন হলে ফ্রিজের দরজা না খুলেই ফ্রিজের বাইরের অংশে স্থাপিত ডিসপেন্সারটি অন করলেই ঠাণ্ডা পানি পাবেন।
বাংলাদেশের বাজারে দুই ধরনের ফ্রিজ কিনতে পাওয়া যায়।
একটি সাধারণ রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ, অন্যটি ফ্রিজার বা ডিপ ফ্রিজ। ১০০ লিটার - ৬০০ লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ফ্রিজ পাওয়া যায়। তবে ১৫০- ৩০০ লিটার ধারণক্ষমতার ফ্রিজ বেশি বিক্রি হয়। মধ্যম আয়ের মানুষ এই ধরনের ফ্রিজ কিনতে পছন্দ করেন, যেগুলোর মূল্য ২৫ হাজার টাকা থেকে ৫৫ হাজার টাকা।
ঈদুল আজহায় ফ্রিজের বাজার সরগরম থাকে। বিভিন্ন ব্রান্ডের ফ্রিজ বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ঈদ উপলক্ষে ফ্রিজ বিক্রয়ে মূল্যহ্রাস সহ বিভিন্ন অফারের ব্যবস্থা রাখে।
স্ক্র্যাচ কার্ড অফারে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে শতভাগ ডিসকাউন্ট পেতে পারেন ক্রেতারা। সহজলভ্য কিস্তিতে এবং ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ফ্রিজ ক্রয়ের সুবিধা দিচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি। কিছু ব্রান্ডের ফ্রিজ ক্রয়ে ক্রেতাদের জন্য থাকছে ০% ইন্টারেস্টে ৬ মাস পর্যন্ত নগদ মূল্য পরিশোধ এবং ১২ মাস পর্যন্ত সহজ কিস্তি সুবিধা। অনেক কোম্পানি ফ্রিজ কিনলে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করেন৷
বিভিন্ন ব্রান্ডের ফ্রিজ :- আমাদের দেশের বাজারে দেশি-বিদেশি নানা ব্রান্ডের ফ্রিজ রয়েছে। ফ্রিজের দোকান ছাড়াও অনলাইন থেকে ফ্রিজ কেনা যায়। বাজারে ভালো কিছু ব্রান্ডের ফ্রিজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্যামসাং, ইলেকট্রা, র্যাংগস, ক্যালভিনেটর, শার্প, হিটাচি একক্যোয়ার, ওয়ার্লপুল, ট্রান্সটেক, এলজি, কনকা, হাইকো, গ্রি, সিঙ্গার, ওয়ালটন, মার্সেল ইত্যাদি।
দেশীয় ফ্রিজ নির্মাতাদের সংগঠন রেফ্রিজারেটর ম্যানুফ্যাচারার্স এসোসিয়েশনের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ফ্রিজ বিক্রি হয় ২৫ লাখের বেশি৷ এর এক তৃতীয়াংশ বিক্রি হয় কোরবানির ঈদের ঠিক আছে৷ ২০১৯ সালে করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ব্যবসায়ীরা কোরবানি ঈদে প্রত্যাশা অনুযায়ী বিক্রি করতে পারেনি। তবে এটাও ঠিক করোনায় গৃহস্থালী পণ্য ফ্রিজের ব্যবহার বাড়ায় চাহিদা বেড়েছে৷ করোনায় অনেক বাসায় গৃহকর্মীদের কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচতে বারবার বাজারে না গিয়ে একসাথে বেশি করে বাজার করে ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে ফ্রিজের ব্যবহার হচ্ছে৷ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন বিদ্যুতের সুবিধা বেড়েছে তাই ফ্রিজের বিক্রিও দিন দিন বাড়ছে৷ শহরের পাশাপাশি গ্রাম - গঞ্জের বাজারগুলোতে ইলেকট্রনিকস দোকান গড়ে উঠছে৷ কোরবানি ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন কোম্পানি বিক্রি বাড়ানোর লক্ষ্যে নানা ফিচার যুক্ত করছে৷ এছাড়া কিস্তি ও ইএমআই সুবিধায় ফ্রিজ কেনার সুবিধা থাকায় বিক্রি বাড়ছে৷ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্রান্ডের ফ্রিজ বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এতে লাভবান হচ্ছেন ক্রেতা।
ফ্রিজের সমস্যায় :-
আমরা সবাই কম বেশি ফ্রিজ এর উপর নির্ভরশীল, কারন ফ্রিজ হছে একমাত্র মাধ্যম যা খাবারকে সতেজ রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু যদি হুট করে ফ্রিজ কাজ করা বন্ধ করে দেয় তাহলে আমাদের প্রচুর সমস্যার মুখে পড়তে হয়৷
ফ্রিজ নষ্ট হয়ে গেলে মেকানিক ডাকতে হয়। এটার পিছনে অনেক টাকা ব্যয় হয়। তবে অনেক সময় ছোট ছোট সমস্যাগুলো আমরা নিজেরাই সমাধান করতে পারি। কিন্তু সঠিক তথ্য না জানায় সার্ভিসিং-এর জন্য অনেক টাকা খরচ করে ফেলি।
ফ্রিজের সাধারণ কিছু সমস্যা ও তার সহজ সমাধান:-
সারাক্ষণ জোরে জোরে শব্দ করে? আপনার ফ্রিজটি যদি দেয়ালের গা ঘেঁষে রেখে থাকেন তাহলে দেয়াল থেকে কমপক্ষে ১০ সেন্টিমিটার দূরে রাখুন। চেক করে নিন ডিপফ্রিজে বরফ জমে আছে কিনা। ফ্রিজের ক্যাপাসিটরের বেশি কাজ করা বা শক্তি খরচ করা থেকেও এই শব্দের আবির্ভাব হতে পারে।
ফ্রিজ যথেষ্ট ঠান্ডা হয় না? প্লাগ ঠিকমতো পয়েন্টে না লাগানো থাকলে এই সমস্যা হতে পারে। কিংবা ফ্রিজের পেছনে ক্যাপাসিটরে দেখুন ধুলো বা বেশি ময়লা জমে আছে কিনা? তবে খুব সাবধানে পরিষ্কার করতে হবে। তাছাড়া ফ্রিজের দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় কিনা হালকাভাবে চাপ দিয়ে দেখুন। যদি না হয় তাহলে বুঝতে হবে এয়ারটাইট নয়।
দরজা বন্ধ হয় না? সাধারণত সীল ডিফেক্ট হলে দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না। অনেক সময় ফ্রিজ খুব ভালো করে পরিষ্কার করার পর আবার ঠিকমতো দরজা লাগানো যায়। তারপরও যদি না হয়, তাহলে দারজা বদল করা দরকার। তবে আপনার ফ্রিজটি বেশি পুরনো হলে নতুন ফ্রিজ কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এখন বিভিন্ন কোম্পানি পুরাতন ফ্রিজের বিনিময়ে কিছু শর্তসাপেক্ষে নতুন ফ্রিজ ক্রয়ের সুবিধা দিচ্ছে।
ফ্রিজে পানি জমে থাকে? ফ্রিজের ভেতরে পানি যাতায়াতের জন্য নলের ভেতরে একটি ছিদ্রের মতো ব্যবস্থা থাকে৷ আর সেটা দিয়ে পানি যাতায়াত না করতে পারলেই ভেতরে পানি জমে থাকে। এমনটা হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধরে নেওয়া হয় যে, কোনো কারণে চিকন নলের ছিদ্রটি ময়লার কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই পরিষ্কার করে নিন৷ প্রয়োজনে একটি চিকন ব্রাশ বা দাঁত মাজার ব্রাশ ব্যবহার করেও পরিস্কার করতে পারেন।
এছাড়া অতিরিক্ত খাবার, বিশেষ করে রান্না করা খাবার ফ্রিজে না রাখাই ভালো। এতে ফ্রিজের ভেতরে কেমন যেন গন্ধ হয়ে যায়। তাই নিয়মিত পরিষ্কার করুন। মাঝে মাঝে লেবুর পানি দিয়ে মুছেও নিতে পারেন, কিংবা একটি লেবুকে দুইভাগ করে কেটে ফ্রিজে দুইদিন রেখে দিতে পারেন। এতে দূর্গন্ধ, ব্যাকটেরিয়া দূর হয়ে ফ্রিজে লেবুর তাজা সুবাস ছড়াবে। মোটকথা ফ্রিজকে সচল রাখতে হলে একে অবশ্যই পরিষ্কার রাখতে হবে সাথে কিছু নিয়মও মেনে চলতে হবেঃ
প্রতিদিন অন্তত ৩০মিনিট ফ্রিজ বন্ধ রাখুন। ফ্রিজের কনডেনসার (ফ্রিজ এর নিচের দিকে থাকে) সপ্তাহে একবার ভেজা কপড় দিয়ে পরিষ্কার করুন। ফ্রিজের ডিফ্রস্ট ড্রেইন মাসে এক বার পরিষ্কার করবেন । আর মাত্র কয়েকদিন পরেই কুরবানি ঈদ। আপনার ফ্রিজটিকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে আর আপনি দায়িত্ব নিন ফ্রিজটিকে ভালো রাখার৷
shaheen.babu1971@gmail.com