অনুপম সৈকত শান্ত: কারখানায় আগুন লেগে শ্রমিকরা পুড়ে মারা যাওয়ার পরে জানা যায়- কারখানায় শ্রমিকদের ঢুকিয়ে তাদেরকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো। তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের নয়তলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ১১৯ জন (সরকারি ভাষ্য মোতাবেক) মারা গিয়েছিলো, নিচতলার কলাপসিপল গেটে তালা ছিল বলে শ্রমিকরা বিল্ডিং এ আটকা পড়েছিলো। স্মার্ট ফ্যাশনসেও আগুনের সময়ে প্রধান ফটকে তালা লাগানো ছিল। আগুন ধরার পরে স্থানীয়রা ও ভিতরে থাকা শ্রমিকদের আত্মীয়রা মিলে তালা ভেঙ্গে ভেতরের শ্রমিকদের বের হতে সহায়তা করায় সেখানে ৭ জন মারা যায়। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাশেম ফুড লিমিটেডের ছয়তলা বিল্ডিং এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাতেও জানা গেল, সেখানেও শ্রমিকদের তালা মেরে রাখা হয়েছিলো বলেই আটকা পড়ে, জানালা দিয়ে লাফিয়ে- হতাহত'র সংখ্যা এত বেড়েছে। সর্বশেষ জানা যাচ্ছে, ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে (সরকারি ভাষ্য মোতাবেক), তবে দমকল বাহিনী জানিয়েছে, ভবনের পাঁচ ও ছয়তলা ডাম্পিং এর কাজ চলছে, ডাম্পিং শেষ হলে সেখানে আরো লাশ আছে কি না, তা তল্লাশি চালানো হবে।
এই কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটনাগুলোর কমন ব্যাপার হচ্ছে, সবগুলোতেই দাহ্য পদার্থ, দাহ্য কেমিকেল স্তুপ আকারে ঐ বিল্ডিং-এই গোডাউন করা হয় - কোনরকম অগ্নিনির্বাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই এবং এই কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছিলো। এই তালা বন্ধ করে রাখার ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যজনক এক বিষয়! ঠিক কোন জায়গা থেকে শ্রমিকদের তালা দিয়ে রাখা হতে পারে? মালিকপক্ষ ও তাদের ম্যানেজার, সুপারভাইজাররা কি মনে করে যে, তালা দিয়ে না রাখলে কারখানার মূল্যবান সম্পদ এই শ্রমিকরা চুরি করে নিয়ে যাবে? তারা কি মনে করে, তালা দিয়ে না রাখলে- এরা এখানে ওখানে বের হয়ে ঘুরে বেড়াবে, কাজে ফাঁকি দিবে? নাকি অন্য কোন মনস্তত্ব আছে? অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরে এই তালাবন্ধ করে রাখার ব্যাপারটা সামনে এসেছে, কিন্তু আমার ধারণা- বাংলাদেশের অনেক কারখানাতেই হয়তো এভাবে শ্রমিকদের এভাবে তালাবন্দী করে রেখে কাজ করানো হয়! এটা অমানবিক, বর্বর আচরণই শুধু নয়, এইটা বেআইনিও! আর, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মোটেও দুর্ঘটনা নয়- বিল্ডিং এর অগ্নিনির্বাপক কোড না মানা, শ্রমিকবহুল ভবনে দাহ্য পদার্থ ভর্তি গোডাউন রাখা- এসবের জন্যেই এরকম অগ্নিকাণ্ডকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকাণ্ড বলা যায়, আর তালা বন্ধ করে শ্রমিক খুনকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছু বলা যায় না!
এই অগ্নিকাণ্ড ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে একটা অমিল পেলাম। অন্য অগ্নিকাণ্ডের মত এখানেও নারীদের অগ্নিদগ্ধ হওয়ার হার বেশি হলেও- নারায়নগঞ্জের হাশেম ফুড লিমিটেডের বিল্ডিং এর এই অগ্নিকাণ্ডে অনেকগুলো শিশু পুড়ে মারা গিয়েছে, বা এখনো নিখোঁজ রয়েছে বা অগ্নদগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটে চিকিতসাধীন রয়েছে। ১২, ১৩, ১৫ বছরের এই শিশুরা পেটের দায়ে কাজ করতে এসে পুড়ে মারা গেল, এই ব্যাপারটা কোনভাবেই মানতে পারছি না! বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও (১৪ বছরের নিচে হলে কাজে নেয়া যাবে না, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ঝুকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা যাবে না)- এই আইনের প্রয়োগ সামান্যই, বিশেষ করে দেশীয় কোম্পানি, কারখানা, দোকান-পাট, বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট- সবখানেই শিশুরা কাজ করে, হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, অত্যাচার-নিগৃহের শিকার হয়, এবং অনেক সময়ই ঝুকিপূর্ণ কাজেও তাদের ঠেলে দেয়া হয়! হাশেম ফুড লিমিটেডের ভবনে কাজ করা এই শিশুদের তালাবন্দী করে কাজ করানো হচ্ছিলো, অগ্নিকাণ্ডের পরে তাদের অনেকের পক্ষেই নিজেদেরকে বাঁচানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি! এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা শুধু পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডই নয়, এখানে শিশুহত্যার মত নৃশংস ও জঘণ্যতম ঘটনাও ঘটেছে।
মালিকগোষ্ঠী ও দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। কিন্তু, এই হাশেম গ্রুপের সাজাই তো যথেষ্ট নয়, কেননা কেবল তারাই তো মূল অপরাধী নয়। একের পর এক এরকম হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটতে যারা দিয়েছে, দিয়ে যাচ্ছে- দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি জানানোর পরেও যারা মালিকগোষ্ঠীকে সহজে পার পেয়ে যেতে দেয় ও কোলে পিঠে নিয়ে বসে থাকে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যাদের ঘাড়ে ছিল- সেই হোতাদের সাজা দরকার সবার আগে!