সালেহ বিপ্লব: [১] যে রাজনীতি বাবাদের কষ্ট দেয়, সে রাজনীতি করার কোনো অর্থ হয় না, এটা আমি উপলব্ধি করেছিলাম ১৯৯৫ সালের ৩০ আগস্ট, গভীর রাতে। টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনীর মাঠে শিশিরভেজা ঘাসে বসে আমি ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পরদিন আমি চট্টগ্রাম ছাড়লাম, ছাড়লাম রাজনীতি। [২] ৩০ আগস্ট বিকেলে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শোকসভা ছিলো, চট্টগ্রামের আমবাগান রেল গেইটে। পাহাড়তলী তখনও বিএনপির শক্ত ঘাঁটি। পাহাড়তলী কলেজে ছাত্রদলের একক অবস্থান। ফ্রিডম পার্টিও চাঙ্গা। দুই দলের সখ্য ছিলো বলে আওয়ামী লীগের ওপর আক্রমণটা বেশি হতো। সেই এলাকায়, বিএনপি ক্ষমতা থাকা অবস্থায় মাইক টানিয়ে সমাবেশ করা, খুব খুব টাফ একটা কাজ ছিলো। [৩] ওই ঘটনার কয়েক মাস আগে, মার্চের ১২ তারিখ ছাত্রদলের মিছিল থেকে ছোঁড়া থ্রি নিট থ্রি রাইফেলের গুলীতে শহীদ হন যুবলীগ নেতা, পুলিশের সাবেক এএসপি হারুণ (প্রকাশ ডিএসপি হারুণ)। সেদিন ছিলো আওয়ামী লীগের ডাকা দুদিনের হরতালের প্রথম দিন। সকাল ঠিক সাতটায় আমরা চা খেয়ে রাস্তায় নেমেছিলাম। কয়েক মিনিট মাত্র, পাহাড়তলীর দিক থেকে মিছিল আসছে ছাত্রদলের। আমবাগান রেলগেইটটা পার হতে হতে গুলী চালালো। আমার কাঁধে হাত রেখে কথা বলছিলেন হারুণ ভাই, গুলীটা তার বুকের বামদিকে লাগে। আমার কোলে মাথা রেখেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন যুবলীগের অনন্য সংগঠক হারুণ অর রশীদ। আর তার এই আত্মত্যাগ পাহাড়তলীতে আওয়ামী লীগকে কিছুটা হলেও সামনে এগিয়ে নেয়। [৪] হারুণ ভাইর রক্তের সঙ্গে আওয়ামী লীগ বেঈমানি করেছে, সেটা ভিন্ন ইতিহাস। ১২ মার্চের কারণেই ৩০ আগস্ট জনসভা করার সুযোগ তৈরি হলো। এবং যথারীতি সভা শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিশাল মিছিল চলে এলো। কিন্তু তারা যেভাবে ভেবেছিলো, সেভাবে ঘটনা ঘটেনি।
[৫] ছাত্রলীগের তিনটা প্রধান গ্রুপ তখন সক্রিয় চট্টগ্রাম মহানগরীতে। সিটি কলেজ, এমইএস কলেজ আর কমার্স কলেজ। গ্রুপিং তখন কিছুটা কমেছে। কমার্স কলেজের ছাত্রনেতা মোমিন হত্যা মামলায় অন্য দুই গ্রুপের নেতারা এক হয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করলেন। এটা গ্রুপিং প্রশমনে ভালো ভূমিকা রেখেছিলো। সেদিন আমবাগানের শোকসভায় ছাত্রলীগের সব গ্রুপ বিভেদ ভুলে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলো। [৬] পাহাড়তলী কলেজের যোদ্ধা-বন্ধুরা আশা করেননি, আওয়ামী লীগের সমাবেশ থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। ছাত্রলীগ পাল্টা গুলীবর্ষণ করতেই ছাত্রদল থমকে যায়। ফাঁকা মাঠে গোল করে চলে যাওয়া যাবে না, ওপাশেও বন্দুক আছে, এটা বুঝে উঠতে তাদের কয়েক মিনিট সময় লাগে। তারপর মহাপরাক্রমে গুলীবর্ষণ শুরু করে তারা। [৭] দুটো রেললাইনের জন্য রেলগেইট। গেইটের ওপাশে ছাত্রদল, এপাশে ছাত্রলীগ। আমাদের জীবদ্দশায় পাহাড়তলীতে বিএনপির বিরুদ্ধে এতো বড়ো প্রতিরোধ আর কখনো দেখিনি।[৮] সময়ের হিসেব নেই, শুধু গুলীর শব্দ। ককটেলের ধোঁয়া। মিনিট দশেক পর রেললাইনের ওপর রাস্তার ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন ডবলমুরিং থানার ওসি। ভদ্রলোকের নামটা মনে নেই। দুই হাত জোড় করে দুই পক্ষকে বললেন, অনেক যুদ্ধ করেছেন। আল্লাহর ওয়াস্তে এইবার থামেন। আর যদি গুলী চালান, চালাতে পারেন, আমি এইখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো। [৯] পুলিশ যখন এরকম অনুরোধ করে, তা রাখাটাই নিয়ম। আর ওসি সাহেব যেমন দুঃসাহসী ছিলেন, সরকারি-বেসরকারি সব অস্ত্রধারীরাই এই সাহসকে সম্মান করে। [১০] গুলীর শব্দ থেমে গেলো। ছাত্রলীগের স্থানীয় এক নেতা ওসি সাহেবকে বললেন, ওরা আগে হামলা করেছে। ওদেরকে যেতে বলুন, আমরাও চলে যাবো। তাই হলো।
[১১] রাতে টাইগারপাস কলোনীর মাঠে অন্ধকারে বসে আছি শামীম, খোকন, মোহন ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে। বিশাল এক জমাট বাঁধা আঁধার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাটালি হিলস। পাহাড়ের গায়ে রেলওয়ে ও পুলিশের বাংলোগুলোতে একটা দুটো করে বাতি জ্বলছে, মাঝে মাঝে কুয়াশায় বাতিগুলো ঢেকে গেলেও পাহাড়টা ঠিক গাঢ় ছায়া হয়ে চোখে ঠেকে। আঁধারে মিশে দূর আঁধারে চোখ রেখে আমরা বসে আছি। [১২] আমরা কথা বলছিলাম কম, প্রত্যেকেই ভাবছিলাম। কারণ বিকেলের বন্দুকযুদ্ধের সরকারি-বেসরকারি ধাক্কা আসতে খুব বেশি দেরি হবে না। আমিও ভাবছিলাম নিজের কথা। পরিবারের কথা। [১৩] ১২ মার্চ হারুণ সাহেব খুন হওয়ার দিন থেকে আমি ঘরছাড়া। নেতাদের আশ্রয়ে বাইরে থাকি। হত্যাকাণ্ডের প্রধান প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে আমি যাদের জন্য রিস্কি, তারা নানাভাবে আমার পরিবারকে মানসিক চাপের মধ্যে রাখছে। আবার আমাদের নেতারা হত্যা মামলাটায় আজেবাজে আসামীর নাম ঢুকিয়ে তাদেরকেও আমার শত্রু করে তুলেছে। ওদিকে ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে যখন বললাম, ১ ও ২ নাম্বার আসামীকে আমি ঘটনাস্থলে দেখিনি, তখন দলের একটি অংশ আমার শত্রু হয়ে গেছে। জটিল পরিস্থিতি। তো আমবাগান রেলওয়ে কলোনীর সামাজিক বন্ধন অনেক শক্ত ছিলো বলে আমার পরিবারের ওপর কোনো আক্রমণ হয়নি ঠিকই কিন্ত নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। আতঙ্ক সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। আমি সেগুলো ভাবছিলাম। ভাবছিলাম বিকেলের বন্দুকযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। সেদিন ওই স্থানে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিলো, সেটা আগামীতে কখনো হয়তো বলবো। আজ একটা ঘটনাই বলি।
[১৪] দুপক্ষের গুলীবিনিময়ের সময় ওসি সাহেব যখন লাইন অব ফায়ারে এসে যুদ্ধ থামানোর উদ্যোগ নেন, তার কিছুক্ষণ আগে আরও একজন বয়স্ক মানুষ পুলিশের বাধা ভেঙ্গে রাস্তার মাঝখানে ওঠে আসার চেষ্টা করছিলেন। তিনি যে রাস্তায় ওঠলেই ক্রসফায়ারে পড়ে যেতে পারেন, সেটা ভাবেননি একবারও। ভদ্রলোক বারবার বলছিলেন, ওরা আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলবে। আমাকে যেতে দেন, আমি ওকে নিয়ে বাসায় যাবো। প্লিজ, আমাকে যেতে দেন। এই ঘটনাটা আজো আমবাগানের পুরানো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। [১৫] সেদিন সন্তানকে বাঁচাতে যে ভদ্রলোক বন্দুকযুদ্ধের মধ্যে ঢুকে পড়তে চেয়েছিলেন, তিনি আমার বাবা। [১৬] রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়াইনি সাগিরা।