শিরোনাম

প্রকাশিত : ১১ জুন, ২০২১, ০২:২২ দুপুর
আপডেট : ১১ জুন, ২০২১, ০২:২২ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

আমি আগামী ১০ বছর পরের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা ভেবে শংকিত

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: গতকাল থেকে একটি সংবাদ বার বার নিউজ ফিডে ফিরে ফিরে আসছে। অনেকে ইনবক্সেও জানাচ্ছেন। আর কেউবা ফেইসবুকের এই সংক্রান্ত পোস্টে আমাকে ট্যাগ করে আমার মন্তব্য জানতে চেয়েছেন। সারাদিন কোন মন্তব্য করিনি। কারণ অধিক শোকে পাথর হবার মত অবস্থা। একটি নিয়োগে কত রকম এবং কোন মাত্রার অনিয়ম পর্যন্ত সহ্য করা যায় আর কোন মাত্রার হলে সেটা অসহ্য হয় সেটা আমি জানি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনিয়মটা যখন মাত্রা অনেক ছাড়িয়ে যায় এবং সেটা করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মান রক্ষার দায়িত্বে যিনি তার হাত দিয়ে তখন অসহ্যের মাত্রার Hooks এর লিমিট পেরিয়ে যায়।

একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারল পোষ্য কোটায়। অর্থাৎ তার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবাদে পোষ্য কোটায় ভর্তি হলো। কোটা সাধারণত থাকে সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সন্তান কি সুবিধা বঞ্চিত? এই কোটার মাধ্যমে বরং বঞ্চিতদের আরো বঞ্চিত করা হয়। অথচ এই পোষ্য কোটা দিব্যি আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যুগের পর যুগ ধরে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সন্তান হওয়ার কারণে কেবল ভর্তি নয় সে অনেক ক্ষেত্রে ভালো ফলাফল পেতেও অলিখিত কোটা সুবিধা পায়। বিশেষ করে ছাত্রাবস্থায় শুনেছি ভাইভা এবং ল্যাব পরীক্ষায় তারা অতিরিক্ত favor পায় আর সেটা পাওয়াও স্বাভাবিক। তবে সেটা সবাই করেও না আবার সবাই নেয়ও না।

একটি ছেলে পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়ে এতসব সুবিধা পাওয়ার সুবিধা পেয়েও যেই ছাত্র প্রথম বিভাগে পাশ তো করেনইনি উল্টো যে ১৪ জন শিক্ষার্থী দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছিলেন সেখানেও তার অবস্থান ১০ম। এখানেই শেষ না। আবার তিনিই তার বিভাগে একমাত্র শিক্ষার্থী যে কিনা অনার্স এর একটি কোর্সে ফেল করেছেন। মজার বিষয় হলো এই শিক্ষার্থীর অনার্সে ফলাফল খারাপ হওয়ায় মাস্টার্সে থিসিস গ্রুপে যাওয়ারই সুযোগই পাননি। তার নাম ইন্দ্রনীল মিশ্র।

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান গত ৬ মে যে ১১ জন শিক্ষককে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে গেছেন, তাদেরই একজন হলেন এই ইন্দ্রনীল মিশ্র। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদভুক্ত ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন।

আমার আপত্তি থাকতো না সে যদি পিএইচডি করে নিজের যোগ্যতা দিয়ে পোস্ট-ডক করে সেখানে ভালো গবেষণার স্বাক্ষর রেখে এরপর যদি নিয়োগ পেত। শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা যখন কেবল মার্স্টার্স ডিগ্রী এবং যার কেবল অনার্স আর মাস্টার্স আছে তাকে রেজাল্ট ছাড়া আর কি দিয়ে মাপা যাবে? ইন্দ্রনীল মিশ্রের রেজাল্ট দেখে এইটা স্পষ্ট তার চেয়ে অনেক ভালো প্রার্থী অন্তত আরো ১৫-২০ জন ছিল। যখন কারো পিএইচডি ডিগ্রী থাকে তখন আর অনার্স মাস্টার্স দেখার দরকার পরে না। কারণ তখন তাকে মাপা হয় তার গবেষণা পত্র এবং এক্সপার্টদের রেকমেন্ডেশন দিয়ে। যখন কারো পোস্ট-ডক থাকে তখন গবেষণপত্র সংখ্যা এবং তাদের মান দিয়ে সবচেয়ে ভালোভাবে মাপা যায় এবং এইজন্যই বিশ্বে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতা পিএইচডি + পোস্ট-ডক।

সদ্য বিদায়ী রাজশাহীর ভিসি শুধু এটাই না এইরকম আরো অসংখ্য নিয়োগ দিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পঙ্গু করার ব্যবস্থা করে গেছেন যার ফলাফল ভুগবে শত শত শিক্ষার্থী অনেক বছর ধরে। In fact, এই অযোগ্যরাই রাজনীতির মাধ্যমে হবে ক্ষমতাবান এবং তারা কখনো ভালোদের সহ্য করতে পারবে না। ফলে ক্ষতিগুলো ক্যাসকেডিং ইফেক্টের মাধ্যমে এমপ্লিফাই হয়ে ক্ষতির মাত্রা একসময় tsunami হয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আঘাত করবে। যার লক্ষণ ইতিমধ্যেই প্রকট। দুঃখের বিষয় এইরকম অনিয়ম হওয়া সত্বেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারতো এখন জেলে থাকার কথা। কেবলই কি সরকার? ছাত্র যুব কিংবা জনগণ এবং সুশীল সমাজ কেউইতো কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে না। ফলে অন্যায়গুলোও আস্কারা পাচ্ছে এবং অবধারিতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমি ভাবতেছি এত কিছুর পর সে কিভাবে শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে! লজ্জা এবং আত্মসম্মানবোধ থাকলে এখনই পদত্যাগ করলে কিছুটা সম্মান ফিরে পেত।আমি আগামী ১০ বছর পরের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা ভেবে শংকিত। এখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু মেধাবী শিক্ষক আছে যারা আগামী ১০ বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন। তারপর ভালো শিক্ষকের বিলুপ্তি ঘটবে। সেই আগামীর বাংলাদেশের কথা ভেবে আমি সত্যিই শংকিত।

লেখক : শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়