মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: ১৯৬৬ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী আওয়ামী লীগের ডাকা হরতাল পালিত হয়। এটি ছিলো পাকিস্তান আমলে ডাকা প্রথম সর্বাত্মক হরতাল। এই হরতালে পাকিস্তানের শাসক মহলের নির্দেশে পুলিশ মিছিলকারীদের ওপর গুলি ছোঁড়ে। ফলে নিহত হন ১১ জন সাধারণ মানুষ, যাদের মধ্যে কয়েক জন ছিলেন শ্রমিক, বাকি সবাই ছিলেন বিভিন্ন পেশার। এই হরতালের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কিমিটিতে। হরতাল ডাকার প্রধান কারণ ছিলো ছয় দফা কর্মসূচি গঠিত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানসহ কেন্দ্রীয় নেত্রীবৃন্দকে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে কারাগারে প্রেরণ করতে থাকে। সর্বশেষ ৮ মে নারায়নগঞ্জের অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব ও তার প্রদত্ত ছয় দফার প্রতি উপস্থিত জনতার সমর্থন দেখে পাকিস্তান সরকার ভীত হয়ে পড়ে। শেখ মুজিব ঢাকায় ফেরার পর রাতেই ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন। ওই রাতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অনেককেই কারাগারে প্রেরণ করা হয়, চলতে থাকে প্রদেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতাদের গ্রেপ্তার করা। শতশত নেতাকর্মী তখন জেলে আবদ্ধ ছিলেন। সে প্রেক্ষিতে ২০ মে জরুরি আইন প্রত্যাহার, গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মক্তিদান এবং সংবাদপত্রে স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশ করার দাবিতে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ৭ জুনের হরতাল আহ্বান করে। এই হরতালকে সফল করার জন্য ২৭ মে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্যগণ রাওয়াল পিন্ডিতে এক বিবৃতি প্রদান করেন। সেটিতে সমর্থন করে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ কমিটি ৩১ মে প্রদেশব্যাপী হরতালকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে পত্রপত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করে।
এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের মধ্যে যারা মুক্ত ছিলেন তারা হরতালকে সমর্থন করার জন্য ঢাকা নারায়নগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় যোগাযোগ করেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃ বৃন্দ শ্রমিক অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেন। বিভিন্ন কল কারখানার শ্রমিক নেতৃবৃন্দ হরতালের সমর্থনে সংগঠিত হতে থাকে। এ কারণেই ৭ মের হরতালে সব থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন বিভিন্ন কলে কারখানায় কর্মরত শ্রমিকগণ। তারা ঢাকার তেঁজগাও, পোস্তগোলা, ডেমরা, নারায়নগঞ্জের আদমজিসহ বিভিন্ন শিল্প এলাকায় হরতালকে সফল করতে ওই দিন মিছিল সহকারে রাস্তায় নামেন। ৭ জুন সকাল থেকে রাস্তায় কোনো যানবাহন বের হয়নি, দোকান-পাট বন্ধ ছিলো, অফিস-আদালতে উপস্থিতি ছিলো না। সর্বাত্মক হরতাল প্রদেশব্যাপী শান্তিপূর্ণভাবেই শুরু হয়। তবে বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় মিছিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অবরোধ, রেল স্টেশন ঘেরাও বেড়ে যাওয়ার পর সাধারণ মানুষ এগুলোতে স্বস্ফূর্তভাবে যুক্ত হয়। এ অবস্থায় পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে সরকার জনগণের অবরোধ ও মিছিল ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, তারা গুলি চালতে থাকে। এতে শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ ১১ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। বহু সংখ্যক মানুষ আহত হন।
এই খবর গ্রামে-গঞ্জে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। সরকার পরদিন প্রকাশিত পত্রপত্রিকায় হরতালে নিহত আহতদের খবর প্রচারে বাঁধা প্রধান করে। তবে একটি প্রেস রিলিজের মাধ্যমে উশৃঙ্খল জনতার উল্লেখ করা হয়। পত্র-পত্রিকাগুলো কৌশলে ১১ জন নিহত হওয়ার খবর প্রকাশ করে। ৭ জুনের এই হত্যাকাণ্ড পাকিস্তান সৃষ্টির পর সব চেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড হিসেবে পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে বিবেচিত হয়। ৭ জুনের পর ৮ তারিখ ন্যাপের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের প্রধানগণ এক যুক্ত বিবৃতিতে পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনীকে দিয়ে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তারা একই সঙ্গে সকল মহলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ারও আহ্বান জানান। ডানপন্থী অন্যান্য রাজনৈতিক দল ৭ জুনের হরতালকে সমর্থন করেনি, নিহত আহতদের প্রতি সমবেদনাও জানায়নি। তবে আওয়ামী লীগ হরতালের পর দেশের সাধারণ মানুষের তীব্র প্রতিক্রিয়াকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার জন্য ১০ তারিখ ওয়ার্কিং কমিটির একটি সভা গোপনে অনুষ্ঠিত করে। এতে ছয় দফার আন্দোলনকে বেগবান করা, জরুরি আইন প্রতাহার, কারাবন্ধী শেখ মুজিবসহ নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দান, পত্র-পত্রিকায় স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সকল মহলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করে। আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ ঘোষিত কর্মসূচির প্রতি জন সমর্থন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৭ জুনের পরবর্তী অবস্থাকে আওয়ামী লীগ ছয় দফা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব হিসেবে অভিহিত করে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থান করছিলেন। তিনি আন্দোলনের গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করে ছয় দফা আন্দোলনকে পাকিস্তান সরকার রুখতে পারবে না বলে তার লেখা করাগারের রোজনামচায় ব্যক্ত করেন। পাকিস্তান সরকার ছয় দফার আন্দোলনকে স্তবদ্ধ করে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের ওপর শুধু দমন নিপীড়নই বৃদ্ধি করেনি, নতুন একটি জোট গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে তাতে যুক্ত হওয়ার জন্য চাপ প্রদান করছিলো। এই জোটের প্রধান করা হয়েছিলো নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানকে। পাকিস্তান ডেমোক্যটিক মুভমেন্ট নামক এই জোট ছয় দফার বিপরীতে আট দফা প্রদানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলো।
অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে ছিলেন কিন্তু দলীয় প্রধান শেখ মুজিব ও সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীনসহ অনেক নেতা এবং কর্মী যেকোনো মূল্যে ছয় দফা বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার আগরতালা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে। উদ্দেশ্য ছিলো শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী অভিযোগের বিচার শেষে ফাঁসি দেওয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঊনসত্তর সালে ছাত্র জনতার গণঅভ্যূত্থান চুক্তি হলে শেখ মুজিবসহ নেতৃবৃন্দকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়। শেখ মুজিব জনগণের কাছে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন, ছয় দফার বিজয় ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানে ছয় দফার পক্ষে একচেটিয়া জনমত সৃষ্টি হয়, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনতার সেই রায় ছয় দফার পক্ষেই প্রদর্শিত হয়। ৭ জুন পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী বাঙালির যে রক্তপাত ঘটিয়েছিলো তা বৃথা যায়নি। ছয় দফার আন্দোলন সেখান থেকে নতুন উদ্যেমে সকল ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান ঘটিয়েছে। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনাতার ডাক দিয়েছেন। আমারা তার ডাকে সারা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। ছয় দফা স্বাধীনতার এক দফায় রূপান্তরিত হলো। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠত হলো। অনুলিখন: শাহিন হাওলাদার