সমকাল: চলতি বোরো মৌসুমে সারাদেশ থেকে সাড়ে ছয় লাখ টন ধান কিনবে সরকার। ধান কেনা শুরু হয়েছে গত ২৮ এপ্রিল থেকে। অন্যদিকে চাল সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়েছে ৭ মে থেকে। আগামী ১৬ আগস্ট পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে। কিন্তু গত ২৬ মে পর্যন্ত সারাদেশে ধান কেনা হয়েছে মাত্র ৭০ হাজার ৩২ টন। একইভাবে চাল সংগ্রহের গতিও মন্থর।
খাদ্য সংগ্রহের এই চালচিত্রে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এ জন্য ধান-চাল সংগ্রহে নিয়োজিত কোনো ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তার অবহেলা দেখা গেলে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। ধান সংগ্রহ কার্যক্রমে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দপ্রাপ্ত রাজশাহী বিভাগে এক লাখ ৭ হাজার ৩৪৬ টন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র এক হাজার ৩৪৬ টন বা ছয় শতাংশ। রংপুর, ঠাকুরগাঁও ও বান্দরবান জেলায় ধান সংগ্রহ শুরুই হয়নি। অথচ শুধু রংপুর জেলাতেই ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১৭ হাজার ৪০৩ টন।
অন্যদিকে, ১০ লাখ টান সিদ্ধ চালের মধ্যে গত এক মাসে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র এক লাখ ৬০ হাজার ৫৮১ টন। আর এক লাখ টন আতপ চালের মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র এক হাজার ১৮২ টন।
লক্ষ্যমাত্রা পূরণে নানা প্রচেষ্টা :এদিকে, অনেক উপজেলাতে এখনও কৃষক তালিকা চূড়ান্ত হয়নি। এ জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) সঙ্গে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেছেন খাদ্য বিভাগের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা। প্রসঙ্গত, উপজেলা পর্যায়ে কৃষকের তালিকা চূড়ান্ত করা হয় ইউএনওদের মাধ্যমে।
এমন প্রেক্ষাপটে এসব এলাকায় গত বছরের তালিকা অনুসরণ করে লটারি অথবা আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে ধান কিনে সংগ্রহ কার্যক্রম শতভাগ সফল করতে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। কারণ, গত বোরো ও আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় বাজারে এর দামে ছিল ঊর্ধ্বগতি।
এ জন্য এবারের লক্ষ্যমাত্রা যে কোনোভাবে পূরণ করতে চায় খাদ্য মন্ত্রণালয়। তাই কেজিপ্রতি ধানের দাম এক টাকা বাড়িয়ে ২৭ টাকা ও চালের দাম চার টাকা বাড়িয়ে ৪০ টাকা করা হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এবার সাড়ে তিন লাখ টন কম ধান সংগ্রহ করা হবে। তবে দাম বাড়ানোর পরও ধান-চাল সংগ্রহে গতি আসেনি।
এ ছাড়া ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় কৃষকদের কাছ থেকে যথাক্রমে এক টন, দুই টন ও তিন টন ধান কেনার নিয়ম থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে এবার এ নিয়ম পাল্টে সবার কাছ থেকেই সর্বোচ্চ তিন টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে চিঠি :সংগ্রহ কার্যক্রম সফল করতে গত ২০ মে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) শেখ মুজিবর রহমান আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, বিভাগভিত্তিক সংগ্রহের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, ধান-চাল সংগ্রহের গতি অত্যন্ত মন্থর- যা মোটেই কাম্য নয়। সংগ্রহের এ গতি অব্যাহত থাকলে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অবশিষ্ট ধান সংগ্রহ করা দুরূহ হয়ে পড়বে।
এমন পরিস্থিতিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অসন্তোষ প্রকাশ করে চিঠিতে উল্লেখ করেন, সরকার সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ অর্জনের বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। এ জন্য ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তাদের আরও সক্রিয় ও তৎপর করতে হবে। কোনো ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা কাজে অবহেলা করলে প্রত্যাহারসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, এবারের বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন সন্তোষজনক এবং বর্তমানে ধানের বাজারমূল্য সংগ্রহের অনুকূলে রয়েছে। সরকার ধান ও চালের দাম বাড়িয়েছে। গত বছরের চেয়ে ধান সংগ্রহের পরিমাণও কমানো হয়েছে। তাই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে। যেভাবেই হোক এবারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতেই হবে। যদি কোনো কর্মকর্তার অবহেলার দায়ে সংগ্রহ কার্যক্রম ব্যাহত হয়, তাহলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, সংগ্রহ কাজ সফল করতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়তই বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ওই নির্দেশনা তাদের অনুসরণ করতে হবে।
প্রসঙ্গত, চলতি বোরো মৌসুমে জেলা, উপজেলা ও গুদামভিত্তিক রোডম্যাপ তৈরি করে চাল সংগ্রহ ৩০ জুনের মধ্যে ৭৫ ভাগ, জুলাইয়ের মধ্যে বাকি ১৫ ভাগ ও আগস্টের মধ্যে বাকি ১০ ভাগ সম্পন্ন করতে হবে।
কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও কৃষকদের বক্তব্য :রাজশাহী বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক জি. এম. ফারুক হোসেন পাটওয়ারী বলেন, গত কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে ময়েশ্চার নিয়ে সমস্যা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণেও কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া কৃষকের তালিকা তৈরিতে কিছু উপজেলায় দেরি হয়েছে। তবে সংগ্রহের জন্য সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তিনি আশাবাদী, শিগগিরই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।
রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আব্দুস সালাম বলেন, রংপুর বিভাগে সবার শেষে ধান তোলা হয়। অনেক জেলায় এখনও ধান কাটার কাজ চলছে। তাই সংগ্রহ কার্যক্রমেও কিছু দেরি হচ্ছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের বিষয়ে তিনিও আশাবাদী।
নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার রাইগাঁ গ্রামের কৃষক তশলিম উদ্দিন বলেন, ধান কাটার খরচ মেটাতে টাকার দরকার এত বেশি ছিল যে, সরকার ধান কেনা শুরুর আগেই কম দামে লোকসানে ফড়িয়া ও দালালদের কাছে ধান বেচে দিয়েছি। এখন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করতে পারছেন না। প্রতিদিন 'ধান দেন' 'ধান দেন' বলে মাইকিং করছেন তারা।
নওগাঁ জেলার রানীনগর উপজেলার কালিগ্রাম গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, বর্তমানে বাজারে ১০৮০ থেকে ১১০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি হচ্ছে। আর সরকার ধান কিনছে এক হাজার ৮০ টাকায়। আবার সরকারের কাছে ধান বিক্রিতে নানা জটিলতাও রয়েছে। তাই গুদামে কেউ ধান দিতে আগ্রহী না।
সাতক্ষীরার চাল ব্যবসায়ী সি মজুমদার বলেন, সরকারি ধান-চালের দাম নিয়ে কৃষক ও চালকল মালিকরা এবার সন্তুষ্ট। আশা করি, মিলারদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যেকে চাল সরবরাহ করবে। এ জন্য সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের তৎপর থাকতে হবে।
একাধিক জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বলেন, ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তারা ধানের চেয়ে চাল সংগ্রহের কাজে বেশি মনোযোগী। এতে অনেক সময় চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়, কিন্তু ধানের আর পূরণ হয় না। এ ছাড়া ধান সংগ্রহে ময়েশ্চারজনিত সমস্যায় অতিরিক্ত কিছু কাজ করতে হয়। ধান-চাল দুটোই সংগ্রহের ক্ষেত্রে মনোযোগী থাকার জন্য কর্মকর্তাদের সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান তারা।
অ্যাপেও সংগ্রহ কম :এদিকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে স্মার্টফোনে ডাউনলোড করা অ্যাপের মাধ্যমে ধান পেতেও দেরি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ টন। কিন্তু সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার টন। কারণ অ্যাপে নিবন্ধনে কৃষকের আগ্রহ কম। এ কারণে বেশিরভাগ উপজেলায় এখনও নিবন্ধন প্রক্রিয়াই শুরু হয়নি। তবে অ্যাপের মাধ্যমে যেসব উপজেলায় কৃষকের নিবন্ধনে দেরি হচ্ছে, সেসব উপজেলায় অ্যাপের পাশাপাশি আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে ধান কিনে সংগ্রহ কার্যক্রম সফল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও জেলার জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের তিনটি উপজেলায় অ্যাপের মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করা হবে। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও সদরে গত সোমবার কৃষকের তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। রানীশংকৈল ও পীরগঞ্জ উপজেলায় এখনও তালিকা তৈরি হয়নি। ফলে অ্যাপে কৃষকের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায়ও দেরি হবে।