হেলাল মহিউদ্দীন: একটি গভীর দুঃখ- উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে কবি কাজী নজরুল এতোটাই উপেক্ষিত যে সাহিত্যের ছাত্ররা তাঁকে প্রায় চেনেই না। নেটিভ ইংরেজিভাষীদের মধ্যে চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ জি স্টকই শুধু ‘পল্লীজননী’র একটি সাধারণ অনুবাদ করেন। উইলিয়ম রঁদিচে নজরুল নিয়ে দারুণ উচ্ছ্বাস দেখালেও বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের বাইরে যাননি। নজরুলকে নিয়ে লেখা তাঁর একটি আশাবাদী বক্তৃতা-রচনাই সার। ‘বিদ্রোহী’, ‘ছাত্রদের গান’, ‘সিন্ধু’, ‘দারিদ্র’,‘ঝিঙেফুল’ এবং ‘বিজয়িনী’ কবিতাগুলোরও সারসংক্ষেপই করেছেন মাত্র, অনুবাদ করেননি।
ব্রিটিশ শাসনামলে কয়েকটি ইংরেজি কবিতার অনুবাদ হয়েছিলো সাহিত্যসেবার জন্য নয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় যাতে তাঁর বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, সে জন্য। উপনিবেশকারীদের বিদায়ের প্রক্কালে এবং অখন্ড পাকিস্তানে নজরুলের যা কিছুই ইংরেজিতে অনুদিত, প্রায় সবই হয়েছে ভারতীয়দের দ্বারা। এর বাইরে ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ ইত্যাদি ভাষায় তাঁর সাহিত্যকৃতির সম্পূর্ণ অনুবাদ প্রায় শূন্য। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক কবি, যাঁরা তাঁর সমকক্ষ মোটেই নন-তাঁরাও দারুণ আলোচিত, বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত এবং ব্যাপকভাবে পঠিত। কারণ সেইসব দেশের আপ্রাণ চেষ্টা।
ষাট হতে আশির দশকে একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নেই নজরুল পরিচিতি পেয়েছিলেন। সমাজতন্ত্রী সরকারগুলোর প্রপাগান্ডা মেশিন তাঁর সাহিত্যের নির্বাচিত কিছু অংশ নিয়ে চার ভল্যুমের অনুবাদগ্রন্থ বের করেছিল। ‘বিদ্রোহী’, ‘সাম্যবাদী’, ‘উপনিবেশবিরোধী’ ‘ভারত উপমহাদেশের মায়াকোভস্কি’ ইত্যাদি তকমার রাজনৈতিক ব্যবহার হয়েছে।
এই কারণে সমাজতন্ত্রের পতনের পর তিনি এখন আর রাশিয়ায়ও প্রাসঙ্গিক বিবেচিত নন, পঠিতও নন। নতুন প্রজন্মের রাশান সাহিত্যের ছাত্ররা তাঁকে চিনে না। কবির ‘রাজনৈতিক ব্রান্ডিং’ যে কতোটা কুফলদায়ক, নজরুল তার প্রমাণ। যেহেতু সোভিয়েত তাঁকে গুরুত্ব দিয়েছিল,পশ্চিমে তাঁকে ধরা হয়েছিল রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী ও ব্রাত্য। পশ্চিমের সেই দেখার চোখ এখন বদলাতে পারে। কিন্তু আমাদের চেষ্টা কোথায়?
গবেষণার কথা বলছি না। ইংরেজিতে গবেষণা কিছু তো আছে অবশ্যই। দুঃখজনকভাবে সেগুলোর ৯৫-৯৮ ভাগই বাংলাভাষীদের করা, এবং নতুনত্বহীন ও বৈচিত্র্যহীন। অক্সফোর্ড ইন্ডিয়া হতে প্রীতি কুমার মিত্র’র ‘দ্যা ডিসেন্ট অব কাজী নজরুল ইসলাম : পয়েট্রি অ্যান্ড হিস্ট্রি’র মতো গবেষণাও সে রকম মাঝারি মানের এবং অনালোচিত। বরাবরের মতো তিনি বাংলাদেশি। সে হিসেবে আমাদের ‘জাতীয় কবি’ জিকির এবং বাগাড়ম্বরই সার। বাংলা একাডেমি, নজরুল ইন্সটিটিউট এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগগুলো কি কখনো চেষ্টা করেছে যাতে অক্সফোর্ড, ক্যাম্ব্রিজসহ নামকরা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিদেশিদের দ্বারা নজরুল অনুবাদ, প্রকাশনা ও আর্কাইভিংয়ের ব্যবস্থা হয়? না, করেনি!
নজরুলের সাহিত্যকৃতিকে বিশ্বসাহিত্যের ভান্ডারে অমূল্য সম্পদ হিসেবে জিইয়ে রাখার আন্দোলন চাইÑজাতীয় কবির জন্মদিনে এই আওয়াজটি তোলাই বেশি দরকারি নয় কি? ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :