শিরোনাম
◈ হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভক্তি প্রকট ◈ দুই দানব ব্ল্যাক হোলের খোঁজ পেল বিজ্ঞানীরা, কী ঘটছে মহাবিশ্বে? (ভিডিও) ◈ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২য় উচ্চতর গ্রেডে আইনি ছাড় ◈ বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা সুবিধা চালু করেছে মালয়েশিয়া ◈ শান্তির হ্যাটট্রিক, ভুটানকে সহ‌জেই হারা‌লো বাংলাদেশের মে‌য়েরা ◈ মেট্রো স্টেশনে বসছে এটিএম ও সিআরএম বুথ ◈ ১৬ই জুলাই রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা ◈ রহস্যময় নাকামোতো এখন বিশ্বের ১২তম ধনী, বিটকয়েন সম্পদ ১২৮ বিলিয়ন ডলার ◈ শাহবাগ মোড় অবরোধ করলো স্বেচ্ছাসেবক দল ◈ বিএসবির খায়রুল বাশারকে আদালত প্রাঙ্গণে ডিম নিক্ষেপ, কিল-ঘুষি

প্রকাশিত : ২৩ মে, ২০২১, ০৪:২১ সকাল
আপডেট : ২৩ মে, ২০২১, ০৪:২১ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

সুভাষ সিংহ রায়: জুলিও-কুরি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

সুভাষ সিংহ রায়: বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্বশান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে, শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে আসছে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ পরিহার করে বন্ধুত্বের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করে বিশ্বের সুনাম অর্জন করেন। আর বিশ্ব মানবতায় অবদান রাখার কারণে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করে। বিশ^শান্তি পরিষদের এ পদক ছিলো জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মান। মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে ভারত-সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭১ এবং বাংলাদেশ-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭২, বাংলাদেশের মৈত্রী-সম্পর্কে এই উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমন ও শান্তি স্থাপনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ এবং শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের নীতির ফলে বাংলাদেশ বিশ্ব সভায় একটি ন্যায়ানুগ দেশের মর্যাদা লাভ করে। সবার প্রতি বন্ধুত্বের ভিত্তিতে বৈদেশিক নীতি ঘোষণা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’

সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্বশান্তি পরিষদের  প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্বশান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন ২৩ মে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদান করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।’

বঙ্গবন্ধুর সৃজনশীল কুটনৈতিক দক্ষতায় ১৯৭৪ সালে ১৭ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে এবং ২৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংঘের ২৯ তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন । সেখানে তিনি বিশ্ব শান্তির কথা স্পষ্ট করে বলেছিলেন ।

আমাদেরকে সক্ষম করিয়া তুলিবে এবং সক্ষম করিয়া তুলিবে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারির বিরুদ্ধে লড়াই করিবার জন্য আমাদের সকল শক্তি ও সম্পদকে সমাবেশ ও কেন্দ্রীভূত করিতে। এই ধারণা হইতে জন্ম নিয়াছে শান্তির প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি। এই জন্য সমঝোতার অগ্রগতি, উত্তেজনা প্রশমন, অস্ত্র সীমিতকরণ এবং শান্তিপূর্ণসহ অবস্থান নীতির সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা-বিশ্বের যে কোনো অংশে যেকোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হোক না কেন, আমরা তাহাকে স্বাগত জানাই। এই নীতির প্রতি অবিচল থাকিয়া আমরা ভারত মহাসাগরীয় এলাকা সম্পর্কে শান্তি এলাকার ধারণা, যাহা এই পরিষদ অনুমোদন করিয়াছে, তাহাকে সমর্থন করি।

চুয়াত্তর-এ সদস্যপদ প্রাপ্তির ঠিক এক সপ্তাহ পর ২৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; যা বাংলায় ছিল। ৪৫ বছর আগের সেই ভাষণে বিশ্বকে মানবিক ঐক্যবোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধের পুনর্জাগরণে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার স্বীকৃতি প্রদান করে মানব সভ্যতাকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার যুক্তিপূর্ণ সমাধান ও জরুরি কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন জাতির জনক। তার ভাষায়, (কোট): ‘শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য, তা এই উপলদ্ধি থেকে জন্মেছে যে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সকল সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হব।’ আজ বোঝা যায়, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে আজ অবধি বাংলাদেশের যে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬১৬ জন সদস্য অংশ নিয়েছেন; তার বীজ বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের বক্তৃতার মধ্যেই রোপন করেছিলেন।

জাতির পিতা সেদিন শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের সব দেশের কল্যাণের কথা তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক অর্থ-ব্যবস্থার কথাও বলে। তার ধারণা ছিল, ন্যায়সঙ্গত অর্থ-ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলেই বিশ্বের সকল দেশের সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বাস্তব কাঠামো গড়ে উঠবে। বোধ করি বঙ্গবন্ধুর সেই দূরদর্শী চিন্তা চার দশক পরও বিশ্ব বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

এসব আমাদের গৌরবের কথা; যার সবই সম্ভব হয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্য। সত্যি বলতে কী, গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে উঁচু বঙ্গবন্ধুর ভাবনাটা সাধারণ ছিল না। তিনি শুধু নিজ দেশের বাঙালি কিংবা এশিয়ার মানুষ নিয়ে ভাবতেন না; ভাবতেন সমকালীন মানবজাতির কল্যাণ নিয়ে। সেই কথা তিনি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলে গেছেন। লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি।..... এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

আগামী ২৩ মে থেকে তিন দিনব্যাপী এশীয় শান্তি সম্মেলন শুরু হবে। ঢাকার শেরেবাংলা নগরে ওইদিন সকাল সাড়ে ৯টায় এই সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বশান্তি পরিষদ এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে। সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করা হবে। বঙ্গবন্ধু এশিয়ার দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি এই পদকের অধিকারী হলেন। এর আগে ভারতের নেহেরু আন্তর্জাতিক এই শান্তি পদক লাভ করেন। বিরোধী সংগ্রামে সোচ্চার কণ্ঠস্বরে উচ্চকিত এই চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের পথ আছে বাধা, আছে বিঘ্ন, আছে ঝড়, আরও আছে রক্তের সিঁড়ি পথ। এই পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এভাবেই আলোর পথের যাত্রীরা এগিয়ে যাবে। এগিয়ে যাবে শোষণমুক্ত সুনিশ্চিত শান্তির সন্ধানে।

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ রচনার দিন-সূর্য সারথির মহাসম্মেলনে। শান্তি সম্মেলন মানে বাংলাদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক শান্তিকর্মী সমাবেশ। এ সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকে সম্মানজনক জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করা হবে। শেখ মুজিব একটি নাম, একটি সংগ্রাম, একটি ইতিহাস- বাংলাদেশের মহান নায়ক। বিশ্বশান্তি সংগ্রামের অগ্র সেনানী, বিশ্বশান্তি পরিষদ যোগ্যতর ব্যক্তিকেই মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। শান্তি সম্মেলন আয়োজন আমাদের জাতীয় জীবনে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম এতে স্বাগত জানাবে।

এশিয়ায় শান্তি সম্মেলনের এটাই হচ্ছে সত্যিকারের পটভূমি। পিন্ডির ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিয়ে শ্যামল বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার ছাড়পত্র ছিনিয়ে এনেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এশিয়ার বুকে আরেকটি স্বাধীন সার্বভৌম শান্তিকামী প্রগতিশীল রাষ্ট্রের জন্ম।

জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতির ওপর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত, এই অবস্থানের নিভৃতে আমরা বিশ্বাসী। আমাদের মুক্তি আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই আমরা বিশ্বশান্তি পরিষদের সক্রিয় সমর্থন করছি। এর সঙ্গে মানুষের ব্রাহ্মণচৌরপিশাচ কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়