সাকিব এ চৌধুরী: তৃণমূলের বিশাল জয়ের পর নতুন করে অনেকের মাঝে আশা জাগছে ভারতবর্ষে বাঙালী প্রধানমন্ত্রীর । মমতা ব্যানার্জিকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ ইতিমধ্যে এই স্বপ্ন শক্ত করেই দেখতে শুরু করছি । কেনই বা দেখবে না দেখার অনেক বাস্তবতাও রয়েছে তেইশকে কেন্দ্র করে । তেইশে কি হবে কিংবা কি হতে যাচ্ছে সেই আলোচনা নাহয় তোলা থাক । কিন্তু একথা জানা দরকার বাংলা ভাষা ব্যবহারকরীদের যে আজকেই এই ভারতে একদা এক সময় একজন বাঙালীকে প্রধানমন্ত্রীত্বের চেয়ারে বসানোর সুযোগ আসলেও সেসময় তা আর হয়ে উঠে নি । ফেসবুক থেকে
জ্যোতি বসু। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর ৯৬ বছরের জীবনে রাজনীতির ভরকেন্দ্র ছিল পশ্চিমবঙ্গ। অথচ বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বসবাসকারী ভারতীয় তাঁকে চেনেন এক ডাকে। চেনেন কারণ, একটানা সাড়ে ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রিত্বের রেকর্ড, আঞ্চলিক স্তরে রাজনীতি করেও দেশের সংসদীয় রাজনীতির ময়দানে নিজেকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাওয়া, সর্বোপরি প্রকৃত রাজনৈতিক স্টেটসম্যান হওয়া— ভারতীয় রাজনীতিতে হাতে গোনাদের একজন।
কলকাতায় জন্মালেও তাঁর আদি বাড়ি ছিল ঢাকার বারদিতে বর্তমানে এটি নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁও। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা শেষ করে বিলেত যান ব্যারিস্টারি পড়তে। সেখানেই কমিউনিস্ট পার্টিতে হাতে খড়ি। ১৯৪০-এ দেশে ফিরে ব্রিফকেস হাতে নিতে আদালতে দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু হলেন কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী। তাঁর বাগ্মিতা, ব্যক্তিত্ব- এমনই ছিল যে স্বাধীনতার আগে, ১৯৪৬ সালেই ভোট জিতে বিধানসভায় যান তিনি। ১৯৪৬-২০০১, এর মধ্যে ’৭২-’৭৭ বাদ দিলে ৫০ বছর রাজ্য বিধানসভায় তিনিই ছিলেন মুখ্য চরিত্র। বিধানচন্দ্র রায় থেকে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়— বিরোধী হয়েও জ্যোতি বসুতে মুগ্ধ, মোহিত ছিলেন।
বর্তমান দেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সময় তিনি আজও প্রাসঙ্গিক। ইতিহাস বলছে, ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙলো কর সেবকরা। তারপরে কলকাতার একটি অংশে দাঙ্গা হলেও তা ছড়িয়ে পড়তে পারেনি জ্যোতি বসুর নেতৃত্বের জন্য। প্রয়াত অটলবিহারী বাজপেয়িকে তিনিই বলতে পেরেছেন, বিজেপি একটা অসভ্য, বর্বরের দল।
এমন এক কিংবদন্তিকে কেন তাঁর দল প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি, জ্যোতি বসুর মৃত্যুর এত বছর পরেও সেই প্রশ্ন খোঁচা দেয় বঙ্গবাসীকে। ভারতীয় রাজনীতিতে জ্যোতি বসুর মতো ব্যক্তিত্বের গুরুত্ব বিরোধীরা বুঝতে পারলেও কেন তাঁর দল বুঝতে পারল না, এত বছর পরে সেই প্রশ্ন উঠেছে তাঁর দলের মধ্যেই। বিশেষত সিপিএম যখন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ থেকে সংসদীয় রাজনীতিতে সরে এসেছে বহুকাল আগেই। দলের একাংশের ব্যাখ্যা, জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলে গোটা দেশে সিপিএমের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেত। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও ত্রিপুরার বাইরে, বিশেষত হিন্দি বলয়ের কয়েকটি রাজ্যে সরকার গঠনের সম্ভাবনা তৈরী হত। কিন্তু সেই সুযোগ বিবেচনা না করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দল। যার পরিণতিতে এখন প্রায় দুরবিন দিয়ে সিপিএমকে খুঁজতে হচ্ছে।
বারবার তিনবার। ১৯৯০, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬। এক বঙ্গ সন্তানের কাছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল। কিন্তু দল তাকে হতে দেয়নি।
সময়টা ১৯৯০। গত দেশে অস্থির অবস্থা। এমন এক সময়ে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আহ্বান জানান প্রয়াত রাজীব গান্ধী। পরের বছর একই অনুরোধ আসে সেই রাজীবের থেকেও। এবারেও ‘না’ বলে দেয় দল। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের প্রাক্তন প্রধান, কেন্দ্রের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রাক্তন বিশেষ সচিব অরুণ প্রসাদ মুখার্জির আত্মজীবনীতে এই তথ্য মিলেছে। পরে প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এই ঘটনার কথা স্বীকার করেন। শেষের অনুরোধটা ছিল ১৯৯৬ সালে। কেন্দ্রে তখন বাজপেয়ীর ১৩ দিনের সরকার পড়ে গেছে। বিরোধী ইউনাইটেড ফ্রন্ট জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আর্জি জানান। কংগ্রেস সমর্থন করে। এবারেও ‘না’ বলে দেয় দল। রাজনীতিতে বরাবর ভদ্রলোক বলে পরিচিত জ্যোতি বসু সেই একবারই দলের শৃঙ্খলা ভেঙে বলেছিলেন, এটা ঐতিহাসিক ভুল।
কোনো বাঙালির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন যেন ওখানেই শেষ হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের আর এক বঙ্গ সন্তান, প্রণব মুখোপাধ্যায় বরাবর দিল্লিতে রাজনীতি করেছেন। একসময় সরকারের দ্বিতীয় ছিলেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে বিভিন্ন সময় চর্চা হয়েছে। বাঙালির একটা অংশ এমন স্বপ্নও দেখতেন। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রী হননি, হয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
সিবিআইয়ের প্রাক্তন নির্দেশক অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা বই 'আননোন ফ্যাসেটস অফ রাজীব গান্ধী, জ্যোতি বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত' থেকে জানা যাচ্ছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য। তিনি লিখেছেন, ১৯৯০ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে বিশেষ সচিব পদে থাকার সময় রাজীব গান্ধী একদিন ডেকে পাঠান। বলেন, জ্যোতিবাবুর সঙ্গে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করতে। কথাও হয়। কিন্তু, গোটা ব্যাপারটি জ্যোতিবাবু ছেড়ে দেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির ওপর। কেন্দ্রীয় কমিটি ভেটো দিয়ে দেয়। ফাঁকতালে চন্দ্রশেখর প্রধানমন্ত্রী হন। আবার সুযোগ আসে ১৯৯১ সালে। চন্দ্রশেখরের পতনের পর ফের তৎপর হন রাজীব। তৎকালীন বাম সাংসদ বিপ্লব দাশগুপ্তের বাড়িতে একটি বৈঠকও হয়। রাজীব গান্ধী ব্যক্তিগত দূত পাঠিয়েছিলেন। যথারীতি জ্যোতি বসু দলের ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দেন, দল ভেটো দিয়ে দেয়। এর পর ১৯৯৬ সালের ঘটনা তো সবার জানা!
বইয়ে অরুণপ্রসাদবাবু দাবি করেছেন, তিনটি পর্বের সাক্ষীই তিনি নিজে। জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হত। তাঁর নিজের কথায়, "তিনজন তিন ধরনের ছিলেন। জ্যোতি বসু ছিলেন দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, রাজীব গান্ধী আপাদমস্তক ভদ্র আর ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত সোজাসাপটা কথা বলতেন। কিন্তু, কাজের সুবাদে তিনজনকেই কাছ থেকে দেখেছি। ওঁরা আমাকে বিশ্বাস করতেন। ওঁরা আমার সততার কথা জানতেন।"
এই বই সম্পর্কে লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও বহিষ্কৃত সিপিএম নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, "আমি জ্যোতিবাবুর 'ঐতিহাসিক ভুল' উক্তির সঙ্গে একমত। ওই ভুল না হলে দেশের ইতিহাস অন্য রকমভাবে লেখা হত। এখন দলটার কী অবস্থা দেখুন। রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।"
উল্লেখ্য জ্যোতি বসু ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি মৃ্ত্যুবরণ করেন এবং তার মৃত্যুর পশ্চিম বাংলায় তার দল সিপিএম ভোটের রাজনীতিতে বেশ খারাব অবস্থায় আছে ।
সূত্র : দৈনিক জাগরণ । ওয়ান ইন্ডিয়া । গনশক্তি.কম