রাজেকুজ্জামান রতন: আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল আকাক্সক্ষাাটাই ছিলো সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক ন্যায্যতা। এসব সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে, সমাজে শ্রমিকদের ওপর শোষণ থাকবে না, এটাই ছিলো প্রত্যাশা। শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরি থাকবে, কোনো ধরনের বঞ্চনা থাকবে না এবং শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার সংকোচিত হবে না। স্বাধীনতার শুরু থেকে এই আকাক্সক্ষা অনুযায়ী দেশে পরিচালিত হবে এমন প্রত্যাশা ছিলো। স্বাধীনতার পর পরই আইএলও কনভেনশনে বাংলাদেশ অনুসমর্থন করে। সেখানে বলা হয়েছিলো, শ্রমিকরা স্বাধীনভাবে সংগঠন করতে পারবে। পছন্দমতো নেতা নির্বাচন করতে পারবে এবং তারা তাদের মজুরির জন্য দরকষাকষি করতে পারবে। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে। এখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর আমরা দেখি বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে য্ক্তু শ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ৫-৬ শতাংশ। প্রতিষ্ঠনভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন আছে মাত্র ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের ৮৯ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। তাদের কোনো নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টা ও মজুরি নেই। কাজের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নেই।
স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার সঙ্গে মে দিবসের প্রেরণা ছিলো ৮ ঘণ্টা কাজ করা। এই কাজে এমন মজুরি দেওয়া হবে যে ৮ ঘণ্টা কাজ করে ৮ ঘণ্টা বিনোদনের নিশ্চয়তা পেতে পারে। মে দিবসের ১৩৫ বছর পরে বাংলাদেশে আমরা দেখছি ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস শুধু সরকারি কর্মচারীদের ছাড়া আর কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আন্দোলন করেছিলো যে শ্রমিক শ্রেণি তাদের জীবনে কর্মঘণ্টা বলতে কিছু নেই। তাদের মজুরি এতো কম যে সংসার চালানোর প্রয়োজনে তাদের বাধ্য হয়ে ওভারটাইম করতে হয়। আমাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাদ্য শ্রমিকরা করোনাকালে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে, তবু তাদের জন্য কোনো ঝুঁকি ভাতা ছিলো না। মে দিবসের মূল উদ্দেশ্য ছিলো ৮ ঘণ্টা কাজ করা। সেই কাজের অন্তরালে তাদের মূল দাবি ছিলো ন্যায্য মজুরি এবং এর সঙ্গে দাবিটা ছিলো শ্রমিক হিসেবে মর্যাদা। আজকে বাংলাদেশে অন্তত ৪৩টি খাতে যে মজুরি বোর্ড আছে সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর। ধার্য ন্যূনতম মজুরি বলতে কিছু নেই। ফলে অসহায় শ্রমিকদের যেকোনো পরিস্থিতিতে যে কোনোভাবে কাজ করতে বাধ্য করা হয় এবং নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টাও থাকে না। পবিবহন, নির্মাণ, শিপ ব্রেকিং, শিপ বিল্ডিং এর শ্রমিকরা যেমন আছে, দোকান ও হোটেল কর্মচারী ঠিক তেমনি আমাদের বিউটি পার্লারে কর্মরত, আমাদের পর্যটনে কর্মরতসহ সবমিলিয়ে বাংলাদেশে ৬ কোটি ৮২ লাখ শ্রমশক্তি পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা শ্রমশক্তি হিসেবে তারা বিবেচিত। তাদের জীবন ও জীবিকার সংঘাতটা এতো তীব্র যে কাজের প্রয়োজনে এবং একটু ভালো মজুরির আশায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের বাহিরে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব।
মে দিবসের এই সময়ে আমরা দেখছি যে আমাদের প্রতিটি সেক্টরে কাজের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা বলতে কিছু নেই। যেকোনো সময় ছাঁটাই, নির্যাতন নিপীড়ন যেমন আছে তার সঙ্গে সঙ্গে জীবনেরও নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নেই। কর্মক্ষেত্রে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকের মৃত্যু ঘটছে তেমনি কর্মঘণ্টা ও মজুরি চাইতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণের ঘটনাও ঘটছে। আজকের মে দিবস যখন আমরা পালন করছি তখন একই সঙ্গে কয়েকটি দাবি উত্থাপণ করতে হবে যে- ‘৮ ঘণ্টা কর্মদিবস নিশ্চিত করো’, ‘ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করো’, ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি অন্তত বিশ হাজার টাকা নির্ধারণ করো’, ‘করোনাকালীন সময়ে যারা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে তাদের জন্য ঝুঁকি ভাতার ব্যবস্থা করো’। শ্রমিকরা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ফ্রন্টলাইনার। শ্রমিক না হলে বিদ্যুৎ আসবে না, পানি আসবে না, রেল, বাস, ট্রাক চলবে না, রাস্তা নির্মাণ হবে না, সেতু কালবার্ড কিছুই নির্মাণ হবে না। সেই শ্রমিকদেরকে করোনার এই সময়ে শ্রমিকদেরকে ঝুঁকিভাতা ও করোনাকালীন সুরক্ষা দাও। করোনা মহামারির কারণে বেকার হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা দাও। এই দাবিগুলো এখন মে দিবসে আমাদের সামনে নতুন করে উত্থাপিত হয়েছে। পরিচিতি : কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাসদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমিরুল ইসলাম।
আপনার মতামত লিখুন :