শিরোনাম
◈ জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস মারা গেছেন ◈ ইরানের ইস্পাহান ও তাব্রিজে ইসরায়েলের ড্রোন হামলা, ৩টি ভূপাতিত (ভিডিও) ◈ ভেটোর তীব্র নিন্দা,মার্কিন নীতি আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লংঘন : ফিলিস্তিন ◈ স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের গল্প-প্রবন্ধ নিয়ে সাময়িকী প্রকাশনা করবে বাংলা একাডেমি ◈ দক্ষিণ ভারতে ইন্ডিয়া জোটের কাছে গো-হারা হারবে বিজেপি: রেভান্ত রেড্ডি ◈ ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত ◈ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংসদে আইন পাশ করব: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠক ◈ উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আওয়ামী লীগের ◈ বোতলজাত সয়াবিনের দাম লিটারে ৪ টাকা বাড়লো

প্রকাশিত : ২৯ এপ্রিল, ২০২১, ০৫:১১ বিকাল
আপডেট : ২৯ এপ্রিল, ২০২১, ০৫:১১ বিকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

শ্বেতপাথরে লেখা প্রেম ও অপ্রেমের কাব্য

আসাদুজ্জামান সম্রাট: করোনা আঘাত হেনেছে চিন ও থাইল্যান্ডে। সারাবিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন চিন। এমনই এক সময় ২০২০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগ্রার তাজমহল বেড়াতে গেলাম সপরিবারে। তার আগে আজমীরে খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (রা.) মাজার জিয়ারত করলাম। তাজমহলে বেড়াতে যাওয়ার কমন বিষয় হচ্ছে, ছবি তোলা। এখানে ছবি তোলার জন্য ইন্ডিয়ান আর্কিওলজি বিভাগের রেজিস্টার্ড ফটোগ্রাফার আছেন। আগ্রার তাজমহলের সামনে এমনই এক পেশাদার ফটোগ্রাফারের সামনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছবি তোলার জন্য পোজ দিচ্ছিলাম। বাচ্চাদের সাথে ছবি তোলা শেষে ফটোগ্রাফার বললেন, ‘স্যার আপনারা দু’জনে দাড়ান।’ কিভাবে দাড়াবো তার নির্দেশনাও দিচ্ছিলেন ফটোগ্রাফারটি। নির্দেশনা পেয়ে লিনা খুব খুশী। আবেগতাড়িত হয়ে আমাকে একটু জোরেই জড়িয়ে ধরলো। এভাবে অনেকগুলো ছবি তুললাম আমরা। ছবি তুলতে তুলতে বললাম, এতো জোরে চেপে ধরলা কেনো? তখন অন্য যুগলদের ছবি তোলার দৃশ্য দেখিয়ে বললো, ‘দেখো আমি তো কমই ধরেছি। প্রেমের তাজমহলে এসে ওরা কীভাবে প্রেমের জোয়ারে ভাসছে। আর তুমি সেই কাঠখোট্টাই রয়ে গেলে।’ আমি রোমান্টিক নই মোটেই এ অভিযোগ দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে শুনে এসেছি। তাই কানে না তুলে তাজমলের মূল অংশের দিকে অগ্রসর হলাম। দিনভর সেখানে ঘোরাঘুরি আর ছবি তুললাম।

যে যমুনা নদীর তীরে ‘প্রিন্স অব বিল্ডারস’ খ্যাত সম্রাট শাহজাহান তাজমহল গড়ে তুলেছিলেন-কালের বিবর্তনে সেটি এখন জীর্ন-শীর্ণ। একদা প্রমত্তা নদীতে পানির স্রোতের প্রবাহ কমে গেলেও তাজমহলের প্রেমের স্তুতি পৌঁছে গেছে বিশ্বের প্রতিটি আনাচ-কানাচে। প্রেমের উত্তাল মহাসমারোহের ভেতরেও কোথা থেকে যেন একটি কালো রঙের স্রোতও খুবই ক্ষীণ আকারে বহমান। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই ক্ষীণকায় স্রোতপ্রবাহ প্রেমের সেই বিশালাকার ধারার সঙ্গে কখনোই জয়ী হতে পারেনি। তাজমহল তাই তো এখন অসীম এক প্রেমের প্রতীক হিসেবে দাড়িয়ে আছে আপন মহিমায়। আমার স্ত্রী লিনার কাছেও তাই অমর প্রেমের প্রতীক এই তাজমহল। আর এ কারনেই আগ্রায় যাওয়া, তাজমহল দেখা তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। আমি এ নিয়ে তিনবার এসেছি আগ্রার তাজমহলে। ২০০৩ সালে দিল্লীতে একটি ট্রেনিংয়ের একটি অংশ হিসেবে তাজমহল দেখেছি প্রথমবার। আর ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়ে রাজস্থানের সংবাদ সংগ্রহ শেষে উত্তর প্রদেশে অবস্থিত তাজমহল দেখতে যাওয়া হয়েছিল। সে সময়ে আমার বড়ো ছেলে প্রিন্স দানিয়েল আমার সঙ্গে ছিল। লিনা ও দিয়ামের জন্য এটাই প্রথম তাজমহল দেখা।

আগ্রা দেখে বের হতে হতেই প্রায় চারশ’ বছর আগের গল্প বলছিলাম লিনাকে। ১৬৩১ সালের ১৭ জুন সন্তান প্রসবের পর তরতাজা রক্তের বন্যায় ভেসে যেতে যেতে একটু আগেই মারা গেলেন মাত্র ৩৮ বছর বয়সী রাজমহিষী আরজুমান্দ বানু বেগম। কদিন থেকেই শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। আগ্রা থেকে হাতির পিঠে দুর্গম পথে যাত্রা করে প্রায় ৫০০ মাইল অতিক্রম করে অতিমাত্রায় শ্রান্ত, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুর আগে ৩০ ঘণ্টা প্রসববেদনার নিদারুণ যন্ত্রণায় প্রতিটি মুহূর্তকে অসম্ভব দীর্ঘ মনে হচ্ছিল তাঁর। অবশেষে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু এসে তাঁকে চিরদিনের জন্য মুক্তি দিল। মৃত্যুর আগে সম্রাটকে উপহার দিয়ে গেলেন চতুর্দশ সন্তান। বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল লিনা। সে সময়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি না থাকার যুক্তি দেখিয়ে বলছিলেন, মুমতাজের প্রতি শাহজাহানের প্রেম কেমন ছিল জানিনা। তবে সারা বিশ্বের মানুষ তাজমহলকে প্রেমের প্রতীক মনে কওে, আমিও এর বাইরে নই। স্ত্রীর সঙ্গে বিতর্কে না জড়িয়ে মোবাইলে তোলা ছবিগুলোর দিকে মনোযোগী হলাম। আমাদের বড়ো ছেলে দানিয়েল আর ছোট ছেলে দিয়াম বড়ো হয়ে তাদের প্রেমিকা বা স্ত্রীদের নিয়ে এখানে আসবেন কি-না তা নিয়ে বিতর্কে জড়ালেন।

সম্রাট শাহজাহানের প্রধান উজির আবু হাসান আসফ খানের রূপসী কন্যা আরজুমান্দ বানু বেগম জন্মেছিলেন ১৫৯৩ সালের ২৭ এপ্রিল, আগ্রায়। তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এসেছিলেন ইরান থেকে। আরবি ও ফারসিতে চমৎকার দখল ছিল তাঁর। সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র, বাদশা আকবরের পৌত্র যুবরাজ খুররম প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়েন এই বিদুষী কিশোরীর। দুজনার মধ্যে বাগদান সম্পন্ন হয় ১৬০৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। যুবরাজ খুররমের বয়স ছিল তখন ১৫। আর আরজুমান্দ বানুর ১৪। তখনো যুবরাজ খুররমের নাম শাহবুদ্দিন মুহাম্মদ শাহজাহান হয়নি। আর আরজুমান্দের নাম হয়নি মুমতাজ মহল। বাগদানের পর বিয়ের জন্য দু’জনকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও পাঁচটি বছর। যুবরাজ খুররমের জন্য স্ত্রীবিহীন এত দীর্ঘ সময় কাটানো সম্ভব নয়। তাই তিনি এর মধ্যে বিয়ে করেন কান্দাহারি বেগমকে। কান্দাহারি বেগম যুবরাজের প্রথম স্ত্রী।

এদিকে আরজুমান্দ ও যুবরাজ খুররমের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে দরবারে সব খ্যাতিমান রাজজ্যোতিষীকে তলব করা হয়েছে। তাঁদের ঠিক করা দিনে, ১৬১২ সালের ১০ মে আরজুমান্দ বানু বেগমের সঙ্গে বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ অধিপতির দ্বিতীয় বিয়ে সম্পন্ন হয়। আরজুমান্দ বানু বেগমের বিয়ের পর তাঁকে অভিষিক্ত করা হয় ‘মুমতাজ মহল’ নামে। মুমতাজ মহল ছিলেন যুবরাজ খুররম যিনি পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান হয়েছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী, প্রথম এবং শেষ নন। দ্বিতীয় বিয়ের পাঁচ বছর অতিক্রান্ত না হতেই মুমতাজ মহলের বর্তমানে পুনরায় বিয়ে করেন যুবরাজ। খুররমের তৃতীয় জায়ার নাম ইজ-উন-নিসা বেগম। ১৯ বছর বয়সে বিয়ের পর ১৯ বছরের বিবাহিত জীবনে মোট ১৪ সন্তানের মা হন মুমতাজ মহল। আট পুত্র ও ছয় কন্যার মধ্যে সাত সন্তানেরই মৃত্যু হয় শিশু বয়সে। ১৪তম সন্তান ছিল কন্যাসন্তান, তাঁর নাম রাখা হয় গৌহর বেগম। জন্মের সময় তাঁর মা মারা গেলেও গৌহর বেগম বেঁচেছিলেন দীর্ঘ ৭৫ বছর। মুমতাজ মহলের মৃত্যু হয় মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুরে, আগ্রা থেকে প্রায় ৫০০ মাইল দূরে। সে বছর ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁকে অস্থায়ীভাবে জয়নবাদের বাগানে সমাধিস্থ করা হয়।

প্রিয়তমা স্ত্রীর মর্মান্তিক অকালমৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান প্রবল প্রতাপশালী সম্রাট। তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে দ্বিতীয়বারের মতো সমাধিস্থ করেন তাজমহলের এক কামরায়। ভালোবাসাকে বন্দী করেন শ্বেতপাথরের বিশাল অট্টালিকার চার দেয়ালে। কিন্তু এখানেই থেমে যাননি সম্রাট শাহজাহান। প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই মুমতাজের ছোট বোনের সঙ্গে বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কে জড়ান। প্রচলিত রয়েছে, তাকে বিয়েও করেছিলেন শাহজাহান। সন্তানদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্ধে চার জনের মৃত্যু হলে কিছুদিন পর সম্রাট নিজেই বন্দী হন তাঁরই ঔরসজাত পুত্র আওরঙ্গজেবের হুকুমে। বন্দী থাকাকালে ১৬৬৬ সালের ২২ জানুয়ারি ৭৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন সম্রাট শাহজাহান। তাজমহলের সৌন্দর্যের তোয়াক্কা না করে আওরঙ্গজেব প্রয়াত পিতাকে তাজমহলেই সমাহিত করেন।

পঞ্চম মোগল সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তমা স্ত্রী এবং ষষ্ঠ মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মা মুমতাজ মহলের জন্য এতটুকু পরিচয়ই যথেষ্ট ছিল। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে ভালোবাসার অনন্য এক নিদর্শন শ্বেতপাথরের বিশাল অট্টালিকা বুকে ধারণ করে এখনো বেঁচে আছেন মুমতাজ মহল লাখোকোটি প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তরে। ঐশ্বর্যে মোড়া সে জীবনের কাহিনি লেখা আছে তাজমহলের প্রতিটি পাথরে। কিন্তু ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবন কেমন ছিল? কতোটা সুখ নাকি যন্ত্রণায় ভরপুর ছিল সে জীবন। মিথ রয়েছে, মুমতাজের প্রতি সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসা ছিল বছর বছর বাচ্চা জন্ম দেয়া। যা একজন নারীর জন্য সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক। মুমতাজের মৃত্যুও হয়েছে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে। ফলে ভালোবাসার প্রশ্নে তৈরি হওয়া বিতর্ক ইতিহাসে রয়েই যাবে।

মোগল সম্রাটদের মধ্যে শাহজাহান ছিলেন সবচে’ বিলাসী। আকর্ষণীয় স্থাপত্যের প্রতি তাঁর শুধু ঝোঁকই ছিল না বরং তা রীতিমতো এক নেশায় পরিণত হয়েছিল। ফলস্বরূপ ভারতবর্ষজুড়ে গড়ে উঠেছিল এমন সব শৈল্পিক নিদর্শন, যা এখন পর্যন্তও ভ্রমণপ্রিয় মানুষের দৃষ্টিকে ভারতের দিকে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে। আজ ভারতে যে উগ্র হিন্দুত্ববাদের জন্ম হয়েছে তারা হয়তো জানেনই না ভারতের জিডিপির একটি বড়ো অংশ এখনও আসে এই মুসলিম স্থাপত্যকলার কারনে। ইউকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ইতিহাসের ধূসর পাতা সাক্ষ্য দেয় যে, তাজমহল নির্মাণের এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয় ১৬৩২ সালের শুরুতে। ১৬৪৭ (মতান্তরে ১৬৫৩)-এর দিকে বাস্তব রূপ লাভ করে শাহজাহানের স্বপ্নের স্থাপত্য। ২০ হাজার সুদক্ষ কর্মীর দেড় যুগ ধরে রাত-দিন চরম খাটুনির ফসল তাজমহল। তাজমহলের সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপারটি ঘটল এর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাহজাহানের সরাসরি নির্দেশে চোখের ওপর আঘাত করে চিরদিনের মতো অন্ধ করে দেওয়া হলো স্থপতিদের। পাশাপাশি যেসব শ্রমিকের পাথরভাঙা হাতে মস্ত বড় সেই তাজমহলের পত্তন ঘটেছিল, তাঁদের সবার হাতের আঙুল অত্যন্ত নির্মমভাবে কেটে ফেলা হলো।

শাহজাহানের যেমন শৈল্পিক একটি মন ছিল, তেমনি সেই শিল্পের জন্য অহংবোধও ছিল তাঁর প্রবল। পরবর্তী সময়ে যদি সেসব শ্রমিকের হাত ধরে তাজমহলের মতো অন্য কোনো অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনা পৃথিবীর কোনো প্রান্তে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে শাহজাহানের নাম অনেকটা স্তিমিত হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কায় এমন চরম বর্বরতার পথ বেছে নেন তিনি। তাজমহলে শ্বেতপাথরের ফলকে ফলকে জগদ্বিখ্যাত যে কারুকার্য খচিত রয়েছে, তাতে শুধু শ্রমিকের ঘাম নয়, মিশে আছে তাজা রক্তও। এসব চিত্র যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখন তাজমহলকে প্রেমের নিদর্শন বলতে গিয়ে দ্বিধাবোধ কাজ করলে তা নিশ্চয়ই খুব একটা অযৌক্তিক হবে না। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তাজমহলের গায়ের সে কারুকাজে হাত দিয়ে দেখেছি আমি। শ্বেতপাথরের উপর কী নিপুন কাজ। কিভাবে এটা সম্ভব হয়েছে তা আজও গবেষণার বিষয়।

তাজমহল নির্মাণের জায়গাটি মহারাজা জয় সিংহের সম্পত্তি। এই জমিটি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন সম্রাট শাহজাহান। তিনি মধ্য-আগ্রার একটি প্রকাণ্ড রাজপ্রাসাদের বিনিময়ে ওই জমিটি অধিগ্রহণ করেন। তারপরই কার্যত নির্মাণকাজ শুরু হয়। সেময় একযোগে কাজে নামে প্রায় ২২ হাজার নির্মাণ শ্রমিক। দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে কাজ শেষ করতে এত বেশি শ্রমিক কাজে লাগানো হয়। নির্মাণ সামগ্রী টেনে নিয়ে যেতে এক হাজারের বেশি হাতিও কাজে লাগানো হয়। অনেকেই হয়তো জানেন না, তাজমহলের জমিটি এখন যতটা উঁচু দেখা যাচ্ছে আসলে আগে এটি এমন ছিল না। তাজমহল যে জমির ওপর দাঁড়িয়ে সেই জমি ছিল খুবই নিচু। জায়গাটি এই বিশেষ সৌধ নির্মাণের উপযুক্ত করতে প্রচুর মাটি ফেলা হয়। সেই নিচু জমিকে যমুনা নদীর তীরের উচ্চতা থেকে প্রায় ৫০ মিটার বা প্রায় ১৬০ ফুট উঁচু করা হয়। এজন্য সেখানে অনেকগুলো পাতকুয়া খোঁড়া হয়। ভাবতে অবাক লাগে এই কৌশল এখনো ক্ষেত্র বিশেষে আধুনিক স্থাপত্য নির্মাণেও ব্যবহার করা হয়। তবে এই কুয়াগুলো অবশ্য প্রয়োজনীয় কাজ শেষে পাথর, বালি ও মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়।

তাজমহল নির্মাণের মূল নকশা তৈরি করেন ওস্তাদ আহমেদ লাহাউরী। সে সময় বেশিরভাগ মুঘল দালানই তৈরি হতো লাল বালু ও পাথর দিয়ে। তেমন কিছু নমুনা এখনো দেখতে পাওয়া যায়। যেমন হুমায়ুনের স্মৃতিসৌধ, জামে মসজিদ, তৈমুরের স্মৃতিসৌধ। সে দৃষ্টিকোণ থেকে তাজমহলের একটি বিশেষ দিক রয়েছে। তাজমহল নির্মাণে শাহজাহান প্রথম শ্বেতপাথর ব্যবহার করেন। শ্বেতপাথরের সৌধ হিসেবে তাজমহলের গুরুত্ব যে কাউকে আকৃষ্ট করে। এটি শুধু এখনই নয় সে সময়েও গোটা ভারতবর্ষের মানুষ কৌতূহলী হন। ১৬৪৮ সালে এই স্মৃতিসৌধের প্রাথমিক নির্মাণকাজ শেষ হয়। সে হিসাবে প্রাথমিক কাজেই লাগে ১৭ বছর। নির্মাণকাজ শেষ হলেও এর সৌন্দর্যবর্ধন চলতে থাকে। আশপাশের বাকি কাজুবাগান, তিন দিকের তিনটি প্রবেশদ্বার পুরোপুরি শেষ হতে আরও পাঁচবছর সময় লাগে। তাজমহলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের দেখা মিললেও এই সৌধ নির্মাণে বিভিন্ন ধর্মের স্থাপত্যের ছোঁয়া দেখা যায়। যেমন তাজের মাথার ত্রিশূলটি হিন্দুদের শিবমন্দিরের অনুকরণে, মুসলমানদের মসজিদের মতো করা হয় তাজমহলের চারটি মিনার ও মাথার গম্বুজ। আর এ কারনেই উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তাজমহল হিন্দু স্থাপত্য বলে দাবি করে থাকেন।

তাজমহল ছিল প্রকাণ্ড এক নির্মাণযজ্ঞ। এটির বিশেষত্ব ও গুরুত্ব দেখা যায় তাজমহলের নির্মাণ সামগ্রী আয়োজনে। তাজমহলের শ্বেত পাথর আনা হয়েছিল সুদূর রাজস্থানের মাকরানা থেকে। পান্না আসে পাঞ্জাব থেকে, চীন থেকে স্ফটিক, তিব্বত, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কা থেকে আসে নানা ধরনের নীলকান্তমণি। মোট ২৮ ধরনের দুষ্প্রাপ্য দামি পাথর পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে আনা হয় শ্বেতপাথরের গায়ে বসানোর জন্য। তাজমহলের এই অসাধারণ কীর্তি শুধু ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দ্বারাই নির্মিত হয়। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিশেষজ্ঞদেরও আনা হয়েছিল নানা কাজের জন্য। ভাস্কররা আসেন বুখারা থেকে, হস্তাক্ষর শিল্পীরা আসেন সিরিয়া এবং পারস্য থেকে, রত্নশিল্পীরা আসেন উত্তর ভারত থেকে, মণিকারেরা আসেন বালুচিস্তান থেকে। তাজমহলের মূল আকৃতি অষ্টকোণী। তবে তাতে লোহার কাঠামো ব্যবহার করা হয়নি। পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে নির্মিত হয় এই সৌধ। যে কাউকে বিস্মিত করবে এর মাথার ওপরকার গম্বুজের কারুকাজ। এতেও কোনো লোহার কাঠামো নেই। ছোট একটি বৃত্তের মতো পাথর সাজিয়ে তার ওপর পাথর সাজিয়ে চলা এবং তার পরিধি প্রথমে ক্রমাগত বাড়িয়ে তারপর কমিয়ে গম্বুজটি নির্মিত। তাজমহলের প্রতিটি ভাস্কর্য এবং তার নকশা একেবারে সমান মাপের। অথচ তখন সব কাজই করা হতো হাতে। এমনকি ছাঁচের ব্যবহারও ছিল না। তাও সব নকশাই সমান। এ ছাড়া তাজমহলের চারদিকে অনেকগুলো আর্চিংয়ের কাজ করা খিলান রয়েছে। যাকে বলা হয় ইয়ান। এই ইয়ানের চারপাশে পবিত্র কোরআন ও ধর্ম প্রচারের নানা বাণী খোদাই করা আছে।

সাধারণভাবে আমরা কাছের জিনিস আমরা বড় দেখি আর দূরের জিনিস ছোট। কিন্তু তাজমহলের ইয়ানের একেবারে মাথার ওপরের শিলালেখা যা ছোট হওয়া স্বাভাবিক ছিল তাও কিন্তু সমান আকারে নজরে পড়ে। এর কারণ নিচের হরফের তুলনায় উপরের হরফ বেশ বড়। সেগুলো এমনভাবেই ক্রমাগত নিচ থেকে উপরে বড় করা হয়েছে যে নিচে দাঁড়িয়েও সব কটি হরফ এক মাপের বলে মনে হয়।

তাজমহলের সৌন্দর্য বর্ধনে এই শিলালিপিতে ব্যবহৃত হয় পবিত্র কোরআন থেকে উদ্ধৃত বাণী। এই শিলালিপি কিন্তু রং দিয়ে লেখা নয়। প্রথমে শ্বেতপাথরের ওপর হরফাকৃতি খোদাই করা। তারপর সেই খোদাই করা জায়গায় সমান মাপের কালো পাথর কেটে বসিয়ে সেই বাণী লেখা। তাজমহলের অন্তর্সজ্জাও দারুণ। পাথরের পলিশ এতই উঁচুমানের যে, তার থেকে আলো প্রতিফলিত হয়। সমাধির ঠিক উপরের তলায় একটি কৃত্রিম সমাধি আছে। লোকে সেই সমাধিই দেখে। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ হলেও দানিয়েল অটো সাটার অন করে বুক পকেটে মোবাইল রেখে ছবি তুলে। পুরো তাজমহল ১৮০ ফুট উঁচু যার প্রধান গম্বুজটি ২১৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট চওড়া এবং এর চারপাশে চারটি মিনার আছে যার প্রতিটির উচ্চতা ১৬২.৫ ফুট। পুরো কমপ্লেক্সটির আকার ১৯০২ বাই ১০০২ ফুট। শুধু তাজমহলটি ১৮৬ বাই ১৮৬ ফুট মার্বেল পাথরের ওপর নির্মিত। এর প্রধান প্রবেশদ্বার ১৫১ বাই ১১৭ ফুট চওড়া এবং ১০০ ফুট উঁচু। তাজমহল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের রঙ ধারণ করে। সকালে গোলাপি বর্ণের, বিকালে দুধের মতো সাদা বর্ণের এবং রাতে চাঁদের আলোতে সোনালি বর্ণ ধারণ করে। অনেকের মতে, মেয়েদের মন যেমন ক্ষণে ক্ষণে বদলায় তার ওপর নির্ভর করে তাজমহলের রঙ করা হয়েছে। এটি না-কি সম্রাট শাহজাহানের পরিকল্পনা ছিল।

তাজমহলকে ঘিরে আরো কিছু বিতর্ক রয়েছে। বলা হয়েছে, সম্রাট শাহজাহান আরেকটি কালো তাজমহল নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। ফরাসি পর্যটক জ্যঁ ব্যাপটিস্ট টাভারনিয়ার ১৬৪০ ও ১৬৫৫ সালে মুঘল রাজধানী আগ্রায় ভ্রমণে এসে তার ভ্রমণ কাহিনীতে তিনি লিখেন, সম্রাট শাহজাহান যমুনার অপর পাড়ে নিজের সমাধিক্ষেত্রের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিজের ছেলেদের সঙ্গে লড়াই শুরু হওয়ায় তিনি তা শেষ করতে পারেননি। স্থানীয় লোককথায় এর কিছুটা প্রমাণ মেলে। শাহজাহান নাকি যমুনার ওপর একটি সেতু বানিয়ে নদীর দুই পাড়ে নিজের ও স্ত্রীর সমাধিকে সংযুক্তও করতে চেয়েছিলেন। কালো তাজমহলের মিথ আরও ঘনীভূত হয় ১৯ শতকে এসিএল কারলেইলি নামের এক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ যমুনার পাড়ে একটি পুকুরে কালো মার্বেল খুঁজে পাওয়ার দাবি করার পর। পরে অবশ্য দেখা যায় এটি আসলে সাদা মার্বেলই ছিল। দীর্ঘদিন মাটির নিচে পড়ে থাকায় তা কালো হয়ে গিয়েছিল। গবেষকদের মতে, শাহজাহান তার প্রপিতামহ সম্রাট বাবরের তৈরি মাহতাব বাগকে সংস্কার করে তাজমহল কমপ্লেক্সের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে স্থপতিদের অনুরোধ করেছিলেন। এটাই নাকি পরিকল্পিত দ্বিতীয় বা কালো তাজমহল নির্মাণের স্থান। তাজমহলের মধ্যে শাহজাহানের সমাধিটির অবস্থান বিবেচনা করলেও এটা বোঝা যায় যে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে একই সমাধিতে সমাহিত হতে চাননি। কেননা, পুরো তাজমহলের নকশায় চূড়ান্ত রকমের প্রতিসাম্য থাকলেও শাহজাহানের সমাধিটি সমাধিঘরের পশ্চিম দিকের দেয়ালের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনভাবে বানানো। কিন্তু মমতাজ মহলের সমাধি ওই ঘরের ঠিক মাঝখানে। এসব তথ্য-উপাত্ত আর বর্ণনায় মনে হতেই পারে যে শাহজাহান আরেকটি কালো তাজমহল বানাতে চেয়েছিলেন নিজের সমাধির জন্য। কিন্তু ইতিহাসবিদরা সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। কেননা, কেবল ফরাসি পর্যটক টাভারনিয়ারের লেখা ছাড়া আর কোথাও এমন দাবির পক্ষে প্রমাণ মেলেনি।

২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রতিক সময়ে তাজমহলকে ঘিরে আরেকটি বিতর্ক শুরু হয়েছে। একজন ভারতীয় এমপি এবং কিছু ডানপন্থী গোষ্ঠী দাবি করছে তাজমহল ছিল একটি হিন্দু মন্দির। ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির ভিনয় কাটিয়ার তাজমহলের নাম বদলে ‘তেজো মহল’ রাখার দাবি জানিয়েছেন সরকারের কাছে। তিনি বলছেন, একজন হিন্দু শাসক তাজমহল তৈরি করেছেন। ভারতের গণমাধ্যমে তার এই দাবি ব্যাপক প্রচার পায়। অনেক ডানপন্থী গোষ্ঠী তাঁর এই দাবি সমর্থন করে। তবে বিবিসির 'রিয়েলিটি চেক' অনুসন্ধান টিম দীর্ঘ অনুসন্ধান করে জানিয়েছে, এই দাবির পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য কোন প্রমাণ নেই। বরঞ্চ ইতিহাসবিদদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, এমনকি ভারত সরকার পর্যন্ত মনে করেন, এই সৌধ ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন।

তাজমহলকে কেন্দ্র করে ভালোবাসার অংশটুকুই বড় ছিল, নাকি ঘৃণার-এ বিতর্ক হয়তো চিরকাল থাকবে। থাকবে নানা যুক্তিতর্ক, আর তর্কের খাতিরেই সৃষ্টি হবে নিত্যনতুন বিতর্ক। মূলত এসব বিতর্কও একধরনের সৌন্দর্য। বিতর্ক আছে বলেই তো তার প্রতি গোটা দুনিয়ার আকর্ষণও আছে, যে আকর্ষণের ইশারায় সাড়া দিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ ছুটে যায় আগ্রার যমুনার তীরে। অনেক লেখক, সাহিত্যিক ও কবি লক্ষ কোটি শব্দে সাহিত্য রচনা করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাজমহলের রুপে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন-
‘হীরামুক্তামাণিক্যের ঘটা
যেন শূন্যদিগন্তের ইন্দ্রজাল ধনুচ্ছটা,
যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক,
শুধু থাক একবিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল।’
বাঙালিদের ভালোবাসার সৌন্দর্য শেখানো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন তাজমহলকে এভাবে বর্ণনা করেন তখন শাহজাহানের ভালোবাসার তীব্রতার কথা সামান্য হলেও আমরা অনুধাবন করতে পারি। তাই তিন তিনবার তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে কবিগুরু ধ্রুব সত্যটিই বলেছেন। শুধু কবিগুরু নয়, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন-
‘তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখেছ কি তার প্রাণ?
অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরেতে সাজাহান।’
বাদ যাননি আমার বাড়ির কাছের ‘রূপসী বাংলা’র কবি জীবনানন্দ দাশ-ও। তিনি তাঁর ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতায় লিখেছেন-
‘জেগেছে নবীন মোগল-দিল্লী-লাহোর-ফতেহ্পুর,
যমুনা জলের পুরনো বাঁশীতে বেজেছে নবীন সুর?
নতুন প্রেমের রাগে
তাজমহলের অরুণিমা আজও উষার অরুণে জাগে।’

লেখক: আসাদুজ্জামান সম্রাট, নগর সম্পাদক-দৈনিক আমাদের অর্থনীতি ও সম্পাদক-পার্লামেন্ট জার্নাল

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়