শিরোনাম
◈ যুদ্ধ বন্ধের শর্তেই ইসরায়েলি জিম্মিদের ছাড়বে হামাস ◈ হরলিক্স আর স্বাস্থ্যকর পানীয় নয়  ◈ বাংলাদেশে চিকিৎসা সুবিধায় থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী ◈ থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে  প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ আন্তরিক অভ্যর্থনা ◈ যে কোনো ভিসাধারী পবিত্র ওমরাহ পালন করতে পারবেন  ◈ পাটগ্রাম সীমান্তে বিএসএফে'র গুলিতে বাংলাদেশি নিহত ◈  কমবে তাপমাত্রা, মে মাসেই কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টির সম্ভাবনা ◈ বাংলাদেশ-চীন সামরিক মহড়া মে মাসে, নজর রাখবে ভারত ◈ দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু: চুয়েটে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত, যান চলাচল শুরু ◈ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ভারত, চীন বা রাশিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত নয়: মার্কিন কর্মকর্তা

প্রকাশিত : ২৯ এপ্রিল, ২০২১, ০৪:১৩ সকাল
আপডেট : ২৯ এপ্রিল, ২০২১, ০৪:১৩ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বড় নদীর দূষণ পৌঁছে গিয়েছে প্রায় সব নদীতে

নিউজ ডেস্ক: ঢাকার হাজারীবাগ, তেজগাঁও ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরার নদী রক্ষা বাঁধ ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের প্রায় সাত হাজার কারখানা। এসব শিল্প-কারখানার শিল্পবর্জ্য সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। বুড়িগঙ্গা থেকে এ শিল্পবর্জ্য গিয়ে মিশছে তুরাগ, টঙ্গী খাল, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীতে। এর বাইরে রাজধানীর গৃহস্থালি বর্জ্যেরও গন্তব্য হচ্ছে বুড়িগঙ্গা। কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই এসব বর্জ্য এসে নদীটিতে মিশছে। সেখান থেকে তা আবার বিভিন্ন মাত্রায় ছড়াচ্ছে আশপাশের অন্যান্য নদীতে।

একইভাবে দূষিত হচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলীও। আর এ দূষণ বিভিন্ন মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী হালদা, বাকখালী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, নাফ, কাসালং ও চিংড়ি নদ-নদীতে। কর্ণফুলীর দূষণ ছড়িয়েছে বঙ্গোপসাগরেও। করতোয়া, তিস্তা, আত্রাই, পদ্মাসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান-অপ্রধান নদ-নদীগুলোর স্বাস্থ্যও খুব একটা ভালো নয়। নানা মাত্রার দূষণের হাত থেকে রেহাই পায়নি এসব নদীর কোনোটিই।

সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদীর পানিতে ১১ ধরনের ক্ষতিকর ধাতুর দেখা মিলেছে। ‘আরবান রিভার পলিউশন ইন বাংলাদেশ ডিউরিং লাস্ট ফরটি ইয়ারস: পটেনশিয়াল পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইকোলজিক্যাল রিস্ক, প্রেজেন্ট পলিসি অ্যান্ড ফিউচার প্রসপেক্টস টুওয়ার্ডস স্মার্ট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক ওই গবেষণায় গত ৪০ বছরে দেশের বিভিন্ন নদীর দূষণের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।

গবেষণায় যেসব নদী, হ্রদ বা খালের দূষণের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বংশী, ধলাই বিল, মেঘনা, সুরমা, কর্ণফুলী, হালদা, খিরু, করতোয়া, তিস্তা, রূপসা, পশুর, সাঙ্গু, কাপ্তাই লেক, মাতামুহুরী, নাফ, বাকখালি, কাসালং, চিংড়ি, ভৈরব, ময়ূর, রাজখালি খাল। আর এসব জলাধারের পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে জিংক, কপার, আয়রন, লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কার্বন মনোক্সাইড ও মার্কারির উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৪০ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ আশপাশের অবিচ্ছিন্ন নদীগুলো চরম মাত্রার দূষণের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে বড় নদীগুলো থেকে দেশের প্রায় সব নদীতেই বিভিন্ন মাত্রায় দূষণ পৌঁছে গিয়েছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের শিল্পের প্রায় ৬০ হাজার টন বর্জ্য মিশছে বুড়িগঙ্গায়। সেখান থেকে তা বিভিন্ন মাত্রায় ছড়াচ্ছে তুরাগ, টঙ্গী খাল, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীতে।

তাদের ভাষ্যমতে, শিল্পবর্জ্যের ভারী ধাতু পানিতে মিশে নদীর তলদেশে মারাত্মক দূষণ তৈরি করে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে নদীর পানিতে ক্ষতিকর ধাতুর ঘনত্ব বেশি পাওয়া যায়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী নদীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে অক্সিজেনের মাত্রা প্রায় শূন্য পাওয়া গেছে। পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না থাকলে মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। ফলে এসব নদী জলজ প্রাণীদের আবাসস্থল হিসেবেও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এর ফলে ভেঙে পড়েছে নদীর বাস্তুসংস্থানও।

গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন দক্ষিণ কোরিয়া কুমো ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দুজন গবেষক। এদের একজন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিন। তিনি বর্তমানে পিএইচডি ফেলো হিসেবে রয়েছেন কুমো ইউনিভার্সিটিতে।

মো. জামাল উদ্দিন বলেন, অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলায় নদীর পানি দূষিত হয়। নদীর পানিতে যেসব ভারী ধাতু মেশে তা সাধারণত তলদেশে জমা হয়। নদীর মাছের মাধ্যমে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। একইভাবে নদীতে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীও এসব ধাতুমিশ্রিত পানি ও কাদামাটির ওপর নির্ভর করে বেড়ে ওঠে। আবার নদীর তীরবর্তী এলাকায় যেসব ফসল চাষ হয় সেখানেও নদী থেকেই সেচের জন্য পানি নেয়া হয়। ফলে এসব ফসলও বিষাক্ত হয়ে যায়।

নদীর দূষণ কমাতে এখনই সচেতন হতে হবে জানিয়ে এ গবেষক বলেন, নদীর দূষণ প্রতিরোধ কেবল সরকারের একার কাজ নয়। সবাইকে সচেতন হতে হবে। নদীদূষণের ফলে আমাদের উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যও দূষিত হয়ে পড়েছে। মানুষের খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন ভারী ধাতু মানবদেহে সরাসরি প্রবেশ করছে। দীর্ঘদিন এসব দূষিত খাবারের কারণে মানুষের শরীরে ক্যান্সারের মতো রোগ হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদীদূষণের কারণে কোনো নদীতেই ইলিশ ছাড়া এখন সেভাবে আর মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ, পাঙাশ, বাটা, সরপুটি, গলদা, বাগদা, চাকা চিংড়ি, বোয়াল, আইড়, শোল, গজার, টাকি, শিং, মাগুর বা কৈ মাছের উৎপাদন এখন আর নদীকেন্দ্রিক নেই। ইলিশ ছাড়া নদ-নদীর অন্যান্য মাছ বিলুপ্তপ্রায়।

কেরানীগঞ্জে ছোট-বড় পাঁচ হাজারেরও বেশি গার্মেন্টস কারখানা ছাড়াও রয়েছে শতাধিক ওয়াশিং কারখানা। ওয়াশিং মালিক সমিতির দেয়া তথ্য বলছে, প্রতিদিন ২৪ থেকে ৩০ লাখ লিটার বর্জ্য পানি সরাসরি অপরিশোধিত অবস্থায় গিয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। পাশেই শ্যামপুর শিল্প এলাকার শতাধিক প্রিন্টিং অ্যান্ড নিট-ডায়িং কারখানা থেকে প্রতিদিন বের হয় ৩০ হাজার ঘনমিটারেরও বেশি অপরিশোধিত তরল বর্জ্য যা সরাসরি মিশছে নদীটিতে। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ভারী ধাতু যাচ্ছে পানিতে। দূষণ রোধে হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানাগুলো হেমায়েতপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য সেখানে গিয়ে এ শিল্প খাত নতুন করে দূষিত করছে ধলেশ্বরী নদীকে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ করা হলেও তা সঠিকভাবে পরিশোধন করতে পারছে না। একই অবস্থা ইপিজেডগুলোর সিইটিপিরও। টঙ্গী এলাকায় থাকা ডায়িং ও ওয়াশিং কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য দূষিত করেছে তুরাগ নদকে।

এ বিষয়ে পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, নদীদূষণ রোধে প্রথমেই নজরদারি বাড়াতে হবে। যেসব কারণে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে তা উৎস থেকে নজরদারির মাধ্যমে বন্ধ, দূষিত তরল নদীতে ফেলা রোধ করতে হবে। এর জন্য যে আইনগুলো আছে সেগুলো প্রয়োগ জরুরি। নদীর প্রাণপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য, নদীগুলোর রাসায়নিক ও জীববৈচিত্র্যগত মান বজায় রাখার জন্য বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা বিবেচনায় নিয়ে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০২০’-এর খসড়া তৈরি করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। মূলত দেশের জলাধারগুলোকে দখল-দূষণের হাত থেকে বাঁচাতেই আরো বিধিবিধান দিয়ে এ আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে গবেষকসহ সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নদী রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কেবল শাস্তি দিয়ে বা সরকারের একার পক্ষে নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব না। এজন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাদের কাছে নদীর উপযোগিতার কথা ব্যাখ্যা করতে হবে। পাশাপাশি দূষণের সঙ্গে জড়িতরা যাতে যথাযথ শাস্তি পায়, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে।

যেকোনো মূল্যে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, নদীদূষণ প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ কাজের গতি আরো বাড়ানো হবে। - বণিক বার্তা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়