দীপক চৌধুরী: আমরা উদারতা দেখাই। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। গুজব ছড়িয়ে যারা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে, মানুষ হত্যা করে, তাণ্ডব সৃষ্টি করে, আগুন জ্বালিয়ে ত্রাস ছড়িয়ে যারা ছেলেধরার আতঙ্ক ছড়ায়--তাদের কঠোরহাতে দমন না করলে পরিণতি হবে আরো ভয়াবহ। বহু ধরনের বা নানান প্রকৃতির ব্যর্থতা আমাদের রয়েছে। আর কোনো ব্যর্থতা বা এক্সকিউজ দেখতে চায় না এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ। প্রশাসনে যদি হেফাজত সমর্থক কেউ লুকিয়েও থাকে তাকেও চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা চাই। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশবিরোধী হেফাজতি সন্ত্রাসীদের ধরতেই ‘রাজনৈতিক’ অঙ্ক কষা হয়েছিল। এক মামুনুলকে আইনের আওতায় আনতেই বহু হিসেব-নিকেশ করা হয়েছে। অথচ এসব বিষয়ে ন্যূনপক্ষে চিন্তা করা ঠিক হয়নি। যারা দেশের স্বাধীনতা বিশ্বাস করে না, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আত্মীয় এবং তাদের সঙ্গে চলাফেরা করে, দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করে তারা কারা- এটা কী ভেবে বলবার দরকার পড়ে? তারা কী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বুকে বুলেট নিক্ষেপ করতে একদণ্ড চিন্তা করবে? কখনো না। ২১ আগস্টে তাঁকে হত্যা করতেই গ্রেনেড মারা হয়। আর খালেদা জিয়া পার্লামেন্টে গিয়ে বলেছিলেন, ভ্যানিটি ব্যাগে নাকি গ্রেনেড ছিল। সেটা যে কী রকম মিথ্যাচার ছিলো আজ প্রমাণ হয়েছে।
আরো প্রমাণ হয়েছে যে, নানান হিসেব আর নানারকম ছাড়ে হেফাজত দানবে পরিণত হয়েছে। এখন নানারকম চক্রান্ত করা হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশে। একটু পেছনে গেলে দেখতে পাই, জনগণ কোনোরকম ভুল করেনি। ২০০৮ সালের অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিপুলভোটে দুই তৃতীয়াংশ আসনের চেয়ে বেশি নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সাহস, সততা, মেধা ও দূরর্শীতার কথা ভেবে জনগণ রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁর হাতে তুলে দেয়। জনগণ নিশ্চিত হয় যে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার হাতেই ক্ষমতা থাকা নিরাপদ। তাঁর শক্তিই দেশ ও মানুষের জন্য নিরাপদ। কিন্তু আমরা অনেকেই শত্রুদের কথা ভুলে গেলাম। ক্ষমতায় বসতেই কিছুদিনের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহ। জঙ্গিদের তাণ্ডব। সারাদেশে বিএনপি-জামায়াত জাতীয় পার্টির অরাজকতা সৃষ্টি। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের ত্রাস-তাণ্ডব। রাজধানীর মতিঝিল-দিলকুশায় তাণ্ডব সৃষ্টি ও অবস্থান। অগণতান্ত্রিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সারাদেশব্যাপী আগুন- পেট্রেলবোমা দিয়ে আক্রমণ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিরুদ্ধে তাণ্ডব, বিচার ও অপরাধীদের ফাঁসি ঠেকাতে ত্রাস। গুলশানে হোলি আর্টিজান সৃষ্টি। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঠেকাতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বাংলাদেশে আগমন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুঘন্টাব্যাপী বৈঠক। কিন্তু কোনো শক্তির আপত্তি আর ষড়যন্ত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঠেকাতে পারেনি। কারণ, তাঁর শরীরে তো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রক্ত বইছে। সুতরাং হেফাজতের সেই তাণ্ডবের জবাব এখন কীভাবে দিতে হবে তিনি তা জানেন, তাঁর সরকার জানে। বিলম্বে হলেও আইনের গতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসন পদক্ষেপ নিয়েছে। হেফাজতের প্রায় ২০ জন নেতা গ্রেপ্তার হয়ে এখন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে। তারা পুলিশ রিমান্ডে এসে ভয়ংকর সবরকম তথ্য দিচ্ছে, একের পর এক ত্রাসের কারণ জানাচ্ছে। জাতি এরমধ্যেই দেখেছে, হেফাজত ইসলামের আজিজুল হক ইসলামাবাদী, ইলিয়াস হামিদি, সানাউল্লাহ নূরী, রফিকুল ইসলাম মাদানী, সাখাওয়াৎ হোসেন রাযি, ওয়াসেক বিল্লাহ নোমানী, লোকমান হোসাইন আমিনী, বশিরুল্লাহ, জুবায়ের, জালালুদ্দিন, ফখরুল ইসলাম, মঞ্জুর আফেন্দি, আতাউল করীম মাকসুদ, জুনাইদ আল হাবিব, শরীফ উল্লাহ, মামুনুল হক প্রমুখ গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে গ্রেপ্তারের পর কোনো রকম ছাড় দেওয়া ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনবে- এটা মাথায় রাখতেই হবে। কারণ, এদের শাখা-প্রশাখা, ডালপালা গ্রামে-গঞ্জেও ছড়ানো। ওদের গ্রেপ্তারের পর বড়দের কেউ কেউ ভণ্ডামি শুরু করেছে। সুতরাং সাধু সাবধান।
বলে রাখা দরকার যে, হেফাজতে বহু ধর্মপ্রাণ মানুষ যুক্ত হয়েছেন। তারা সরল বিশ্বাসে এ সংগঠনে গেছেন। সেইসব ধর্মপ্রাণ মানুষকে তারা ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে ফায়দা লুটেছে। হেফাজত যে কীরকম ভয়ংকর জঙ্গি তা দেখা গেছে বহু জায়গায়। তারা দণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি-আসামীর মুক্তি চায়। এখন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা র্যাব-পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের একমাত্র কাজ হচ্ছে এদের অর্থাৎ জঙ্গি- হেফাজতিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা। ওরা এখন ঘাপটি মেরে আছে। লুকিয়ে আছে বিভিন্ন লেবাসে। যেকোনো সময় গোখরা সাপের মতো ফণা ধরবে। সমাজ থেকে এদের বাছাই করাসহ গোখরাদের বিষদাঁত ফেলে দিতে হবে। আমাদের র্যাব ও পুলিশবাহিনীতে অত্যন্ত সুদক্ষ ও মেধাবী সদস্য রয়েছে। জঙ্গি দমনসহ নানারকম দুঃসাহসী কাজে বিভিন্ন সময় প্রমাণ হয়েছে তারা বিশ্বমানের।
এবার সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনায় আসি। শত শত বছরের অসাম্প্রদায়িকতা ও সম্প্রীতির ঐতিহ্য সুনামগঞ্জের শাল্লায়। কী সামাজিকতায়, কী ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হিন্দু-মুসলিমদের মিলবন্ধন, প্রাণের সম্পর্ক। সেখানে ওরা কী রকম ভয়ংকর দুঃসাহস দেখালো। গতমাসে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সেই শাল্লায় হিন্দুগ্রাম নোয়াগাঁও-এর বাড়িঘরে ত্রাস-তাণ্ডব, লুটপাট চালিয়েছে মামুনুলের অনুসারী হেফাজতেরা। কারণ, মামুনুল হকের বিষয়ে ওই গ্রামের একটি হিন্দু ছেলে ফেসবুকে কী যেন লিখেছিল। যদিও সেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলেটিকে সঙ্গে সঙ্গেই তার সমগোত্রীয়রাই ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। কারণ, তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইনের শাসনে বিশ্বাসী। কিন্তু কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না করে জঙ্গি-সন্ত্রাস করা যাদের দর্শন- তারা হিন্দু গ্রামে তাণ্ডব চালালো।
দেশবাসী জানেন, অবশেষে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে সহিংসতার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আমির ও বর্তমান আহ্বায়ক জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। এ দুটিসহ ওই ঘটনায় হওয়া মোট তিনটি মামলায় অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর হেলাল উদ্দিন, উপজেলা জামায়াতের আমিরসহ তিন হাজার ব্যক্তি। গ্রেপ্তার করা হলে বাবুনগরীর কাছ থেকেও পিলে চমকে ওঠার মতো তথ্য নাকি পাওয়া যাবে- গল্পচ্ছলে পুলিশের এক কর্মকর্তা এমনটাই প্রত্যাশা করেছেন। আমরা জানি, ভয়ংকর তাণ্ডবের নেতৃত্বদানকারী মামুনুলকে আবার রিমান্ডে এনেছে পুলিশ। পল্টন থানায় হওয়া মারধর ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলার রিমান্ড শুনানিকালে মামুনুল বিভ্রান্তিমূলক কথা বলেছেন। সুযোগ পেয়ে আদালতে মনগড়া বক্তব্য দিতে পারেন কিনা এমন কথাও উঠেছে।
পুলিশ প্রতিবেদনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাজেদুল হক উল্লেখ করেন, আসামি মামুনুল হক মামলার ঘটনার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। আসামি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে ধর্মভীরু মুসলমানদের উসকে দিতেন। যার প্রেক্ষিতে এর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রবিরোধী ঘটনা, জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর ও হত্যাজনিত ঘটনা ঘটেছে। পূর্বের সাতদিনের পর আবার সাতদিনের রিমাণ্ড পেয়েছে পুলিশ।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক অনেক সত্য কথা বলেছেন, যা মানুষের প্রাণের কথা, হৃদয়ের কথা। অবশ্য তিনি দুঃসময়ের দলের বীরসৈনিক। সবসময়ই স্পষ্টবাদী ও সুবক্তা। তৃণমূলের এই সুসংগঠক, পরিশ্রমী ও পরীক্ষিত নেতা বলেছেন, ’৭১ সালে পরাজিত শক্তি এবং জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত জামায়াত ও বিএনপি বার বার ষড়যন্ত্র করছে। সর্বশেষ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব কলঙ্কিত করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ঠেকানোর নামে বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারীতে বাবুনগরী ও মামুনুল হকরা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আজ তারা নতুন লেবাস নিয়েছে। মধ্যরাতে ফেসবুক লাইভে কেন্দ্রীয় কমিটি বাতিল করেন। আবার সেহরির সময় কমিটি ঘোষণা দেন। একে একে হেফাজত নেতাদের পদত্যাগ ও মামুনুল হকের স্বীকারোক্তি দেওয়ায় তারা কমিটি বাতিলের নামে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন। তাদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। যারা মাদ্রাসা ও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম কলঙ্কিত করেছে তাদের মাদ্রাসায় ঢুকতে দেওয়া হবে না।”
এদেশের মানুষ নিশ্চিত যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে নানাভাবে ষড়যন্ত্র চলছে। চক্রান্তকারীরা নানারকম চক্রান্ত করছে। সুতরাং জনগণ মনে করে, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকারীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হবে। কোনোরকম ঢিলেমি নয়। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলো ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অপশক্তিগুলো দেশবিরোধী অপতৎপরতায় লিপ্ত। অবিলম্বে তাদের আইনের আওতায় এনে চক্রান্তের মুলোৎপাটন করা অত্যন্ত জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে যে সম্মৃদ্ধি ও স্বাতন্ত্র নিয়ে যেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে তাকে অর্থবহ ও টেকসই করতেও এসব অপশক্তির বিষদাঁত উপড়ে ফেলা দরকার।
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক