আশরাফ আহমেদ: [২] মধ্যযুগের ধর্মান্ধ লোকের গোড়ামীতে মহিলাদের চলাফেরা কিংবা বাড়িতে থাকাকালীন সময়েও ব্যাপক পর্দা প্রথার প্রচলন ছিলো। মহিলা কিংবা মেয়েদের বাড়ির বাহিরে যেতে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছিল। অযথাই কোথাও ঘোরাফেরা, ইচ্ছামাফিক চলাফেরা করতে পারত না।
[৩] ব্যক্তিগত স্বাধীনতাও ছিল কুক্ষিগত। কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে অধিকাংশ সময়ই রাতে বাড়ি থেকে বের হতে হতো। নিরাপত্তার দায়িত্বে সাথে থাকতেন বাবা, ভাই কিংবা স্বামী। মহিলারা রিক্সা কিংবা গরুর গাড়িতে ওঠার পর কাপড় অথবা চাদর দিয়ে চতুর্দিক আবরণে বেঁধে দেওয়া হতো। যাতে কোন দিকে ফাঁকা না থাকে সেজন্য সর্তকতা অবলম্বন করা হতো। নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থানে পৌঁছানোর পর তখন মহিলারা রিক্সা থেকে নামতে পারতেন। পথিমধ্যে পর্দা সরিয়ে কোনো কিছু দেখার সুযোগ ছিল না। কিন্তু কালের বিবর্তনে আধুনিক ইসলামী জ্ঞানের শিক্ষায় মূর্খতা ও অজ্ঞতা দূরীভূত হয়ে পর্দার ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এখন আর রিক্সা আবরণে পর্দায় নারীদের চলাফেরা করতে দেখা যায় না। যদিও বর্তমানে কিছুসংখ্যক মহিলারা রিক্সায় উঠার পর এই রিকশার ঢাকনা উঠিয়ে চলাচল করতে দেখা
যায়।
[৪] বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের ‘অবরোধবাসিনী ‘গল্পে ৪৭টি শ্লেক মাধ্যমে পর্দা প্রথার উদাহরণ তিনি দিয়েছেন। ৭নং গল্পে তিনি লিখেন, ঘরের ভেতর চোর ঢুকলে ‘বেগানা মরদটা’ (চোর) যাতে তাদের (বিবিদের) কণ্ঠস্বর শুনতে না পায় এ জন্য বিবিরা হাত, পা, নাক, কান ও গলার গয়না খুলে শিয়রে রেখে দিলেন এবং চোর সবকিছু নিয়ে নিরাপদে বের হয়ে গেলে তখন বিবিরা হাঁউমাউ আরম্ভ করলেন।
[৫] ৮নং গল্পে ,বাড়িতে আগুন লাগার পর গৃহিণী বুদ্ধি করে তাড়াতাড়ি সমস্ত অলঙ্কার একটা বাক্সে ভরে নিয়ে দরজার কাছে এসে আগুন নেভাতে ব্যস্ত পুরুষদের দেখে জীবন বাঁচানোর পরিবর্তে পর্দা রক্ষা করতে অলঙ্কারের বাক্স নিয়ে আবার ঘরের ভেতরে খাটের নিচে বসে আগুনে পুড়ে মরলেন। ধন্য! কুল-কামিনীর অবরোধ। আগুনে পুড়ে মরবেন তবুও পুরুষের সামনে বের হবেন না।
[৬] ৪১নং গল্পে, মশারী যাত্রা’ নামক এক অভিনব পর্দা প্রথা সে সময়ে দেখা যেত। তবে সেটি বড় জমিদার কিংবা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের গৃহিণীর ক্ষেত্রে ঘটত। রায় শ্রীযুক্ত জলধর সেন বাহাদুর নামক এক ব্যক্তি লেখেছেন- একদিন তিনি হাবড়া স্টেশনের প্লাটফর্মে দেখেন একটি মশারি আসছে। মশারির চার কোণা চারজন সিপাহি ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। পরবর্তীতে জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পারলেন বিহার অঞ্চলের এক রাজা কিংবা জমিদারের গৃহিণী ওই মশারির মধ্যে আব্রু রক্ষা করে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন। বড় মানুষের বউ- ঝিরা আর দশজনের সামনে দিয়ে বেআব্রু হয়ে যাবেন এটা তো ভাবাই যায় না; কারণ তারা যে অসূর্যস্পর্শা। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত“অবরোধ প্রথাকে প্রাণঘাতক কার্বনিক এ্যাসিড গ্যাসের সহিত তুলনা করেছেন।
[৭] যেহেতু তাহাতে বিনা যন্ত্রণায় মৃত্যু হয় বলিয়া লোক কার্বনিক গ্যাসের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করিয়া অবসর পায় না। অন্তঃপুরবাসী নারী এই অবরোধ গ্যাসে বিনা ক্লেশে তিল তিল করিয়া নীরবে মরিতেছে।”
[৮] এখন পর্দাই এসেছে আধুনিকতা। পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণা ভঙ্গ করে এখন প্রকৃত শিক্ষায় জ্ঞান অর্জন করে এসেছে নতুনত্ব। তাই এখন হারিয়ে গেছে রিক্সায় ঘেরাও করা পর্দা প্রথা। সম্পাদনা: হ্যাপি