নিউজ ডেস্ক: ডাক্তার-নার্সদের ব্যবহূত পারসোনাল প্রটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই), মাস্ক, গ্লাভসসহ নানা রকমের মেডিকেল বর্জ্য নতুন বিপদ নিয়ে এসেছে কর্ণফুলীর জন্য। চট্টগ্রামের প্রধান এই নদী এতদিন শিল্পকারখানার বর্জ্যে দূষিত হয়েছে। এখন নতুন করে নদীকে দূষিত করছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরে থাকা ৯০টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ১৮৩টি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি (ডায়াগনস্টিক সেন্টার)। এসব হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন মেডিকেল বর্জ্য বের হচ্ছে প্রায় ১০ টন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নগরীর ৬০ লাখ মানুষের ব্যবহূত মাস্ক ও গ্লাভসও। নিয়ম অনুযায়ী এসব বর্জ্য জীবাণুমুক্ত করে পুড়িয়ে ফেলার কথা থাকলেও সেই নিয়ম মানছে না সবাই। ড্রেন, নালা ও খাল হয়ে মেডিকেল বর্জ্য মিশে যাচ্ছে নদীতে। করোনা সংক্রমণ কিছু দিন কম থাকলেও এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে রোগী। তাই বাড়ছে মেডিকেল বর্জ্যের পরিমাণও।
পিপিই, মাস্ক, গ্লাভসসহ নানা ধরনের মেডিকেল বর্জ্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মন্তব্য করে সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, 'করোনা যতদিন থাকবে ততদিন অত্যন্ত সাবধানে চলতে হবে সবাইকে। মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই, ইনজেকশন সুচসহ বিভিন্ন মেডিকেল বর্জ্য স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো যত্রতত্র ফেলা যাবে না। হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে বর্জ্য সংরক্ষণে সতর্ক হতে হবে। নগরীর ৬০ লাখ মানুষকেও হতে হবে সচেতন। মেডিকেল বর্জ্য নালা-খাল হয়ে যদি নদীতে পড়ে তবে এটি সর্বনাশ করবে নদীরও।' নদী গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মুহাম্মদ ইদ্রিছ আলী বলেন, 'এমনিতেই কর্ণফুলী নদীর সর্বনাশ করছে শিল্পকারখানার বর্জ্য। এটির সঙ্গে মেডিকেল বর্জ্য যুক্ত হওয়ায় নদীর জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। যথাযথভাবে এ বর্জ্য সংরক্ষণ করা না হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে ৬০ লাখ নগরবাসীর।'
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ অনুযায়ী, হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ সকল চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের বিধান রয়েছে। বর্জ্য ফেলার আগে তা প্রথমে অটোক্লেভস অথবা ইটিপির মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করার কথাও বলা আছে। কিন্তু এটি যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। বর্জ্যগুলোকে জীবাণুমুক্ত করতে চমেক হাসপাতালে দুটি ইনসিনারেটর মেশিন রয়েছে। কিন্তু এই মেশিন দুটি পড়ে আছে অযত্ন অবহেলায়। গুরুত্বপূর্ণ এই মেশিনগুলো এভাবে পড়ে থাকলেও সচল করার তাগিদ নেই কর্তৃপক্ষের। বর্জ্য জীবাণুমুক্ত করার মতো দক্ষ জনবলও নেই তাদের। বর্জ্যগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে সিটি করপোরেশনের আওতাধীন 'চট্টগ্রাম সংস্থা' নামে একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি আছে চমেক হাসপাতালের। এজন্য প্রতি মাসে চসিককে প্রায় ৮০ হাজার টাকা দেয় তারা। এজন্য তাদের কর্মচারীরা প্রতিদিন দু'বার এসে ময়লা নিয়ে যায়। কিন্তু চসিকের কাছে 'ইনসিনারেটর' বা 'অটোক্লেভস মেশিন' না থাকায় আবর্জনাগুলো তারা রিসাইক্লিং করতে পারছে না। আবার নগরীর হালিশহরে বর্জ্যগুলো নেওয়া হলেও তা যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না চসিক। প্রতিটি হাসপাতালের পাশের ডাস্টবিনে এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকছে স্যালাইনের খালি ব্যাগ, প্লাস্টিকের সিরিঞ্জ, ওষুধের শিশি-বোতল, রোগীর গজ-ব্যান্ডেজসহ নানা ধরনের বর্জ্য।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক নুর উল্লাহ নুরী বলেন, 'মেডিকেল বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। এটি কোনোভাবে নদীতে মিশলে তা জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি তৈরি করবে। নগরবাসীকে মেডিকেল বর্জ্য যথাস্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। আবার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে এটি যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি হয় এমন কোনো প্রক্রিয়ার সঙ্গে কেউ যুক্ত থাকলে পরিবেশ আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে অধিদপ্তর।
কর্ণফুলী নদীর দূষণ প্রতিরোধে এটির পানি নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তাদের পরীক্ষায় কর্ণফুলী নদীর পানি দূষিত পাওয়া গেছে একাধিকবার। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পাচ্ছে না পরিবেশ অধিদপ্তর। আবার প্রধান এ নদীর বিপর্যস্ত চিত্র পেয়েছে 'চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন' নামের একটি সংগঠনও। এর আগে কর্ণফুলী নদী ও শাখা খালের ওপর একটি জরিপ চালিয়েছিল তারা। এতে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদী শুধু দূষিতই হচ্ছে না, আকারেও ছোট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। জরিপে তারা কর্ণফুলী নদীর শাখা খাল রাজাখালীর প্রশস্ততা ৮৯৮ মিটারের স্থলে পেয়েছে ৪৬১ মিটারে। চাক্তাই খালের মুখে এখন নদীর প্রস্থ মাত্র ৪৩৬ মিটার, যা আগে ছিল ৯৩৮ মিটার। ফিরিঙ্গিবাজার মোড়ে ৯০৪ মিটারের স্থলে নদীর প্রশস্ততা পাওয়া গেছে ৭৫০ মিটার। মেরিনার্স পার্ক এলাকায় প্রস্থ ৯৮১ মিটার হলেও খনন করে সেখানে মিলছে ৮৫০ মিটার। গত বছরের ৩০ আগস্ট থেকে ২১ দিনব্যাপী কর্ণফুলী নদীর এই প্রস্থ জরিপ পরিচালনা করা হয়। বিএস শিট, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, চট্টগ্রাম বন্দর প্রণীত কৌশলগত মহাপরিকল্পনা ২০১৪-এর সঙ্গে তুলনা করে এই জরিপ করা হয়। জরিপ পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন প্রয়াত প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ। - সমকাল