শিরোনাম
◈ এলডিসি থেকে উত্তরণ: আরও তিন বছরের সময় চাইছে বাংলাদেশ ◈ জাপানে জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব সিদ্ধান্ত নিল অন্তর্বর্তী সরকার ◈ ১৭ বিয়ের ঘটনায় মামলা, সেই বন কর্মকর্তা বরখাস্ত ◈ বিএনপি নেতাকে না পেয়ে স্ত্রীকে কু.পিয়ে হ.ত্যা ◈ বাংলা‌দেশ হারা‌লো আফগানিস্তানকে, তা‌কি‌য়ে রই‌লো শ্রীলঙ্কার দিকে  ◈ রোজার আগে নির্বাচন দিয়ে পুরোনো কাজে ফিরবেন প্রধান উপদেষ্টা ◈ ঋণের চাপে আত্মহত্যা, ঋণ করেই চল্লিশা : যা বললেন শায়খ আহমাদুল্লাহ ◈ একযোগে এনবিআরের ৫৫৫ কর্মকর্তাকে বদলি ◈ আবারও রেকর্ড গড়ল স্বর্ণের দাম, ভরিতে বেড়েছে ৩ হাজার ৬৭৫ টাকা ◈ ভারতের নেপাল নীতিতে 'রিসেট বাটন' চাপলেন মোদি, শিক্ষা বাংলাদেশের কাছ থেকে

প্রকাশিত : ২৬ মার্চ, ২০২১, ০৫:০৬ সকাল
আপডেট : ২৬ মার্চ, ২০২১, ০৫:০৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

লেলিন চৌধুরী: ছাব্বিশে মার্চ : স্বর্ণদ্বার খুলে গেলো

লেলিন চৌধুরী: পৃথিবী নিয়ম মেনেই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। পঞ্জিকার তারিখগুলো সারিবদ্ধভাবে অতীতের অন্ধকারে ডুবে যায়। বিস্মরণের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কিছু কিছু দিন হীরকদীপ্তিতে আত্মপ্রকাশ করে। এই দিনগুলোতে ইতিহাসের গতিপথের উল্লম্ফন ঘটে। বিশ্বের চালচিত্রে রদবদল হয়। মানুষের জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এরকম দিনের সামনে মানুষ প্রতিবছর থমকে দাঁড়ায়, নিজের প্রতিবিম্ব দেখে এবং সামনে চলার জীবনীশক্তি সংগ্রহ করে। বাঙালির জন্য এরকম একটি দীপ্তিময় দিন হলো ২৬ মার্চ।

২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। বাঙালি, বাংলাদেশ এবং ২৬মার্চ একই যাত্রাপথের ধারাবাহিকতা। ২৬মার্চের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে বাঙালির শিকড়কে সন্ধান করতে হবে। ইতিহাসের পথে বাঙালির যাত্রা কবে শুরু হয়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে আমরা জানি নব্যপ্রস্তর যুগের একটি প্রত্ননির্দশন পাথরের কুঠার বাংলাদেশের সীতাকুণ্ডে পাওয়া গিয়েছে। আমরা সেটাকেই শুরুর সময় বলে ধরে নিতে পারি। অমর্ত্য সেনের ভাষায়- ‘যেকোনো গ্রহণযোগ্য বিন্দু থেকে শুরু করা যেতে পারে’। নিঃসন্দেহে বলা যায় যারা সেই কুঠার ব্যবহার করতেন তারা এই ভূমির আদি বাসিন্দা। তারপর দীর্ঘকাল এই ভূমিবাসীদের উল্লেখ কোথাও নেই। এরপর বঙ্গজনের দেখা পাওয়া যায় বৈদিকসাহিত্যে। ওরা বড় ঘৃণা করতো আমাদের। আমাদের ভাষা ও স্বভাব নিয়ে অসম্মানজনক মন্তব্য করেছে।

এ অঞ্চলের মানুষকে তস্কর মনে করতো। তাই অপরাধীদের বঙ্গ অঞ্চলে নির্বাসনে পাঠাত। মহাভারতে উল্লেখ আছে- বিকৃতকামী মুনি দীর্ঘতমাকে কাঠের ভেলায় ভাসিয়ে এই জনপদে নির্বাসন দেওয়া হয়। তারই এক পুত্র ‘বঙ্গ’-এর নাম অনুসারে এই জনপদের নাম হয় বঙ্গদেশ। বৈদিক সাহিত্যিকদের রচিত সে এক নোংরা কাহিনি। এসবের সরল অর্থ হলো এখানকার জনপদবাসীরা বৈদিকদের মতো ছিল না। এদের আলাদা নিজস্ব ভাষা, ধর্ম ও সভ্যতা ছিল। যদিও পরবর্তীকালে বৈদিক আগ্রাসনের ফলে ভাষা ও ধর্মের ব্যাপক আর্যীকরণ ঘটে। এরফলে বঙ্গ তখন বৈদিকদের মিত্রে পরিণত হয়। তাই মহাভারতে দ্রৌপদীর স্বামী নির্বাচনের সভায় বঙ্গরাজের উপস্থিতি  দেখতে পাই। অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া নিয়ে অর্জুন বঙ্গে আসে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বঙ্গের রাজা কৌরবপক্ষে যোগ দিয়েছিল। আর্যীকরণের ফলে বঙ্গবাসীর ধর্ম ও জীবনাচারে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

কিন্তু বৈদিক ঋষি মনু প্রবর্তিত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য,শূদ্র- এই মানব বিভাজন রীতি বঙ্গজনেরা কি অন্তর থেকে মেনে নিয়েছিল? মনে হয় না। বৈদিক রাজশক্তির দুর্বল সময়ে সাম্যের বাণী নিয়ে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব হয়। আমরা দেখি দলে দলে এই অঞ্চলের মানুষ বুদ্ধের শরণ নেয়। বৈদিকরা বঙ্গকে করায়ত্ত করেছিল সামরিক শক্তিতে। গৌতম বঙ্গকে জয় করলেন সাম্য-মৈত্রীর মন্ত্রে। পঞ্চম শতকে রাজা শশাঙ্ক বঙ্গে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে। তার শৌর্যের কথা হর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত কাব্য’-এ বর্ণিত আছে। যদিও শশাঙ্ককে বৌদ্ধ-বিদ্বেষী বলা হয়। শশাঙ্ককের মৃত্যুর পর বঙ্গদেশে শতবর্ষব্যাপী এক অরাজকতা(মাৎস্যান্যায়)-র সময় শুরু হয়। শেষপর্যন্ত দেশের জনসাধারণ মিলে গোপাল নামের একজনকে রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের প্রথম গণতান্ত্রিক শাসক। এটা কিন্তু ৭৫০ সালের কথা। তারপর তুর্কি,মোগল হয়ে ব্রিটিশ শাসন।

বাঙালি নিজেকে জাতি হিসাবে কবে থেকে ভাবতে শুরু করে? প্রথমেই মনে রাখতে হবে ইউরোপীয় নবজাগরণের মধ্যদিয়ে আধুনিক ‘জাতি(নেশন)’ ধারণাটির জন্ম হয়েছে। ভারতবর্ষে জাতি বলতে ধর্মানুসারী এবং সম্প্রদায়কে বোঝানো হতো। যেমন  ব্রাহ্মণ বা শূদ্র একটি জাতি। আবার মুসলমান জাতি। তবে বঙ্গ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে পরিবেশ, প্রতিবেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, আয়ের উৎস এবং অভিন্ন জীবনযাপনের কারণে একধরনের বন্ধন, নৈকট্যবোধ ও আবেগী সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বহিঃশত্রুর আগ্রাসন মোকাবেলায় এই বন্ধন দৃঢ়তর হতে থাকে। এভাবেই একটি জনগোষ্ঠী ক্রমশ জাতিতে রূপান্তরিত হতে থাকে। প্রশাসনিক কাঠামো এই বোধকে দৃঢ়তর করে। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের প্রভাবে বঙ্গদেশের শিক্ষিত ও চিন্তাশীলদের মানসিকতায় বিশাল পরিবর্তন ঘটে। স্বাদেশিকতা এবং দেশপ্রেম তাদের চিন্তাজগতের মূলভিত্তি রূপে জায়গা করে নেয়। এর প্রথম প্রকাশ ঘটে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। অবিভক্ত বাংলার জন্য একটি আবেগময় আবহ তৈরি হয়। এরপর পর শিল্প-সাহিত্যে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি একধরনের মায়াময় ভালবাসার বোধ নিয়ে উপস্থিত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে ভারতভাগের সময় ‘স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা’র প্রস্তাব মূলত তারই রাজনৈতিক প্রতিফলন।

ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় বাঙালির যাত্রাপথটি নিজস্বতায় পরিপূর্ণ। আধুনিককালে জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশের দুর্দমনীয় আকাক্সক্ষা তাকে রাজনৈতিক স্বাধীনতার পথে ধাবিত করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাঙালি জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বঙ্গভূমির প্রধান ভূখণ্ড পূর্ববঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের গোড়াপত্তন করে। এই মহাআয়োজনে বাঙালি এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী সকল জাতি ও ধর্মের মানুষকে সাথে নেয়। ন্যায্যতার ভিত্তিতে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীন দেশ গঠনের জন্য লড়াই শুরু হয়। বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হলো। তাই ২৬ মার্চ হলো বাঙালির জন্য ইতিহাসের পথযাত্রায় স্বর্ণদুয়ার খুলে যাওয়ার মহান দিন। স্বাধীন দেশের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের অধিকার, সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও শিকড় সংযুক্ততাকে প্রতিষ্ঠা করা। সে-কাজগুলো এখনো  সম্পন্ন হয়নি। তাই প্রতিটি ২৬ মার্চ অসমাপ্ত দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য আমাদের তাগিদ দেয়। লেখক: স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও শিশু অধিকারকর্মী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়