ড. আরমান রহমান: কিছুদিন থেকেই ফেসবুকের কল্যাণে জানতে পারছি পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মানুষের মতোই বাংলাদেশেও ৬৫ বছর বয়সের মানুষদের অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিন দেওয়া যাবে কি না, এ নিয়ে ব্যাপক ধুয়াশা তৈরি হয়েছে। আমি মনে করি বাংলাদেশের ৬৫ উর্ধ্ব মানুষের এ টিকা নেওয়া উচিত-কেন নেওয়া উচিত আসেন দেখি: জানুয়ারির শেষে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়ার এক দিন পরেই ফ্রেঞ্চ প্রেডিসেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো একটি ঘোষণা দিয়ে বলেছেন অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা ৬৫ বছরের উপরের মানুষের ক্ষেত্রে উৎসাহব্যঞ্জক নয়. ম্যাক্রোর এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই ফ্রেঞ্চ অথরিটি তাদের দেশে ৬৫ এর উপর বয়সের মানুষের মধ্যে এই টিকা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পরেই ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশ যেমন জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, নেদারল্যান্ড স্পেইন ইত্যাদি দেশ একই সিদ্ধান্ত নেয়। এখানে স্মরণ রাখা ভালো, ইংল্যান্ড ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাবার পরে এই ভ্যাকসিনের উৎপাদন এবং বিতরণ নিয়ে তাদের মধ্যে বিশেষ মনোমালিন্য চলছে।
বলাই বাহুল্য, ইংল্যান্ডের সরকার এবং তাদের মেডিকেল কর্তৃপক্ষ ফ্রান্স এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে ৬৫ বছরের উপরে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে একমত পোষণ করে না. তাদের দেশে ১৮ উর্ধ্ব সবাইকে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে।
সবচেয়ে প্রথমে যেটা জানা দরকার ভ্যাসিনের কার্যকারিতা কীভাবে মাপা হয়? ধরেন ১০০০ মানুষের মধ্যে এ টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়েছে, তাহলে ৫০০ জনকে অক্সফোর্ডের টিকা দেওয়া হবে, ৫০০ জনকে প্লাসিবো (টিকার বদলে পানি বা অন্যকিছু) দেওয়া হবে. এর পরে দেখেতে হবে কতোজনের করোনা হলো। প্লাসিবো গ্রুপের মধ্যে কতোজনের করোনা হয়েছে এবং টিকা দেওয়া গ্রুপের মধ্যে কতোজনের করোনা হয়নি, এ হিসাবই বলে দেয় টিকা কতো পার্সেন্ট ইফেক্টিভ। এখন দেখা গেছে অক্সফোর্ডের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যে হাজার হাজার মানুষ ছিলো, তাদের মধ্যে ৬৫ বছরে ওপর ছিলো ৬৬০ জন।
এই ৬৬০ জনের মধ্যে মাত্র দুই জনের করোনা হয়েছিলো। কাজেই কার্যকারিতা মাপার জন্য এ দুই জন যথেষ্ট নয়। এর মানে এই নয় যে এ ভ্যাকসিন কার্যকর নয়। কার্যকারিতা দেখানোর জন্য যে পরিমাণ করোনা রোগী লাগে তা এ ট্রায়ালে ছিলো না। কিন্তু অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন ৬৫ বছরের উপরের মানুষের শরীরে পর্যাপ্ত ইমিউন রিকশন দেখিয়েছে, এ ডেটা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। কাজেই এ ভ্যাকসিন যে ৬৫ বছরের উপরের মানুষকে প্রটেকশন দিতে পারে সে ব্যাপারে কারও কোনো সন্দেহ নেই।
এর পরে আরও দেখতে হবে ভ্যাকসিন কেন দিচ্ছি? করোনা ভাইরাসের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ৬৫ বছরের উপরের মানুষের। তাদেরকে যদি আপনি ভ্যাকসিনের আওতার বাইরে রাখেন তাহলে সেটা কতোটা যুক্তিযুক্ত? ইউরোপে তাদেরকে ফাইজার এবং মডার্নার ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, বাংলাদেশে যেহেতু এই ভ্যাকসিন এখনো যায়নি, কাজেই ইউরোপের কথা শুনে আমাদের ভ্যাকসিন নেওয়ার কৌশল ঠিক করা বুদ্ধ্যিমানের কাজ হবে না।
এ ভ্যাকসিন ১০০ শতাংশ মৃত্যু এবং কঠিন অসুখ হওয়া থেকে মানুষকে রক্ষা করে। ভ্যাকসিনের এফিকেসি বলতে আমরা যা এতোদিন শুনেছি সেটাই একমাত্র কথা নয়, যদি ভ্যাকসিন আমার মা বাবাকে হাসপাতালে আইসিইউতে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারে, তাহলে শুধুমাত্র পরিসংখ্যানের মারপ্যাচে পরে এ ভ্যাকসিন নেওয়া থেকে বিরত থাকলে সেটা হবে অবিবেচকের মতো কাজ। শুধুমাত্র এ ধোঁয়াশা কাটাতে ইংল্যান্ডে এবং আমেরিকাতে বয়স্ক মানুষদের নিয়ে আলাদা একটি ট্রায়াল চলছে, এ ট্রায়ালের রেজাল্ট কিছুদিনের মধ্যেই হাতে চলে আসবে। কিন্তু বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষ যদি টিকা নেওয়া থেকে বিরত থাকে, এ সময়ের মধ্যে তাদেরকে ঝুঁকিতে রাখা সমীচীন কী না তা ভেবে দেখার বিষয়। ডা. আরমান রহমান, ডাবলিন আয়ারল্যান্ড থেকে। ফেসবুক থেকে মাসুদ হাসান
আপনার মতামত লিখুন :