মাওলানা তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব: সম্মান ও সম্পদের প্রতি মানুষের আগ্রহ অনেকটা স্বভাবজাত। তবে কারও কাছে প্রধান বিষয় হলো সম্পদ। কারও কাছে সম্মান। এই আগ্রহ দুটি মানুষকে বহু অসাধ্য সাধনে সাহায্য করে। অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করার সাহস যোগায়। ফলে বৈধ-অবৈধ, ন্যায়-অন্যায় এবং উচিত-অনুচিত যে কোন কাজ করতে অনেকে প্রস্তুত হয়ে যায়। কেউবা কিছুটা হিসাব করে চলে। আর কেউ কেউ বিশ্বাস করে, আমার ভাগ্যে আল্লাহ তাআলা যেটুকু সম্মান রেখেছেন, সেটুকু আমি পেয়েই যাব। যেটুকু সম্পদ আমার জন্য বরাদ্দ, সেটুকু এসেই যাবে। সেজন্য হা হুতাশ কিংবা অস্থির হওয়ার কোন দরকার নেই।
অনেকে মনে করে, সম্মান ও সম্পদ অর্জনের প্রধান মাধ্যম হলো শিক্ষা-দীক্ষা। কিন্তু একথা ঠিক নয়। শুধু শিক্ষা-দীক্ষা দিয়েই সবাই সম্মান ও সম্পদ অর্জন করতে পারে না। কত শিক্ষিত মানুষ রয়েছে সম্পদহীন! এমনকি মানুষের কাছে সম্মানিত ব্যক্তিও তারা নন! অনেকে ভাবে, জাগতিক বুঝ-বুদ্ধি বেশি হলেই মানুষের সম্পদ বেশি হয়। কেউ কেউ বলে, কষ্ট সহিষ্ণু দেহ আর শারিরিক শক্তিই সম্পদ অর্জনের প্রধান মাধ্যম। স্পষ্ট কথা যে, এর কোনটিই শেষ কথা নয়। কারণ এই দুনিয়ায় কত বুদ্ধিমান, সচেতন, চালাক এবং শক্তি-সামর্থ্যবান মানুষ আছে অসহায়। দুমুঠো খাবার পর্যন্ত নিয়মিত জুটে না। সমাজের চোখেও তারা নিতান্ত অবহেলিত। আসলে মানুষ তার নিজস্ব বুঝ-বুদ্ধি দিয়ে সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করতে চায়। সে ভুলে যায়, যেটুকু জ্ঞান তাকে দেওয়া হয়েছে তা খুবই সামান্য। না সবকিছু বুঝার যোগ্যতা তার আছে! না বিশ্লেষণ করার! অনেকে মনে করে হয়, ভালো চাকুরী জুটে যাওয়া কিংবা উচ্চ শ্রেণির ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক রেখে চলা সম্পদ অর্জনের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু কত ভালো চাকুরীজীবীকে দেখা যায়, চূড়ান্ত অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছে। সাংসারিক খরচাদি এবং পরিবারের সদস্যদের রোগব্যাধি প্রতি মাসে তার মোটা অংকের অর্থকড়ি নিয়ে নিচ্ছে। কিংবা দেখা যায় কত ধরনের শত্রুর শিকার হয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ মামলা-মোকাদ্দমা করছে। তাতে প্রচুর অর্থ নিয়মিত খরচ করতে হচ্ছে। বুঝা গেল—ভালো চাকরি আর ভালো বেতনই মানুষের সম্পদ অর্জনের একমাত্র মাধ্যম নয়। উচ্চশ্রেণির লোকদের সঙ্গে যোগাযোগই মানুষকে সবকিছু করে দিতে পারে না। বরং কখনো তো বিষয়টি হয় সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাৎ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগই কারও বিপন্ন হওয়ার কারণ হয়!
মোটকথা, এসবের কোনটিই মূল বিষয় নয়। সুতরাং মানুষের উচিত, এই জাতীয় ধ্যান-ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে আপন দায়িত্ব পালনে সচেতন হওয়া। বরং তার আগে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা লাভ করা। অথচ এ বিষয়েই সবচেয়ে বেশি উদাসীন আমাদের সমাজ! আগে মানুষের মুখে শোনা যেত, সন্তানকে পড়ালেখা করায় মানুষ বানানোর জন্য। অর্থাৎ মানবিক গুণসম্পন্ন আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু এখন দেখা যায়, উচ্চশিক্ষিত অনেক মানুষ -তাদের বক্তব্য অনুযায়ীই- মানবিক গুণসম্পন্ন নয়। নীতিবান নয়। আদর্শ মানুষ নয়। তাহলে এই বিপুল শিক্ষা-দীক্ষা তার মাঝে কোনও কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি? করে থাকলে কী সেই কার্যকারিতা? পূর্ণ ইনসাফ ও ন্যায় সঙ্গতভাবে যদি কেউ বলে, আশা করি একথাই বলবে যে, আমাদের সমাজে শিক্ষার উদ্দেশ্য এখন মানুষ হওয়া নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য—অর্থ উপার্জন করা কিংবা কৃতিত্বের সনদ লাভ করা! সেজন্য শিক্ষার শুরু থেকেই শিক্ষার্থী এবং তার অভিভাবক উভয়েই ভাবতে থাকে, কোন বিষয়ে পড়াশোনা করলে বেশি পরিমাণে অর্থ উপার্জন করা যাবে? কোন বিষয়ে পড়ালেখার দ্বারা মান মর্যাদা বেশি হবে?
আসলে মান মর্যাদার বিষয়টিও এখন নিতান্ত গৌণ। প্রধান বিষয় কেবল অর্থ উপার্জন। সেজন্য কোন শিক্ষার্থীর পুরো শিক্ষা জীবনে কেবল অর্থ উপার্জনের বিষয়টিই চূড়ান্ত মানসিকতা হয়ে বিরাজ করে। এমন উদ্দেশ্যে শিক্ষা অর্জনকারী ব্যক্তি মানবিক গুণসম্পন্ন হওয়া সহজ নয়। আর তাই আমাদের সমাজের যত ভয়ঙ্কর বাস্তবতা! এমন আরও অনেক বিষয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমাজের সকল ক্ষেত্রে। আমাদের দিল-দেমাগে। এসব থেকে উত্তরণ না হলে আমাদের জীবনে প্রকৃত সুখ ও শান্তি লাভ করা বলা যায় অসম্ভব। ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবা দরকার বিষয়গুলো। নিজেদের উন্নতি, সমাজের উন্নতি ও দেশের উন্নতি—সর্ব বিবেচনায়ই বিষয়গুলো গুরুত্বের দাবি রাখে। নয়তো অনেক কিছুই হয়তো হবে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কিছুই হবে না। শিক্ষিত ও সম্মানিত লোকদের মাধ্যমেই একের পর এক কলঙ্ক সূচিত হতে থাকবে। ফলে আমাদের বাহ্যিক অগ্রগতিই হবে আমাদের পশ্চাদপদ হওয়ার বড় কারণ! - ইসলাম টাইমস