সুজন কৈরী: [২] সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ‘হাজির কামলা’ নামে অভিনব এই প্রতারণার বেশ কয়েকটি ঘটনার খবর পেয়েছে র্যাব ও পুলিশ। তারা বলছে, এটা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অপরাধ। অভিনব এই প্রতারণার ঘটনায় একাধিক মামলাও হয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছে কয়েকজন। গত বছরের জুন মাস থেকে রাজধানীর সদরঘাট, গুলিস্তান, জুরাইন ও ধলপুর এলাকায় এই প্রতারণার ঘটনা বেশি ঘটেছে। কয়েক মাসের বেশ কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ ও মামলা পর্যালোচনা করে সম্প্রতি এই চক্রের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
[৩] সর্বশেষ শুক্রবার রাজধানীর ধলপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে অভিনব এই প্রতারক চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারকৃতদের নাম- সবুজ (২৫), রোকশানা বেগম (২১), পপি আক্তার (২০), রুপা আক্তার (২০), জাহানারা বেগম ওরফে জানু (৪০), মোতাহার হোসেন মিলন (২৮), মো. মেহেদী হাসান ইমন (২৪), জাহিদ (২৮) ও আবুল হোসেন (৩২)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২টি রুপার চেইন, ২টি হাত ঘড়ি, ১০টি মোবাইল ফোন ও নগদ ২১ হাজার ৯০০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
[৪] র্যাব সূত্র জানায়, গত ১ ফেব্রুয়ারি যাত্রাবাড়ীর কাজলায় বাসায় ঢুকে রাজিব খান নামের একজনকে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত করতে গিয়ে হাজির কামলা প্রতারক চক্রের বিষয়ে জানা যায়। হত্যাকাণ্ডের শিকার রাজিব ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা এই চক্রের সদস্য ছিলো। নিজেদের মধ্যে টাকার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে রাজিবকে হত্যা করা হয়।
[৫] র্যাব-১০ এর এএসপি এনায়েত কবির সোয়েব বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পুরুষ ও মহিলার সমন্বয়ে গঠিত এক একটি দলে ভাগ হয়ে সাধারন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত নারীদের যাকাতের টাকা পাওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যেতো। সেখানে নারীদের স্বর্ণালংকার, টাকা-পয়সাসহ অন্যান্য মালামাল নিয়ে পালিয়ে যেতো।
[৬] র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, চক্রটি বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত নারীদের টার্গেট করে থাকে। পরে চক্রের একজন সদস্য গিয়ে টার্গেট করা নারীর সঙ্গে গিয়ে গল্প শুরু করেন। কথার মাঝে চক্রের অন্য একজন সদস্য গিয়ে বলেন স্থানীয় কয়েকজন হাজি মিলে যাকাত ও নগদ টাকা বিতরণ করছেন। তিনিও পেয়েছেন। পরে যাকাত আনতে রাজি হলে ভুক্তভোগীকে চক্রের সদস্যরা জানান, তার কানে ও হাতে সোনার গহনা দেখলে হাজি সাহেবরা দান করতে রাজি হবেন না। স্বর্ণালংকার খুলে তাদের কাছে রাখতে বলেন। বিশ্বাস করে তার কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও ব্যাগ তাদের কাছে রেখে যান। এরপর একটি বাড়ি দেখিয়ে চক্রের সদস্যরা সটকে পড়েন। ওই বাড়িতে গিয়ে ভুক্তভোগী নারী বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
[৭] গত বছরের ২২ জানুয়ারি রাজধানীর কদমতলীর মুরাদপুর নোয়াখালী পট্টির একটি বাড়ি থেকে নারীসহ হাজির কামলা প্রতারক চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে ২৬ ভরি স্বর্ণালংকার, ৬৮ ভরি রুপা, নগদ প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা ছাড়াও ২৭টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
[৮] ওই সময় ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের শ্যামপুর ও কদমতলী জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) শাহ আলম জানান, চক্রটি প্রতারণার সময় অনেকের কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে নিতো। তাদের কাছ থেকে ৩৫টি শাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে।
[৯] প্রতারক চক্রটির কৌশল সম্পর্কে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, চক্রটি প্রথমে একজনকে টার্গেট করে। এরপর তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বিশ্বাস অর্জন করে। এরপরই প্রলোভন দেখিয়ে ভিকটিমের স্বর্ণালংকার বা ব্যাগ লুটে নেয়। তারা হজফেরতদের খবরাখবর নেয়। এরপর তার বাড়ির আশপাশে ‘টার্গেট করা’ ব্যক্তিকে নিয়ে যায়। ভুক্তভোগীদের বলা হয়, হাজিরা জাকাত দিচ্ছে। যাকে তাদের ভাষায় ‘হাজির কামলা’ বলা হয়। প্রলোভনে পড়ে অনেকে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়। এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ মাঠে নামে।
[১০] তিনি বলেন, এটা একদমই নতুন ধরনের অপরাধ। চক্রটি মূলত বাসস্ট্যান্ড ও লঞ্চ টার্মিনাল এলাকায় প্রতারণা করে। কারণ, বাস-লঞ্চে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ যাতায়াত করে। চক্রটি নিম্ন আয়ের মানুষদের সহজেই বোকা বানাতে পারে। এছাড়া যারা একা বা বাচ্চাসহ থাকে এবং যাদের গলায় দামি স্বর্ণালংকার আছে তাদেরকে টার্গেট করে চক্রটি। প্রতারণা করার পর তারা অবস্থান পাল্টে ফেলে।