শিরোনাম
◈ হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভক্তি প্রকট ◈ দুই দানব ব্ল্যাক হোলের খোঁজ পেল বিজ্ঞানীরা, কী ঘটছে মহাবিশ্বে? (ভিডিও) ◈ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২য় উচ্চতর গ্রেডে আইনি ছাড় ◈ বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা সুবিধা চালু করেছে মালয়েশিয়া ◈ শান্তির হ্যাটট্রিক, ভুটানকে সহ‌জেই হারা‌লো বাংলাদেশের মে‌য়েরা ◈ মেট্রো স্টেশনে বসছে এটিএম ও সিআরএম বুথ ◈ ১৬ই জুলাই রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা ◈ রহস্যময় নাকামোতো এখন বিশ্বের ১২তম ধনী, বিটকয়েন সম্পদ ১২৮ বিলিয়ন ডলার ◈ শাহবাগ মোড় অবরোধ করলো স্বেচ্ছাসেবক দল ◈ বিএসবির খায়রুল বাশারকে আদালত প্রাঙ্গণে ডিম নিক্ষেপ, কিল-ঘুষি

প্রকাশিত : ১০ জানুয়ারী, ২০২১, ০২:২৫ রাত
আপডেট : ১০ জানুয়ারী, ২০২১, ০২:২৫ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

এম. নজরুল ইসলাম: জন্মশতবর্ষে জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

এম. নজরুল ইসলাম: আজ ১০ জানুয়ারি, বাঙালীর জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭২ সালের আজকের এই দিনে স্বাধীন দেশের মাটিতে ফিরে আসেন এ দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যে জাতির মননে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বুনেছিলেন, সেই দেশের রক্তভেজা মাটিতে তিনি ফিরে এলেন আজকের এই দিনে।

কেমন ছিল সেই দিনটি-যেদিন ফিরলেন পিতা মুক্ত স্বদেশে, বিজয়ী বীরের বেশে? সেদিন আকাশে যে সূর্য উঠেছিল সেই সূর্য কি জানত যে, এক মহান পুরুষ ওই আলো গায়ে মেখে বিজয়ীর বেশে নিজের দেশে ফিরবেন মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে? ফিরলেন তিনি বাঙালীর ভালবাসা ছুঁয়ে। বাঙালী জাতির হৃদয় ভরিয়ে দিয়ে নিজের দেশে ফিরলেন সেই মহাপুরুষ, যাঁর জন্য অপেক্ষায় ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়ে চূর্ণ হয়ে যায় এই উপমহাদেশের যুগ-যুগান্তরের চিন্তার অস্থিরতা ও মানসিক অচলায়তন। তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের মানুষ যেমন ফিরে পায় সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রেরণা, তেমনি তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালীর আশা ও আকাক্সক্ষার প্রতীক। একই সঙ্গে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অন্ধকার শক্তির সর্বনাশের সূচনাও হয় তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়ে। কেমন ছিল সেই দিনটি? কেমন ছিল সেদিনের সেই অপরাহ্ন?

সেদিন বাংলাদেশ বেতার থেকে অনবরত ধারাবিবরণী দেয়া হচ্ছিল। বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ জনতা। এক একজনের চোখে-মুখে অন্যরকম উত্তেজনা। নেতা আসছেন। আসছেন প্রিয় পিতা। পাকিস্তানের কারাগারের শৃঙ্খল ছিঁড়ে দেশের মাটিতে আসছেন সেই মহামানব, যিনি বাঙালী জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। এক সময় অপেক্ষার পালা শেষ হয়। পিতা দৃশ্যমান হন। সেই দীর্ঘ ঋজু দেহ, প্রিন্স কোট আর উজ্জ্বল মুখচ্ছবি। চেহারায় কি একটু ক্লান্তির ছাপ? হবে হয়ত। পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘদিন থাকা। তারপর পথের ক্লান্তি তো আছেই। বিমানের সিঁড়িতে দেখা যায় তাঁকে। কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় বলতে হয়, ‘অমনি পলকে দারুণ ঝলকে হৃদয়ে লাগিল দোলা। জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা।’ একত্রিশবার তোপধ্বনি আর লাখো মানুষের উল্লাস। বঙ্গবন্ধুকে বরণ করল তাঁর প্রিয় স্বদেশ, প্রিয় মাটি। বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন তিনি। প্রিয় দেশের বাতাস নিলেন বুক ভরে। স্পর্শ করলেন এই দেশের মাটি। প্রিয় আলো তাঁকে ছুঁয়ে দিল। নাম না জানা কোন পাখি কি দূরে কোথাও গান গেয়ে উঠেছিল? জানা যায়নি। সেদিনের সেই অপরাহ্ন নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টটি ছিল এ রকম, ‘ঢাকায় আজ জনতা তাঁকে এক বিজয়ী বীরের সংবর্ধনা দেয়। তিনি বিমানবন্দর থেকে সোজা রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় পৌঁছান।’

অত্যন্ত ক্লান্ত শেখ মুজিব তাঁর ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, পৃথিবীর কোন জাতিকেই স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতরকার সমস্ত সম্পর্ক চিরতরে শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, সব দেশই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং বাংলাদেশ অবশ্যই জাতিসংঘের সদস্যপদ পাবে। শেখ মুজিব বলেন, বাংলাদেশের মূল ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তিনি তাঁর ৩০ লাখ বাঙালীকে হত্যা করার অপরাধে হত্যাকারীদের বিচারের দাবি করেন। তিনি আশা করেন, অবশ্যই এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে তদন্ত হবে।

সেদিন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত সবারই জানা, বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তাঁর দুই চোখ গড়িয়ে অশ্রু“পড়ছিল বার বার। তিনি আবেগভরা কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং চিরদিন স্বাধীন থাকবে।’

এই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সব সময় জনগণ তাঁর প্রথম চাওয়া ও পাওয়া। ৯ মাস ১৬ দিন কারাবাস শেষে যেদিন দেশে ফিরলেন তিনি সেদিন প্রথম গেলেন জনগণের কাছে। প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ কি তাঁর মনে পড়েনি? মনে পড়েনি সন্তানদের কথা? বাড়িতে বৃদ্ধ পিতা, বৃদ্ধা মা। কাউকে কি মনে পড়েনি তাঁর? পড়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু জনগণের নেতা জনগণের কাছেই আগে ফিরেছেন। অপরাহ্নে বিমানবন্দরে নামার পর তিনি গেলেন রেসকোর্স ময়দানে, যেখানে জনগণ অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য। এরপর ফিরলেন সেই বাড়িতে যে বাড়িতে তাঁর পরিবারকে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল। ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে। সে বাড়িতে তখন নতুন আর এক অতিথির আগমন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার ছেলে জয়। বঙ্গবন্ধু বাড়িতে ফিরলে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারির ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার রিপোর্টে তাঁর বাড়ি ফেরার সেই দৃশ্যের বর্ণনা আছে এভাবে, ‘বিশাল জনসভা শেষে ঢাকা শহরের উপকণ্ঠে একটি গৃহে ঘটে বর্ণনাতীত এক আবেগপ্রবণ পুনর্মিলন। বন্ধুদের শুভেচ্ছাসূচক ফুলের পাপড়িতে শোভিত শেখ মুজিব তাঁর দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। ঘটনা এর চেয়েও এগিয়ে যায় যখন শেখ মুজিব তাঁর ৯০ বছরের পিতার পা স্পর্শ করে ৮০ বছরের মাকে বুকে জড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

পাকিস্তানী সামরিক জান্তার কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এলেও এ দেশের কিছু মানুষের চক্রান্তে শেষ পর্যন্ত দেশের মাটিতেই জীবন দিতে হয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদের এই মহান নেতাকে। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু তাঁর নীতি ও আদর্শ রয়ে গেছে। বাঙালী জাতি বহন করছে তাঁর উত্তরাধিকার। বহন করবে। যতদিন বাংলাদেশ আছে, আছে বাঙালী জাতি, বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারও ততদিন থাকবে।

বাঙালীর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সোমবারের আবেগ ও আনন্দ আজকের দিনে বুঝিয়ে বলা কঠিন। স্বপ্ন ছিল তাঁর একটি স্বাধীন দেশের। স্বপ্ন ছিল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের। স্বপ্ন ছিল এদেশের খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার। বঙ্গবন্ধু একটি অসাম্প্রদায়িক, সাম্যের বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। ধর্মীয় মৌলবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তাই বিচার শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বুকে নিয়ে দিনযাপন করেছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তিনি জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। বাবার মতোই তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সমৃদ্ধির দিকে। ২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ১০০ দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিইওওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিন ১৯০টি দেশের এ তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৮১তম। মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নতি হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু গড় আয় এক হাজার ৯০০ মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। ২০০৯ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলার। এখন তা ৪৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ২০০৮ সালে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। এ বছর ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২২ সালের আগেই এ প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ গত এক বছরে ব্যাপক উন্নতি করেছে। ফলে আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বঙ্গবন্ধু কন্যার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও কর্মপরিকল্পনায় আন্তরিকতা এবং মানব ভাগ্য উন্নয়নে দৃঢ় অঙ্গীকার আছে বলেই এমন সাফল্য এসেছে।

আজ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে আমরা সবাই তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার শপথ নেব। সাম্যের ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতকে শক্তিশালী করব। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক

nazrul@gmx.at

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়