শিরোনাম
◈ পোশাক রপ্তানিতে ইউরোপের বাজারে চীনের আধিপত্য, চাপে বাংলাদেশ ◈ কুমিল্লার টমছমব্রিজে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য: প্রতিদিন ঘটছে একের পর এক ছিনতাই ◈ বিশ্বকাপ বাছাই  খেল‌তে মা‌ঠে নাম‌ছে জার্মানি, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম  ◈ অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা ◈ ৪ দাবি না মানা পর্যন্ত সড়ক না ছাড়ার ঘোষণা সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের ◈ ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবন সাময়িকভাবে ‌‘কারাগার ঘোষণা’ ◈ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় সরকার এমন কোনো সিদ্ধান্ত  নেয়নি: পাঁচ ব্যাংক নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি ◈ গাজায় থাকা সব জীবিত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস ◈ সাংবাদিকদের আচরণে ‘বিরক্ত’ রিপন মিয়া ◈ ১৭ দিন পরই বাতিল হয়ে যাবে অতিরিক্ত সিম, বিটিআরসির জরুরি বার্তা

প্রকাশিত : ১৯ অক্টোবর, ২০২০, ০৮:৪৬ সকাল
আপডেট : ১৯ অক্টোবর, ২০২০, ০৮:৪৬ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

করোনাকাল: হতাশা-অস্থিরতায় বাড়ছে নৃশংসতা!

যায়যায়দিন: নারী ও শিশুর ওপর যৌন সহিংসতা ও নৃশংসতা নতুন নয়। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সামাজিক-পারিবারিক অস্থিরতা, কর্মহীনতা ও হতাশায় ধর্ষণ এবং খুনের নৃশংসতা বাড়ছে বলে মনে করছেন মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা। সেই সঙ্গে মাদক ও প্রযুক্তির অপব্যবহারে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে গ্যাং কালচার। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিভিন্ন বীভৎস ঘটনাকে 'মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন' বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।

এদিকে, সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পরিবার সমাজব্যবস্থার মূলভিত্তি। সামাজিক অস্থিরতায় পারিবারিক কলহের ঘটনা বেড়ে গেছে। বেড়েছে পরিবারের এক সদস্যের হাতে আরেক সদস্যের খুন হওয়ার মতো ঘটনাও। স্বামী-স্ত্রীর কলহের কারণে জীবন দিতে হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুকে। এমনকি পারিবারিক দ্বন্দ্বে পরিবারের সবাই একসঙ্গে আত্মহত্যাও করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মানুষ এখন আপনজনদের কাছেও নিরাপদ নয়। পুলিশের অপরাধ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বছরে মোট হত্যাকান্ডের প্রায় ৪০ শতাংশ সংঘটিত হচ্ছে পারিবারিক কলহের কারণে।

সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে এবং খাগড়াছড়িতে এক প্রতিবন্ধী নারীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। নোয়াখালীতে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও সামাজিক মাধ্যমে সেই ঘটনার ভিডিও প্রকাশ, নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো তার টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে বিবৃতিটি শেয়ার করেছেন।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই নানা সমস্যা থাকে। অনেক কারণ

একত্রিত হয়ে এ ধরনের পারিবারিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে-হতাশা, পরকীয়া ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। সাভারে নীলা রায় নামে এক ছাত্রী বখাটের হাতে খুন হওয়ার ঘটনা সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়াবহতার কথা জানান দিচ্ছে।

করোনাকালেও ধর্ষণ, আত্মহত্যা, শিশু নির্যাতন, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আর হানাহানির খবর প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে গণমাধ্যমে। প্রযুক্তির অপব্যবহারে বাড়ছে অস্থিরতা। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ জন। অধিকাংশ খুন পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে।

বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, সামাজিক অপরাধ প্রবণতা দিনের পর দিন বাড়ছে। হত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো থেকেই বোঝা যাচ্ছে, সামাজিক অবক্ষয় কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। করোনাকালে অধিকাংশ মানুষ ঘরে থাকায় বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতা। নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীরা সুরক্ষা চাইতে পারছেন না। বিচার চাইতে গিয়ে ফেসবুক ও অনলাইনে তারা হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছেন। সুশীল সমাজের যারা সুরক্ষা চাইতে মাঠে নেমেছেন-তারাও হামলা ও মামলার শিকার হচ্ছেন। সরকার তাড়াহুড়া করে ধষর্ণের যে আইনটি সংশোধন করেছে, তা যথাযথ হয়নি বলে অভিযোগ করছেন নারী সংগঠনগুলো।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, ধর্ষণের ভয়াবহতায় প্রতিটি পরিবার তাদের নারী সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং শঙ্কিত। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ ও খুন বাড়ছে। করোনাকালে সামাজিক অস্থিরতা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। করোনাকালে কর্মহীন ও আয় কমে যাওয়ায় বাড়ছে হতাশা, বেড়েছে মানসিক বিষণ্নতা ও আর্থিক সংকট। সমাজে বেড়েছে অপরাধ। এই অপরাধ এখন পরিবারে ঢুকে পড়েছে। অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে কিশোর-তরুণরা। আগে ইভটিজিং বা বখাটেপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সম্প্রতি খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কেনাবেচা ও ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা।

আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে, শিশু হত্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ৩৩২ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর-এই ৯ মাসে শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৩১২টি। ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৪০০ নারী এবং ৮১৫ শিশু ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়। ২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণের মামলা ছিল ৭২৭টি এবং নারী ধর্ষণের মামলা ছিল ৩ হাজার ৯০০টি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, গত সাত বছরে তালাকের পরিমাণ বেড়েছে ৩৪ শতাংশ।

বারডেমের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এনামুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, অপরাধী হয়ে কেউ জন্ম নেয় না। মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে। পারিবারিক ও সামাজিক সংঘাতে মানসিক যন্ত্রণা বা মনোকষ্টে ভোগে কেউ কেউ বিপথগামী হচ্ছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পর্নো ছবির ছড়াছড়ি হচ্ছে। নৈতিক শিক্ষার অভাব রয়েছে। বিষণ্নতা থেকেও মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে বিষণ্নতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থাৎ ৭৪ লাখেরও বেশি। ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসন এবং নীতি-নৈতিকতার অভাবে হিংস্র হয়ে উঠছে কেউ কেউ। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারিবারিক বন্ধন জোরদার করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়াতে হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মোহিত কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, মানুষের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছে। হতাশার কারণে ব্যক্তির মধ্যে অপরাধ মনোভাব ও ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি কাজ করে। দেশজুড়ে নারীর প্রতি পাশবিক নির্যাতন, সহিংসতা ও নৃশংসতা চলছে। প্রতিনিয়ত যেসব পৈশাচিক আর হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি আমরা হচ্ছি তা আসলে সমাজেরই প্রতিচ্ছবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম গণমাধ্যমকে বলেন, করোনাকালে অনেকে কর্মহীন হয়ে অলস থাকছেন। বাংলায় একটা কথা আছে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তখন নেতিবাচক চিন্তা কাজ করে। তরুণদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। অর্থ সংকট, কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা, মূল্যবোধের অভাবে মাদক, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের ভয়ংকর নেশায় জড়িয়ে নানা ধরনের ক্ষোভ ও হতাশায় ভোগে মানুষ। এর মধ্য দিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ধর্মীয় মূল্যবোধের পাশাপাশি দেশের যুবসমাজকে নীতি-নৈতিকতাবোধেরও যথাযথ শিক্ষা প্রদান করতে হবে পারিবারিকভাবে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সমাজবিজ্ঞনী অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির গণমাধ্যমকে বলেন, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। করোনাকালে নানা সংকটে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। জনবহুল সমাজে অস্বাভাবিক জীবনযাপন বেড়েছে। পারিবারিক বন্ধন ঢিলেঢালা ও অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়াই মূলত দায়ী। পারিবারিক খুনোখুনি বেশির ভাগের জন্যই দায়ী পরকীয়া। এছাড়া সমাজব্যবস্থা এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ও দায়ী। ধর্ষণ, খুন এবং জোর করে তুলে নিয়ে নারী ও শিশুকে পাশবিক নির্যাতন করা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বলা যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়