শিরোনাম
◈ প্রাথমিক স্কুলে অ্যাসেম্বলি বন্ধ রাখার নির্দেশ ◈ গাজায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল ◈ পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার ২৭ বস্তা টাকা, গণনা চলছে ◈ সাতক্ষীরায় এমপি দোলনের গাড়িতে হামলা ◈ চুয়াডাঙ্গার পরিস্থিতি এখন মরুভূমির মতো, তাপমাত্রা ৪১ দশমিক  ৫ ডিগ্রি ◈ ফরিদপুরে পঞ্চপল্লীতে গণপিটুনিতে ২ ভাই নিহতের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১ ◈ মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ দাম বেড়েছে আলু, ডিম, আদা ও রসুনের, কমেছে মুরগির  ◈ প্রার্থী নির্যাতনের বিষয়ে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, হস্তক্ষেপ করবো না: পলক ◈ ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৮টি কূপ খনন শেষ করতে চায় পেট্রোবাংলা

প্রকাশিত : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ০৯:৪৯ সকাল
আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ০৯:৪৯ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মুহম্মদ সবুর: জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় ভাষণের মহিমা

মুহম্মদ সবুর : লাল সবুজের রক্তমাখা পতাকা পত পত করে উড়ছে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে। আরও শতাধিক দেশের পতাকার পাশে বাংলাদেশ ঠাঁই করে নিয়েছে নিজের আসন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশন। অধিবেশন কক্ষে সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়ক ও সরকার প্রধানরা। অধিবেশনে সভাপতির আসনে আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রামের নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকা। সভাপতি ‘বাঙালি জাতির মহান নেতা’ হিসেবে পরিচিতি জানিয়ে বক্তৃতা মঞ্চে আহ্বান করেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু সদর্পে বীরোচিত ভঙ্গিমায় আরোহণ করলেন বক্তৃতা মঞ্চে। প্রথম এশীয় নেতা, যিনি এই অধিবেশনে সবার আগে ভাষণদান করেন। দৃপ্ত পায়ে বক্তৃতা মঞ্চে উঠে ডায়াসের সামনে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। মুহুর্মুহু করতালি। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করেন মাতৃভাষা বাংলায়। যে ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে বাঙালি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, সেই ভাষায় প্রথম ভাষণ জাতিসংঘে। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে বিশ^ দরবারে আবার ঠাঁই করে দিলেন। এর আগে ১৯১৩ সালে বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তির মধ্যদিয়ে বিশ^বাসী জেনেছিল বাংলা ভাষার অমর অমল আবেদন। এর ষাট বছর পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে উচ্চারণ করলেন বিশ^সভায় বাংলা ভাষার অমর শব্দসমূহ। জাতিসংঘে বিশ্বের সকল নেতা নিজ নিজ মাতৃভাষাতেই ভাষণ দিয়ে থাকেন। জাতিসংঘের সরকারি ভাষা ছয়টি। ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, চীনা, স্প্যানিশ ও আরবি। এই ৬ ভাষাতেই বক্তৃতা রূপান্তরিত হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক পলকে চারদিক দেখে নিলেন। এর আটদিন আগে ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য দেশ হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। এর আগে ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে দুই’দুইবার চীনের ভেটোর কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে পারেনি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা করলেও ১৯৭৪ সালে এসে চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে অনেকটা নমনীয় হয়। ফলে চীন তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তুমুল করতালির মধ্যে নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। ওই দিনই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন কক্ষে বাঙালির প্রথম প্রবেশ ঘটে। বিশ^ মানচিত্রে বাংলাদেশ স্থায়ী আসন পেলো যেন। বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্যভুক্তির পর বিশে^র অনেক দেশই অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখে। জাতিসংঘে মার্কিন স্থায়ী রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘বিশে^র পার্লামেন্টে নতুন দেশ বাংলাদেশকে স্বাগতম’ জাতিসংঘের মহাসচিব তখন ড: কুর্ট ওয়ার্ল্ডহেইম। তিনিও বাংলাদেশকে স্বাগত জানান, তবে প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাকব মালিক ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং। তারা তাদের বক্তব্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। সকল অভিনন্দনের জবাবে বাংলাদেশের পক্ষে বিবৃতি পাঠ করেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্য পদ লাভের ঘোষণায় সেদিন রাজধানী ঢাকায় শত শত আনন্দ মিছিল আর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে যে দীর্ঘ র‌্যালিটি বের হয়, তাতে বাংলাদেশের পতাকা হাতে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তোলার সৌভাগ্য হয়েছিলো। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের আটদিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু সাধু বাংলায় জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণের প্রারম্ভেই বললেন, ‘মাননীয় সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’

একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অধ্যুষিত বাংলার মানুষ যুদ্ধ ও লড়াই করেছে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে, বঙ্গবন্ধুর নামে। বঙ্গবন্ধু তখন ছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আরেকটি নাম। বীর বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুরের নামে। বাঙালির ইতিহাসের নতুন স্রষ্টা ও পরিপূর্ণতাদানকারী বঙ্গবন্ধু এরপর ভাষণে তুলে ধরেন বাঙালি জাতির সংগ্রামী চেতনার সফল সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। বললেন, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশে^র সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাক্সিক্ষত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত রহিয়াছে আমাদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ^ গড়িয়া তুলিবার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের এই অঙ্গীকারের সহিত শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবেন’। বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু অভিনন্দন জানান। অধিবেশনের সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সক্রিয় যোদ্ধা সভাপতি থাকাকালেই বাংলাদেশকে এই পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নেওয়া হইয়াছে। এর আগের বছর ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলন সফল করার ক্ষেত্রে আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকাকে অভিনন্দন জানান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামে সমর্থনদানকারী দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যাহাদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ^সমাজে স্থান লাভ করিয়াছে এই সুযোগে আমি তাঁহাদের অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের সংগ্রামে সমর্থনকারী সকল দেশ ও জনগণের প্রতি আমি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ছিলো শান্তি ও ন্যায়ের মিলিত সংগ্রাম। জাতিসংঘ গত ২৫ বছর ধরিয়া এই শান্তি ও ন্যায়ের জন্যই সংগ্রাম করিয়া যাইতেছে।’

বঙ্গবন্ধু জনগণের অধিকার কেড়ে নেয়োর ক্ষেত্রে দেশে দেশে সেনাবাহিনী ব্যবহারের তীব্র নিন্দা জানান এবং বাংলাদেশসহ চারটি দেশ আলজেরিয়া, গিনি বিসাউ এবং ভিয়েতনামের নামোল্লেখ করে বলেন, ‘এই দেশগুলো অপশক্তির বিরুদ্ধে বিরাট বিজয় অর্জন করিতে সক্ষম হইয়াছে।’ ‘চূড়ান্ত বিজয়ের ইতিহাস জনগণের পক্ষেই থাকে’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু ফিলিস্তিন, জাম্বিয়া এবং নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। অসাধারণ মননশীলতাপূর্ণ বাঙালি জাতির জনকের ভাষণের সময় পুরো অধিবেশন কক্ষ ছিলো পিনপতন নিস্তব্ধ। বঙ্গবন্ধু আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য জাতিসমূহের পথ কী হবে সে নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘পথ বাছিয়া লইবার সঠিকতার উপরেই নির্ভর করিতেছে ধ্বংসের অথবা সৃজনশীলতার দিকে যাত্রার কঠিন বাস্তবতা।’ বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তখন দারিদ্র্য, বন্যা, ফসলহানি, ক্ষুধা, মন্দা, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, গুপ্ত হত্যা চলছিল। বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু তার পুরো ভাষণে একটি মাত্র দেশের সরকার প্রধানের নামোল্লেখ করেন। কৃতজ্ঞতা সহকারে বঙ্গবন্ধু তার বন্ধু আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদীনের নামোল্লেখ করে বলেন, ‘জোট নিরপেক্ষ দেশসমূহ যাহাতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় প্রেসিডেন্ট বুমেদীন তাহার জন্যে বিশেষ আহ্বান জানাইয়াছিলেন’। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বুমেদীনের এই অবদানের কথা বঙ্গবন্ধু অন্যত্রও বলেছেন। গুটি কয়েক মানুষের অপ্রত্যাশিত সমৃদ্ধির পাশাপাশি বিপুল জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশার কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতা এর যুক্তিসঙ্গত সমাধান দাবি করে বলেন, অন্যথায় সমগ্র বিশ্বে মহাবিপর্যয় আসন্ন। বঙ্গবন্ধু বার্মাসহ (মিয়ানমার) আঞ্চলিক ‘জোন’ গঠনের সম্ভাবনা ও বাস্তবতার প্রতি তার অনুভূতি তুলে ধরেন ভাষণে। বলেন তিনি, ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই উপমহাদেশের শক্তি কাঠামো সৃষ্টি করিয়াছে। আমরা শান্তি চাই। আর কেবল এই জন্যই অতীতের সকল গ্লানি ভুলিয়া যাইয়া পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়াছি। শান্তির জন্য ইহা আমাদের একটি বিনিয়োগ বলিতে পারেন।’

বঙ্গবন্ধুর আবেগ সকল বিশ্বনেতার কাছে তার মহৎ চেতনাকেই প্রকাশিত করে। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, ‘জাতিসংঘের সাফল্য ও সম্ভাবনার যে দিক বাংলাদেশ উপলব্ধি করিয়াছে, আর কেউ তেমনটি করিতে পারে নাই।’ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের যুদ্ধের ক্ষত মুছে ফেলতে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষ পর্যায়ে বেশ আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘সম্মানিত সভাপতি, মানুষের অজয় শক্তির প্রতি আমার বিশ্বাস রহিয়াছে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষ অসম্ভবকে জয় করিবার ক্ষমতা রাখে।’ বঙ্গবন্ধু উদাত্ত ভরাট কণ্ঠে বললেন, ‘অজয়কে জয় করিবার সেই শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়াই আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিবো।’ এরপর তিনি দৃঢ়তার সাথে আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো যেই সব দেশ দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, কেবল তাহাদেরই এই দৃঢ়তা ও মনোবল রহিয়াছে, মনে রাখিবেন সভাপতি, আমার বাঙালি জাতি চরম দুঃখ ভোগ করিতে পারে, কিন্তু মরিবে না, টিকিয়া থাকিবার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমার জনগণের দৃঢ়তাই আমাদের প্রধান শক্তি।’ বঙ্গবন্ধু বাঙালি জনগণের শক্তিমত্তার সংগে পরিচিত ছিলেন। বুঝেছিলেন, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বঙ্গবন্ধু সে সঙ্গে পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। জাতির অগ্রগতিও বিকাশে নিয়েছিলেন নানা পদক্ষেপ। এই সেই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন। যেখানে একাত্তর সালের নয় মাস এবং পরবর্তী সময়ে ‘বাংলাদেশ’ নিয়ে বিতর্কে অংশ নিয়েছে প্রায় সব সদস্য দেশ চীন, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র একদিকে, অপরদিকে বাংলাদেশের পক্ষে ভারত, কিউবা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল।

তাই বাংলাদেশ নামটি ছিলো সদস্য দেশগুলোর কাছে পরিচিত। বাংলাদেশের সদস্যভুক্তি ছিলো প্রতিটি জাতি ও রাষ্ট্রের কাছে আগ্রহের বিষয়। বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্যদিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণ শেষ করেন। বিশ্বের নানা দেশের নেতারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে অভিনন্দন জানাতে সারিবদ্ধভাবে জড়ো হন। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস কালাহান এই ভাষণ সম্পর্কে জাতিসংঘে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এটি ছিলো একটি শক্তিশালী ভাষণ।’ কিউবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই ভাষণকে ‘ইতিহাসের এক অবিচ্ছিন্ন দলিল’ হিসেবে অভিধা করেন। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা যখন জাতিসংঘে ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন সারা বাংলাদেশ গর্বিত হয়ে উঠেছিলো সেদিন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দারিদ্র্যের ভেতরও বাঙালি চিত্ত গৌরবের অংশীদার হয়ে উঠেছিল। স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব, জাতিসংঘে বিশ্বের নানা ভাষা-ভাষী ও জাতি-গোষ্ঠীর সামনে বাংলা ভাষায় বাঙালির প্রথম ভাষণ দিলেন। বাঙালি যেনো জগৎসভায় ঠাঁই পেল। বাংলা ভাষায় পৃথিবীর মধ্যে সর্বপ্রথম ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। যে ভাষণে তিনি তার দেশ ও তার জাতির সংগ্রামের ইতিহাস, দৃঢ়তা এবং প্রত্যয়ের কথা সকলকে শুনিয়ে এই জাতিকে সম্মানিত ও গৌরবান্বিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ৬৮তম অধিবেশনে ভাষণ দিতে এখন নিউইয়র্কে। তারই প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত করেছে জাতিসংঘ।

লেখক : গবেষক, কবি, প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়