আরিফুজ্জামান তুহিন: ফরহাদ মজহারকে সাম্প্রতিককালে আমি অনেক বেশি নির্মোহ ও প্রশংসার চোখে দেখি। এর কারণ তিনি অন্য মতের, ধারার, রাজনীতির গ্রুপ উপ-গ্রুপের বুদ্ধিজীবীদের মতো ত্যানা পেচায় পক্ষ নেন না। তিনি সরাসরি পক্ষ নেন। এ জন্য তাকে লাল সালাম। ফরহাদ মজহার প্রয়াত শফী হুজুরকে আল্লাহ ক্ষমা করার প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে জীবন এবং মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন। অতএব মানুষের আয়ু কখনোই মহাকালে উত্তীর্ণ হতে পারে না। নিশ্চয়ই সত্য হচ্ছে বিশ^াস, মতবাদ এবং আমল নির্বিশেষে সকলেরই সীমা মওতের দ্বারা মাপা, নির্দিষ্ট। মানুষ সেখানেই ফিরে যায় যেখান থেকে এসেছে। ইন্তেকালের পর যার যার আমলটুকু শুধু রয়ে যায়। আল্লাহ যেন আল্লামা আহমদ শফীর সৎ আমল কবুল করে নেন এবং মাটিতে তৈরি মানুষের সীমাবদ্ধতা বুঝে সকল দোষ ও অপরাধ মার্জনা করেন।
মানুষের আয়ু মহাকালে উত্তীর্ণ হতে পারে কী, পারে না সেই তর্ক এখনই দাগ টেনে দেওয়ার মীমাংসার ইতি ঘটানো হয়তো ধর্মতাত্ত্বিকদের জন্য ঠিক আছে। কিন্তু দার্শনিক এবং সমাজ বিজ্ঞানীর কাজ এটা না। অন্তত এই যুগে এসে সেটি ক্লিশে লাগে। ফরহাদ মজহারকে আমি দার্শনিক ও সমাজ বিজ্ঞানী হিসেবে জানতাম। তিনি সেখান থেকে ধর্মগুরুর জায়গা নিয়েছেন, তা জানা ছিলো না। এই লেখাটি তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকলো। তবে ধর্মগুরু হলে তিনি দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে পারবেন না, তা বলছি না। বরং ধর্মগুরুদের বেশি বেশি করে দর্শন ও সমাজ বিজ্ঞান পড়া এবং তা নিয়ে পর্যালোচনা করা দরকার। লাতিন অ্যামেরিকাতে বহু ফাদারকে পাওয়া যাচ্ছে যারা কমিউনিস্টদের পক্ষে গেরিলা যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন। আমেরিকা এসব চার্চকে রেড চার্চ বলছে। ফরহাদ মজহারের গোটা লেখার পর্যালোচনা করবো না, করার প্রয়োজন দেখছি না। কিন্তু আরেকটা অংশ নিয়ে কথা বলতে চাই। তিনি লিখেছেন, ‘২০১৩ সালে ইসলাম বিদ্বেষী এবং ইসলাম নির্মূল রাজনীতির বিপরীতে গড়ে ওঠা হেফাজতে ইসলামের প্রতিরোধ সংগ্রাম ও লড়াইয়ের চূড়ান্ত জয়-পরাজয় নির্ণয়ের মুহূর্ত ছিলো শাপলা চত্বর। শাপলা চত্বরে জনগণের লড়াই নতুন রূপ ধারণ করেছিলো। সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা শাপলা মঞ্চের তাৎপর্য আল্লামা আহমদ শফী ধরতে পারেননি।’
দারুণ একটা গুরুত্বপূর্ণ স্টেটমেন্ট। দারুণতো বটেই। নাম উল্লেখ না করলেও তিনি মূলত শাহবাগ আন্দোলনের কাউন্টার হিসেবে গড়ে ওঠা হেফাজতের আন্দোলনকেই বুঝিয়েছেন। ফরহাদ মজহার বুঝিয়েছেন, শাহবাগ ইসলাম বিদ্বেষী এবং ইসলাম নির্মূলের আন্দোলন ছিলো। শাপলা চত্বরে জনগণের লড়াই নতুন রূপ ধারণ করেছিলো। অবশ্য শাহবাগ আন্দোলনে ইসলাম নির্মূল ও ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে শাপলা চত্বর ইসলাম রক্ষার আন্দোলন ছিলো, এটা তিনি বলেননি। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ। তিনি যেদিকে নির্দেশ করেছেন, সেটি হলো গণ-অভ্যুত্থান পরিস্থিতি তৈরি হওয়া শাপলা চত্বরের তাৎপর্য বুঝতে পারেননি হেফাজতের আমির শফী হুজুর। তাহলে ফরহাদ ভাই বলতে চাইছেন, হেফাজত ইসলাম একটি অভ্যুত্থান পর্বে ছিলো, যেটি শফী হুজুর রাজনীতি না বোঝার কারণে সংগঠিত করতে পারেননি। কিন্তু এতোদিন যে আমরা শুনে এসেছি, শাহবাগের বিরুদ্ধে শাপলা চত্বর অরাজনৈতিক আন্দোলন ছিলো, যা মূলত ইসলামকে রক্ষা করার জন্য জন্য সময়ের প্রয়োজনে হয়েছে। শফী সাহেবরা অভ্যুত্থান ঘটাতে পারলে ফরহাদ ভাই খুশি হতেন, অন্তত এখান থেকে এই ব্যাখ্যা করা যায়। তিনি আরেক স্থানে বলেছেন, সাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী এবং সাম্প্রদায়িক ইসলামও বাংলাদেশে কম শক্তিশালী নয়। কিন্তু হেফাজত ইসলাম নিজে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চর্চা করে থাকে ফরহাদ ভাই সেটি একবারও বললেন না। তিনি বললেন না, আস্তিক-নাস্তিক কথিত এই লড়াই মূলত আওয়ামী লীগের প্রকল্প ছিলো, ভারতের প্রকল্প ছিলো সে কারণে ২০১৩ সালের গোটা বছর গেলো নাস্তিক ও আস্তিক ভেদের ছায়াযুদ্ধে। যার ফলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপির কোনো বাস্তবতাই থাকলো না মাঠে নামার।
ফরহাদ ভাই লিখেছেন, ‘জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন গড়ে ওঠে।’ দারুণ পয়েন্ট। গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠানো হয়েছে যাতে ২০১৪ সালের নির্বাচন নির্বিঘ্নে করা যায়। আর স্থায়ীভাবে বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ থেকে প্রান্তে ঠেলে ফেলা যায়। সফল হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র। দেশীয় চক্রে হেফাজত ইসলাম খেলেছে। আন্তর্জাতিক চক্রের খপ্পরটা ছিলো ভারত-আমেরিকা-ইসরায়েল, তারাও সফল। সারা দুনিয়াতে বাংলাদেশকে চরমপন্থী মুসলমানের দেশ হিসেবে এ সময় চিহ্নিত হয়েছে। যে দেশে ইসলাম রক্ষার কথা বলে হেফাজত ইসলাম নামের একটি সংগঠন নাস্তিকদের তালিকা করেছে। এরপর একের পর এক কথিত নাস্তিক মারা গেছেন। এটাইতো দরকার ছিলো। তো এই যে ওয়ার অন টেররের রাজনীতি সেটা হেফাজত ইসলাম ও আওয়ামী লীগ মিলে করেছে, যার একপাশের নেতা ছিলেন শফী হুজুর। রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি আর ইসলামের বিভিন্ন ফেরকার সিলসিলা এক না। ওয়ার অন টেররের রাজনীতি শেষ। ফলে সংগঠন হিসেবে হেফাজত ইসলামের প্রয়োজনীয়তা কতো দিন থাকবে, থাকলেও তার তীব্রতা কতোটা থাকবে সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। শফী হুজুর ইতিহাসে থাকবেন, আলবৎ থাকবেন। কারণ একটি জনপদে রক্তের হোলিখেলার সূচনা তিনি করেছিলেন। ফেসবুক থেকে