ডেস্ক রিপোর্ট : করোনার কারণে চলতি বছরের মার্চের শেষ দিকেই পর্যটকদের আগমন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয় লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি উদ্যানে। এর তিন মাস পর দেখা যায়, দুই উদ্যানেরই সৌন্দর্য অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে প্রকৃতি। সমৃদ্ধ হয়েছে জীববৈচিত্র্য। বনের ভেতর মানুষের উৎপাত বন্ধ থাকায় এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত হওয়ায় এমনটি সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে বন অধিদপ্তর।
সম্প্রতি বন অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি উদ্যানে পর্যটকের আগমন বন্ধ থাকায় বৃক্ষরাজি নতুন পত্রপল্লব ও ফুল-ফলে সুশোভিত হয়েছে। গাছে গাছে শোনা যাচ্ছে বিবিধ পাখির কলরব। বনে দেখা যাচ্ছে নানা রকমের বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ, যা করোনার আগে কম পরিলক্ষিত হতো।
কেবল লাউয়াছড়া বা সাতছড়ি নয়, জনসমাগম না হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, বাঁশখালী ইকোপার্ক ও চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যেও পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও বনজ সম্পদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এ নিয়ে বন বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে বিভিন্ন উদ্ভিদের প্রাকৃতিক পুনর্জন্ম হয়েছে। সেখানে নানা প্রজাতির উন্মুক্ত প্রাণীর বিচরণ অনেক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দিনের বেলা নির্ভয়ে চলাচল করছে বন্য মোরগ ও বন্য শূকর। দেখা মিলেছে বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণীর। অজগর ও গুই সাপের চলাফেরাও বেড়েছে। পাখির আনাগোনাও বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক। শুধু তা-ই নয়, খাঁচায় আবদ্ধ প্রাণীর আচরণেও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক বলে মনে করে বন বিভাগ।
এসব ইকোপার্কে বেড়েছে বন্য হাতির আনাগোনাও। বাঁশখালী ইকোপার্কে বন্য হাতি প্রায় প্রতিদিন অফিস ও অন্যান্য স্থাপনার খুব কাছে চলে আসে। এই ইকোপার্কে প্রচুর বানর প্রতিনিয়ত বিচরণ করছে, যা আগে পার্ক বন্ধ হলে বিকাল ৫টার পর বের হতো। আবার বাঁশখালী ইকোপার্ক এলাকায় দেখা মিলেছে মায়া হরিণের। বন মোরগ ও মথুরার আনাগোনার পাশাপাশি জলপাখির দেখা মিলছে, যা আগে কখনো এ মৌসুমে দেখা মিলত না। এসব প্রাণীর পাশাপাশি নিশাচর প্রাণীর আনাগোনাও বেড়েছে। দেখা মিলছে মেছোবাঘ, ছোট বাগডাশ, বড় বাগডাশ, শিয়াল, গন্ধগোকুলের। করোনাকালীন বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ কমে যাওয়াটা প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীর জীবনধারণ তথা নিরাপদ প্রজনন ও বংশ বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভবিষ্যতে জাতীয় উদ্যানগুলো সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতি বছর মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত পর্যটক আগমন বন্ধ বা সীমিত সংখ্যায় নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে মতামত দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রকৃতির এ আপন রূপে ফিরে আসা সম্পর্কে অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, করোনার আগে থেকেই বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও বনজ সম্পদের উন্নয়নে কাজ করে আসছে বন বিভাগ। করোনাকালীন জনসমাগম না থাকায় বন্যপ্রাণীরা অবাধ চলাচলের সুযোগ পেয়েছে। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট সময় এসব অভয়ারণ্য, বিভিন্ন উদ্যান, ইকোপার্ক এসব স্থাপনায় জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবছি। এরই মধ্যে সুন্দরবনের মূল পর্যটনস্থলে জুন, জুলাই, আগস্ট মাসে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত জনসমাগমের কারণে আমাদের বন্যপ্রাণীরা মানুষের ওপর বেশ বিরক্ত। করোনার সময়ে সে জায়গায় তারা বেশ খানিকটা স্বস্তি পেয়েছে। কেবল বন্যপ্রাণী নয়, যেসব প্রাণী খাঁচায় ছিল তাদের আচরণেও এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। ভবিষ্যতে এসব ধরে রাখতে আমাদের উদ্যোগ থাকবে।
এদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলাধীন বিভিন্ন বন বিভাগের ইকোপার্ক, জাতীয় উদ্যান পর্যটন কেন্দ্র ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে করোনাকালে জনসমাগম না হওয়ায় পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বনজ সম্পদের উন্নয়ন এবং প্রকৃতি তার নিজ স্বরূপ ফিরে পেয়েছে, বিভিন্ন প্রাণীর অবাধ চলাফেরা দৃশ্যমান হয়েছে।
পরিবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মাহবুবুর রহমান অপু। এ বিষয়ে বেশকিছু গবেষণাও রয়েছে তার। এখন কাজ করছেন এনসিসিবির রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি অফিসার হিসেবে। তিনি বলেন, যেকোনো পর্যটন এলাকায় কী সংখ্যক পর্যটক যেতে পারবে তা আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। এছাড়া পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতেও কাজ করতে হবে, যাতে তারা বন, প্রকৃতি পরিবেশ এসবের বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হন। এসব প্রাকৃতিক পর্যটন এলাকার রিসোর্ট, রেস্টুরেন্টগুলোকেও এ সচেতনতা কার্যক্রমের অংশ করে নিতে হবে। বন, বন্য পরিবেশ বা বন্যপ্রাণীর জীবনযাত্রায় কোনো ধরনের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে পর্যটন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। তাহলে করোনায় ফিরে আসা প্রাণপ্রকৃতি আমাদের মাঝে সব সময় বিরাজ করবে।
সূত্র : বণিক বার্তা