তরিকুল ইসলাম : নারীদের মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার দিয়েছে এবং সম্পত্তির অধিকার পাচ্ছেন তাঁরা। দেশের যেকোনও প্রান্তে পছন্দসই পাত্রের সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হওয়াতেও কোনও বাধা নেই। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একোরাল মহিলাদের দাবিয়ে রাখা হয়েছিল। সবকিছুতেই তাঁরা পিছিয়ে ছিলেন। লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার ছিলেন উপত্যকার এ নারীরা।
৩৭০ ধারা বলে পারিবারিক শাসন ব্যবস্থা আর সন্ত্রাসবাদীদের রক্তচক্ষুই থিল তাদের জীবনের একমাত্র ভবিষৎ। প্রতিবাদ করার সুযোগটুকুও ছিলো না তাঁদের সামনে। অনেকেই পণ্য হিসাবে বিবেচনা করতেন তাঁদের। কিন্তু গত বছর ৩৭০ ধারার রদের পর মহিলারা নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পেয়েছেন. একগুচ্ছ সরকারি প্রকল্পও ঘোষিত হয়েছে মহিলাদের ক্ষমতায়ণে। মহিলাদের জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন ও বৈষম্য দূরীকরণে ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আজ প্রশংসিত। তরুণ প্রজল্মের সামনে এসেছে নিজেদের ভবিষ্যত গড়ে তোলার হাতছানি। তাই জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখের মানুষরাই চাইছেন আত্মহননের পথ ছেড়ে আত্মনির্ভর উপত্যকা গড়ে তুলতে।
কাশ্মীরি মহিলাদের দুর্দশার কথা প্রকাশ করেছিল সংবাদ সংস্থা ওয়েসিস রিপোর্টিং এজেন্সি। ইওরোপিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান গিয়ান্না গ্যানসিয়াকে উদ্ধৃত করে তাঁরা লিঙ্গ বৈষ্যমের ছবি তুলে ধরে। গ্যানসিয়ার মতে, মহিলারা এমনিতেই সহনশীল। তাঁদের সহনশীলতার সুযোগ নিয়ে উপত্যকায় চলছিল যথেচ্ছ লিঙ্গ বৈষম্য। প্রতি পদে পদে বঞ্চনার শিকার ছিলেন মহিলারা। ব্যক্তি স্বাধীনতা লুন্ঠিত হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়।
গত এক বছরের নারীর ক্ষমতায় সরকারি প্রচেষ্টা এবং তাঁদের অধিকার রক্ষায় বিভিন্ন কর্মসূচি দ্রুত বদলাচ্ছে উপত্যকার পরিস্থতি। মহিলাদের স্ববলম্বী করে তোলার প্রয়াসে কাজ হচ্ছে। বাড়ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে মহিলাদের অধিকার। মহিলাদের উন্নয়নে ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় মহিলা কোষ বহুদিন ধরেই কাজ করে আসছে। তাঁদের অধীনেই কাশ্মীরের মহিলাদের উন্নয়নে গঠন করা হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর মহিলা উন্নয়ন কর্পোরেশন। এই কর্পোরেশন বা নিগম গঠনের আগে উদ্দেশ্য ছিল হিংসার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের ক্ষিতপূরণ। কিন্তু ২৭০ ধারা লোপ পাওয়ার পর এই সংস্থাটিই কাশ্মীরের মহিলাদের ক্ষমতায়ণ-সহ সকল সামাজিক প্রকল্পের নোডাল এজেন্সি।
মহিলা উন্নয়ন কর্পোরেশনের তরফে নারী শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। শিশুকাল থেকেই লিঙ্গ বৈষ্যমের যাতে শিকার হতে না হয় তাঁদের সেবিষয়টি নিশ্চিত করা হচ্ছে। আগে মেয়েদের পড়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিলোনা। তাঁরা বঞ্চিত ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক ভাতা থেকে। সংবিধান সংশোধনের পর দেশের অন্যান্য রাজ্যের মহিলাদের মতোই তাঁরাও পাচ্ছেন সমানাধিকার। তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে শহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে সরকার।
দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী মহিলাদের ৯.৫ শতাংশের বদলে এখন কাশ্মীরে ঋণ মিলছে ৮ শতাংশ হারে। থাকছে ভর্তুকিও। এই ঋণ নিয়ে তাঁরা যাতে কুঠির শিল্পের মাধ্যমে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলতে পারেন তার প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সব ব্যবস্থাই করে দিচ্ছে সরকার। কাশ্মীরে স্বয়ম সিদ্ধা মহিলা ক্ষমতায়ণ কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। মহিলা উন্নয়ন নিগমই এখ কর্মসূচির দেখভাল করছে। তাই গ্যানসিয়া লিখেছেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর নারীর ক্ষমতায়ণের মাধ্যমে উন্নততর কাশ্মীরের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছে।
সরকার উপত্যকা থেকে বৈষম্য দূর করতে চেয়েছে। আবার এখানকারা মানুষ চাইছেন সেই উন্নয়নের স্রোতে গা ভাসাতে। তাই কাশ্মীরকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজে তাঁরাও স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে আসছেন। কাশ্মীরি তরুণীরাও এগিয়ে আসছেন সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজ পরিবর্তনের কাজে। তাই যে আফসানা আশিক আগে মজা পেতো নিরাপত্তা রক্ষীদের পাথ ছুঁড়ে, সে এখন ব্যস্ত নতুন প্রতিভার সন্ধানে। তাঁর হাতেই তো রয়েছে কাশ্মীর ফুটবল দলের গোলরক্ষার দায়িত্ব। আশিক ক্যাপ্টেন বলে কথা। মুম্বইয়ে ফুটবলার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত নাম।
অন্যদেরকে সে এখন উতসাহ দিচ্ছে গঠনমূলক কাজে। লকডাউনে ঘরে বসে না থেকে নতুন আলোর দিশা খুঁজে পেলেন কাশ্মীরের ফ্যাশন ডিজাইনার মুফতি সাদিয়া। তাঁর সংস্থা 'হ্যাঙ্গারস দ্য ক্লোজেট' করোনা সংক্রমণ থেকে উপত্যকার মানুষদের চাহিদা মেটাতে তৈরি করছে হাজারো মাস্ক। কর্মসংস্থান হচ্ছে স্থানীয়দের। সরকার থেকে সহায়তা পেয়েছেন পুরোদমে। বললেন, ৩৭০ ধারা রদ না হলে সরকারি সুবিধাটুকু মিলতো না।
৩৭০ ধারা রদ কাশ্মীরি মহিলাদের বাঁধন খুলে দিয়েছে। তাই শিক্ষিত তরুণদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজনীতিতেও নামছেন তরুণীরা। সামাজিক দায়বদ্ধতা মাথায় রেকেই সমাজ পরিবর্তণের সেনানি হয়ে উঠছেন তাঁরা। ৩৭০ ধারা থেকে মুক্তির আনন্দে উন্মুক্ত বিহঙ্গের মতো তাঁরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সর্বক্ষেত্রে। তাই নার্সিং পাশ করা ২৪ বছরের তরুণী শরমিন খান বেছে নিয়েছেন রাজনীতিকে। রাজৌরি জেলার মাঞ্জাকোট গ্রামের শরমিন জঙ্গিদের চোখরাঙানির ভয় না পেয়ে রাজনীতিতে অবতীর্ণ। সরকার তাঁকে সবরকম সাহায্য করছে।
লেখক: কূটনৈতিক প্রতিবেদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়।