শরিফুল হাসান : কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের (৩৬) মৃত্যুর ঘটনাটি ভীষণ মর্মান্তিক। রাশেদকে এতো চেনা মনে হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল অনেকবার দেখেছি। আমার বয়সী একটা সম্ভাবনাময় মানুষকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। আমি সবগুলো গণমাধ্যম এবং ফেসবুকে নিহতের স্বজনদের বক্তব্য পড়ে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করেছি। এই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বিষয়গুলো তদন্ত করুক। তবে আমি তিনটা বিষয়ে কথা বলতে চাই।
প্রথমত, নিহত রাশেদ খানকে আমার কোনভাবেই কোন অপরাধী মনে হয়নি। বরং তার পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা বাবা এবং তাদের সততার গল্পগুলোই আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। কিন্তু ঘটনার পর রাশেদকে অপরাধী বানানোর জন্য পুলিশের যে চেষ্টা, ৫০ টি ইয়াবা পাওয়া গেছে, দুই বোতল; সেই পুরোনো গল্পগুলো ভীষণ হতাশাদায়ক। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় একই কাণ্ড ঘটে। বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীকে বলবো, যে কোন ঘটনার পর এই ধরনের মিথ্যাচার বন্ধ হোক।
শুধু পুলিশ নয় যে কোন বাহিনী বা যে কারও যদি ভুল হয়, বোঝামাত্রই ভুল স্বীকার করা উচিত। তাতে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু ভুল স্বীকারের সেই সংস্কৃতিটা আমাদের নেই। আমরা তাই একটা ভুল থেকে একশটা ভুলের জন্ম দেই। প্লিজ এগুলো বন্ধ করুন।
আমার দ্বিতীয় পয়েন্ট মূল ঘটনা নিয়ে। পুলিশ এমনভাবে কথা বলছিলো যেন তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছিল। কিন্তু এখানে একপাক্ষিকভাবে শুধু পুলিশই গুলি চালিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। মেজর সিনহা তার অস্ত্র চালাননি এটা পরিস্কার। তাহলে পুলিশ সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার না করে কেন গুলি চালালো? তিনি যেহেতু সামরিক পোষাকে ছিলেন সে কারণেও তো আগে তাকে গ্রেপ্তার করা উচিত ছিল। তা না করে সোজা বুক বরাবর গুলি চালান পুলিশের ইনচার্জ এসআই লিয়াকত হোসেন। তৎক্ষণাৎ তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তবে এরপরেও তিনি অনেকক্ষন জীবিত ছিলেন। কিন্তু তাকে যথাসময়ে চিকিৎসা দেয়া হয়নি।
অন্যদিকে পুলিশের এসআই, এসপি থেকে শুরু করে ডিআইজি পর্যন্ত সবার ভাষ্য, সেই অবসরপ্রাপ্ত মেজর পরিচয় দানকারী অস্ত্র বের করলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। মেজরের সঙ্গে থাকা লোকদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধাদানের অভিযোগে মামলা হয়েছে বলেও জানা যায়।
পুলিশের এই বক্তব্যে আমার তীব্র আপত্তি আছে। হ্যা বুঝলাম পুলিশের এসআই লিয়াকত হাসেন ভেবেছেন মেজর সাহেব ডাকাত কিংবা জঙ্গি। তর্কের খাতিরে এটাও ধরে নিলাম, ওই মেজর অস্ত্র বের করেছে। কিন্তু যেহেতু ওই মেজর গুলি চালায়নি কাজেই তাকে কী গ্রেপ্তার করা যেতো না। আর তিনি যেখানে বলেছেন, আপনারা আমাকে নিয়ে উত্তেজিত হবেন না। আপনারা আমাকে নিয়ে একটু খোঁজ নিন"। হাতে হাতকড়া পরিয়ে সেটা কেন করলো না পুলিশ?
আর একজন মানুষকে গুলি করে তৎক্ষনাৎ হাসপাতালে নেয়া হলো না কেন? নিহতের হাতে হাতকড়ার দাগ পাওয়া গেছে। তার মানে কী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় যখন তিনি বাঁচার জন্য ছটফট করছিলেন তখন কী তার হাতে হাতকড়া পরানো হয়েছে? আর কাউকে হত্যা করে ইয়াবা দিয়ে দিলেই হলো? ভয়াবহ এই প্রবণতা বন্ধ করা দরকার।
আমার তৃতীয় পয়েন্ট হলো ক্রসফায়ার নিয়ে। আমি চাই দেশে ক্রসফায়ার বন্ধ হোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির দেওয়া উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৮ সাল থেকে এই পর্যন্ত কক্সবাজার উপজেলায় ২১৮টি বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে টেকনাফ উপজেলায় ঘটেছে ১৪৪টি “ক্রসফায়ার” ও “বন্দুকযুদ্ধে”র ঘটনা, যেখানে মারা গেছেন ২০৪ জন মানুষ। আমার প্রশ্ন এভাবে আর কতো মানুষ হত্যা করা হবে? এগুলো করে কী মাদক বন্ধ হয়েছে?
আর্জেন্টিনার ঘটনা আমরা সবাই জানি। এতো মানুষকে হত্যা করা হলো যে মায়েরা একসময় অভিশাপ দেয়া শুরু করলো। এই যে এসএসএফে দায়িত্ব পালন করা একজন কর্মকর্তাকে হত্যা করে ফেলা হলো, নিশ্চয়ই আরও মানুষ হত্যা করা হয়েছে এগুলোর শেষ কোথায়? আজকে শুধু সাবেক একজন মেজর নয়, ওই গাড়িতে যে কেউ থাকতে পারতেন। এভাবে আর কতো মানুষকে হত্যা করা হবে? মনে রাখবেন একজন মানুষের জীবনে চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। গোটা পৃথিবীর বিনিময়েও একটা মানুষের জীবন পাওয়া যাবে না। কাজেই আমাদের কারও ভুলে যেন কোন জীবন না চলে যায়।
আরেকটা কথা বলি, এই যে হত্যা, নানা বাহিনী বা প্রশাসনের ক্ষমতা দেখানো আর জবাবদিহিতার বাইরে থাকার সংস্কৃতি এগুলো বন্ধ করা হোক। কী সামরিক কী বেসরমারিক কেউ যেন না ভাবে তারা জবাবদিহিতার বাইরে। তাহলে কিন্তু এমন খুন আর ক্ষমতার বাহাদুরি চলতেই থাকবে। তাতে দিনশেষে দেশেরই ক্ষতি।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহতের ঘটনায় সরকরা তিন সদস্যের একটা তদন্ত কমিটি করেছে। কমিটি নিশ্চয়ই ঘটনাগুলো অনুসন্ধান করবে। আমার শুধু তাদের কাছে চাওয়া দেশের কোথাও যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের না ঘটে সে ব্যাপারে যেন তারা সুষ্পষ্ট প্রতিবেদন দেন।
বাংলাদেশ পুলিশকে বলবো, করোনাকালে যে দারুণ ভাবমুর্তি আপনাদের গড়ে উঠেছে প্লিজ সেটা ধরে রাখুন। মনে রাখবেন দুটো পাঁচটা ঘটনাই পুরো অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের যে জন্ম সেই পুলিশ বাহিনীকে আমরা সবসময় মানবিক দেখতে চাই।
আরেকটা কথা এই দেশের সব বাহিনীর সবার মনে রাখা উচিত,মানুষ হত্যা, ক্ষমতার বাহাদুরি, এগুলো দিয়ে পৃথিবীর কোন দেশ আগাতে পারে না। আর একটা দেশের সব বাহিনীকে যদি মানবিকতার শিক্ষা দিয়ে সেটার চর্চা না করানো যায় এবং সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা না করা যায় তাহলে কিন্তু সবকিছুর পতন হতে বাধ্য।
মনে রাখবেন, এই দেশের পুলিশ, প্রশাসন, সামরিক বাহিনী সব আমাদের। এই দেশের মানুষও আমাদের। সবাইকে নিয়েই একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়তে হবে। কারণ দেশটা আমাদের। আশা করছি আমাদের নীতি নির্ধারকরা ভাববেন। আমার শুধু একটাই কামনা ভালো থাকুক বাংলাদেশ। ভালো থাকুক দেশের প্রতিটা মানুষ।