ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী: আগের লেখায় বলেছিলাম যেকোন একটা ভ্যাক্সিন শূন্য থেকে তৈরি করতে কতসব জটিল ধাপ পেরুতে হয়। যা শেষ করতে সাধারনত দশ থেকে পনের বছর সময় লাগে। তো করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সেই পনের বছরের জিনিস ১২ মাসে তৈরি করতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়ায় যে পরিমান শর্টকাট নিতে হচ্ছে, তার ফল আসলে কী হবে, তা বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে। আজকের লেখায় ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়ে গিয়েছে কল্পনা করে, এর পরের ধাপে আরও কত ‘তবে’ ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’ বিছিয়ে আছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
করোনা থেকে ভ্যাক্সিন দিয়েই যদি সুরক্ষা পেতে হয়, তাহলে সারা বিশ্বে মানুষ আছি আমরা প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন। তো ভ্যাক্সিন কয়জনকে দিতে হবে? তার আগে বলেন কাকে বাদ দেয়া যাবে? শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ কি আদৌ করোনা থেকে নিরাপদ?
এবার আসা যাক একেকজনের কতবার করে ভ্যাক্সিন নিতে হবে। ক্যান্ডিডেট ভ্যাক্সিনগুলোর ফেজ-৩ ট্রায়াল শেষ না হলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু বলা যাবে না। কিন্তু সম্প্রতি নেচার মেডিসিন জার্নালের গবেষণা থেকে ধারনা করা যায়, কার্যকরী এন্টিবডির পরিমান নিশ্চিত করতে হলে বছরে একাধিকবারও নিতে হতে পারে এই ভ্যাক্সিন। দুইবার করে হলে বছরে দরকার হবে পনের বিলিয়ন ডোজ ভ্যাক্সিন। এবার চলুন যাই ভ্যাক্সিন তৈরির প্ল্যান্ট-এ।
আগেই বলেছি, ভ্যাক্সিন তৈরির প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট জটিল। বেশি জটিল না করে শুধু এটুকু বলা যায়, সব ভ্যাক্সিন একই উপায়ে তৈরি হয় না। এখন যেকটা ভ্যাক্সিনের ট্রায়াল হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত এদের মধ্যে কোনটা কাজ করবে সেটাতো এখনি বলে ফেলা যাচ্ছেনা। তাই আগেভাগেই ১০০% প্রস্তুতি নিয়ে রাখা এখনই সম্ভব না। তবে এ বিষয়টিকে সহজ করার জন্য WHO, Gavi, Vaccine Alliance, আর CEPI'র মত বিশ্বের সব নিয়ন্ত্রক সংস্থা এখন ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। তাদের প্রস্তুতির সারমর্ম হলো, যে ভ্যাক্সিনই অনুমোদন পাক, ২০২১ সালের শেষে নাগাদ বছরে দুই বিলিয়ন ভ্যাক্সিন তৈরি করা সম্ভব হতে পারে (তাদের ইচ্ছা আরও বেশি, কিন্তু এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী এমনটা শোনা যায়নি)। এমনকি দুই বিলিয়ন ডোজ তৈরি করতেও পুরো পৃথিবীব্যাপী ভ্যাক্সিন উৎপাদক কোম্পানীগুলোকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে। আর ২০২১ সাল জুড়ে যতগুলো ভ্যাক্সিন তৈরির পরিকল্পনা, তা মূলত ইউরোপীয় দেশগুলোর নিজেদের চাহিদ মেটানোর জন্য লাগবে। এ পরিকল্পনা যদি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়-ও, বিষয়টা কী দাঁড়াল?
প্রথমত, ২০২২-এর আগে পশ্চিমাবিশ্বের তৈরি ভ্যাক্সিন ব্যাপক ভিত্তিতে আমাদের হাতের নাগালে আসার সম্ভাবনা কম (আর যদি অল্প-বিস্তর আসেও সেটা সাধারণ জনগন চোখে দেখার সম্ভাবনা নাই বললে মিথ্যা বলা হবেনা)। তাহলে আমরা ২০২২ এর আগ পর্যন্ত কী হবে আমাদের? আর ২০২২-এই যে আমরা পেয়ে যাব, সেই নিশ্চয়তা কি দিয়েছে আমাদেরকে কেউ? না যদি দিয়ে থাকে তাহলে এখনই সরকারের পক্ষ থেকে WHO, Gavi, Vaccine Alliance, আর CEPI'র সাথে যোগাজোগ আর দেন-দরবার শুরু করতে হবে এখনি। কিন্তু এরকম কিছু হয়েছে, বা তাদের তরফে কোন আশ্বাস পাওয়া গিয়েছে, সেকথা শোনা যায়নি এখনো।
দ্বিতীয়ত, সাড়ে সাত বিলিয়ন মানুষকে বছরে দুই বিলিয়ন ভ্যাক্সিন দিয়ে কীভাবে সুরক্ষিত করা হবে সেটা এখনো পরিষ্কার না (যেখানে প্রতি বছর এই ভ্যাক্সিন দুইবার করে নিতে হতে পারে)। এক্ষেত্রে সবার প্রথমেই আসবে, যাদের বয়স ৬৫ বছরের উপরে, যাদের কো-মরবিডিটি আছে, আর যারা ফ্রন্টলাইনার তাদেরকে আগে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু এটা করতে গেলে মারাত্মক গোল বাধার সম্ভাবনা আছে। কারা ফ্রন্টলাইনার, সেটা নির্ধারন করতে গিয়ে বাঁধবে ঝামেলা। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে পুলিশ বা ব্যাংকারদের মত অন্য ফ্রন্টলাইনারদেরকে বঞ্চিত করতে গেলে মনোমালিন্য তৈরি হওয়া স্বাভাবিক হবে। যাই হোক, ধরে নিলাম সমস্ত ফ্রন্টলাইনাররা শেষ পর্যন্ত ভ্যাক্সিন পেলেন। কিন্তু বাকীদের কি হবে?
এখনো পর্যন্ত গবেষণা বা গনমাধ্যমে প্রকাশিত যেসব তথ্য আছে, তাতে অল্প-বয়স্ক যুবক, তরুণ, বা শিশুরা খুব নিরাপদ এই কথা বলার সুজোগ আছে কি? আচ্ছা, শিশুরা বা তরুণেরা যদি এতই নিরাপদ হবে, তাহলে সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এখনো বন্ধ কেন? আর সবার জন্য লকডাউন বা সামাজিক দূরত্বের নিয়মই বা কেন? এখন সামাজিক দূরত্ব উঠিয়ে দেয়া যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে সবার জন্য ভ্যাক্সিন লাগবেনা একথা কি কেউ বলতে পারবে? না। তাহলে ২০২২ পর্যন্ত আমরা কিসের আশায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি অফিস আদালত বন্ধ করে বসে থাকব? এমনকি ২০২২-এ গিয়েও যদি দুই বিলিয়ন ভ্যাক্সিন দিয়ে সাত বিলিয়নের উপরে মানুষকে ঠিক কীভাবে সুরক্ষা দেয়া হবে, তার কোন সঠিক উত্তর কি কারো কাছে আছে? এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনা এখনি জনগণের সামনে স্পষ্ট করার সময় এসেছে। আরও আছে।
যতগুলো ভ্যাক্সিনই আসুক, যবেই আসুক, এর খরচ কে বহন করবে? সরকার নাকি জনগণ? আমাদের দেশে সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে আর্থিক দুর্দশায় পড়ছেন, পুরো পরিবারের জন্য ভ্যাক্সিনের খরচ বহন করার সামর্থ কজনের থাকবে? মানুষ ভাত খাবে না ভ্যাক্সিন নিবে? আর সরকার যদি কোন ভর্তুকী দেয়, এবারের বাজেটে কি তার জন্য কোন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেরকম কিছু শোনা যায়নি এখন পর্যন্ত। এখানেই শেষ না।
এত আশা ভরসার ভ্যাক্সিন যে আদৌ কাজ করবে, তার নিশ্চয়তা কতখানি? স্বয়ং ডাঃ এন্থনি ফাউচি, যিনি আমেরিকার করোনা নিয়ন্ত্রণ টিমের লিডার এবং আমেরিকার মডার্না ভ্যাক্সিনের গবেষণা প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি জড়িত, তার ধারনা অনুসারে এই ভাক্সিনের কার্যকারীতা ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ হতে পারে মাত্র। তাহলে এই যদি হয় অবস্থা, এই ভ্যাক্সিন নিয়েও কি খুব নিশ্চিন্ত থাকা যাবে?
তাহলে মোটের উপর দাঁড়াল কী? ভ্যাক্সিন সহসাই আসবে না, আসলেও সহসাই সবাই পাবে না, যারাও পাবে তারাও যে নিশ্চিত সুরক্ষা পাবে সেটাউ না! তাহলে উপায়? এর উত্তর আসলে আমাদের বিজ্ঞ পলিসিমেকার যারা আছেন, তাদেরকেই পরিষ্কার করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে করোনা মোকাবেলার পরিকল্পনা কী, সেটা অনতিবিলম্বে দেশবাসীর সামনে পরিষ্কার করা দরকার।
সবশেষে, আমরা ছোটবেলা থেকেই ‘ডাক্তার আসিবার পুর্বেই রোগীটি মারা গেলো’ শিখে বড় হওয়া জাতি! আমাদের আর হারাবার কী আছে? আর দিল্লী যে বহু দূর, সেটাও আমরা জানি! তাই এ বিষয়ে দায়িত্বশীলেরা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে অযথা জল ঘোলা না করে, সবকিছু পরিষ্কার করবেন সেই আশা করি। সবাই অনেক ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ।
লেখক,
ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী
অণুজীববিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য গবেষক
কো-অর্ডিনেটর, মাইক্রোবায়োলজি প্রোগ্রাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ।
আপনার মতামত লিখুন :