শিরোনাম
◈ আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় ভারতীয় পণ্য: গয়েশ্বর ◈ সন্ত্রাসীদের ওপর ভর করে দেশ চালাচ্ছে সরকার: রিজভী ◈ ইফতার পার্টিতে আওয়ামী লীগের চরিত্রহনন করছে বিএনপি: কাদের ◈ বাংলাদেশে কারাবন্দী পোশাক শ্রমিকদের মুক্তির আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন লবি’র ◈ দক্ষিণ আফ্রিকায় সেতু থেকে তীর্থ যাত্রীবাহী বাস খাদে, নিহত ৪৫ ◈ ২২ এপ্রিল ঢাকায় আসছেন কাতারের আমির, ১০ চুক্তির সম্ভাবনা ◈ ইর্ন্টান চিকিৎসকদের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলেছি: স্বাস্থ্যমন্ত্রী ◈ উন্নয়ন সহযোগীদের একক প্ল্যাটফর্মে আসা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী ◈ ড. ইউনূসের পুরস্কার নিয়ে ভুলভ্রান্তি হতে পারে: আইনজীবী  ◈ ত্রিশালে বাসের ধাক্কায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ অটোরিকশার ৩ যাত্রী নিহত

প্রকাশিত : ২৭ জুন, ২০২০, ০৭:৪৭ সকাল
আপডেট : ২৭ জুন, ২০২০, ০৭:৪৭ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মশিউল আলম : কমিউনিস্টের মন

মশিউল আলম : গর্বাচভকে নিয়ে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করেছিলাম। বাংলায় চিন্তা করে কাঁচা, আনাড়ি রুশিতে দুই পাতা লেখার পর পড়তে দিয়েছিলাম এক রুশ বন্ধুকে। সে পড়ে আমাকে বলেছিল, ‘তোমার লেখায় সোভিয়েত ব্যবস্থার জন্য যত বেশি আবেগ প্রকাশ পাবে, ততই স্টুপিড মনে হবে তোমাকে। লেখা উচিত এমনভাবে যেন তা পড়ে পাঠকদের মনে হয় তুমি আরেকটু কম স্টুপিড।’

তারপর আমি আর গর্বাচভকে নিয়ে গল্প লেখার চেষ্টা করিনি। শুধু গর্বাচভকে নিয়ে কেন, কোনো গল্পই আর লিখিনি। লেখার কথা ভাবলেই মনে হতো, লোকে আমার লেখা পড়ে বলবে আমি একটা স্টুপিড।

ভিক্তর আমাকে আরও বলেছিল, ‘তোমার লেখায় তো উইট-হিউমার কিচ্ছু নাই।’

ওকে বলেছিলাম আমি একজন সিরিয়াস মানুষ।

ভিক্তর হেসে বলেছিল, ‘সিরিয়াসনেস একটা হাস্যকর ব্যাপার। সোভিয়েত ইউনিয়নের পার্টি-লিডাররা সব সিরিয়াস লোক, তাদের নিয়ে জনগণ কীরকম হাসাহাসি করে তুমি দেখনি? যদি শুধু খেয়াল করে শোন লোকজন কী ধরনের চুটকি বলছে, প্রতিদিন কী কী নতুন চুটকি তৈরি হচ্ছে, তাহলেই দেখতে পাবে সোভিয়েত জনগণ সারাক্ষণ কী হাসাই না হেসে চলেছে। আসলে, এটা একটা হাস্যকর ব্যবস্থা, মস্ত এক কেরিক্যাচার।’

গর্বাচভের পিরিস্ত্রোইকাও কি একটা কেরিক্যাচার? আমি ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ভিক্তর আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেছিল, ‘গর্বাচভও একজন পারতিন্নি চেলাভিয়েক — আ পার্টি ম্যান। তারও আদর্শ সেই লেনিন, সেই রিডিকুলাস এক্সপেরিমেন্টালিস্ট, যে গড়তে চেয়েছিল একটা ইশ্বরহীন সমাজ। কিন্তু লেনিন জানত না, ঈশ্বর যদি নাও থেকে থাকে, তবু রুশরা একজন ঈশ্বর তৈরি করে নেবে, কারণ ঈশ্বর ছাড়া রুশদের একদমই চলে না।’

আমি বলেছিলাম, ‘কিন্তু গর্বাচভ তো সেটা বুঝতে পেরেছে। তার গ্লাসনস্ত কর্মসূচির দুই নম্বর এজেন্ডাই হলো ধর্মপালনের স্বাধীনতা। তাহলে লেনিন কী করে গর্বাচভের আদর্শ হতে পারে?’

ভিক্তরের উত্তর ছিল, ‘এটাই তো গর্বাচভের ভন্ডামি। সে নিজেকে একজন কমিউনিস্ট বলে দাবি করে, প্রকাশ্যেই বলে বেড়ায় যে সে কমিউনিস্ট হিসেবে গর্ববোধ করে। কিন্তু আবার একই সঙ্গে বলে ব্যক্তির বিকাশের কথা। স্টুপিডটা জানে না যে কমিউনিজম শব্দটার মধ্যে ব্যক্তির কোনো জায়গাই নাই, আছে কেবলই সমষ্টি, কমিউন...।’

ভিক্তর ছিল কমসোমলের নেতা। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত-মার্কিন ছাত্র বিনিময় শুরু হলে চলে গছে আমেরিকা। আর ফিরে আসেনি।

এক আমেরিকান সাংবাদিক এসেছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মত বিনিময় করা ছিল তার ঘোষিত উদ্দেশ্য। আমাদের শিক্ষিকা নাতালিয়া বাজানোভা তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে: ‘আমেরিকান জার্নালিস্ট, কিন্তু এটা জন রিড নয়, এটা মাইকেল স্লোন্নিক!’

স্লোন্নিক আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিল, আমরা গ্লাসনস্ত সমর্থন করি কি না। ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে বুঝতে পারছিল, সে আমাদের মুখে কী উত্তর শুনতে চায়। অধিকাংশ ছেলেমেয়েই গ্লাসনস্তের পক্ষে কথা বলছিল, গর্বাচভের প্রশংসা করছিল। কিন্তু কঙ্গোর ছেলে কেইতা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বলতে পারেন মিস্টার স্লোন্নিক, পাত্রিস লুমুম্বাকে কেন খুন করা হয়েছিল?’ কেইতা ছিল আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ভোলাভালা ছেলে। ওর মুখে ওই প্রশ্ন শুনে ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে অবাক হয়ে মুখ চাওয়া-চাউয়ি করেছিল।
আমেরিকান সাংবাদিক বলেছিল, পাত্রিস লুমুম্বাকে হত্যা করেছিল আসলে তাঁরই স্বদেশের মানুষেরা। তখন কেইতা ঠোঁট শক্ত করে বলেছিল: ‘উই আর নট স্টুপিড, ইউ নো, মিস্টার স্লোন্নিক?’

বলিভিয়ার ছেলে ভিলসের স্লোন্নিককে বলেছিল, ‘তোমরা কেন চে গেভারাকে খুন করেছিলে?’
কেইতা আর ভিলসের ছিল আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে গবেট দুই ছেলে।

পিরিস্ত্রোইকা শেষ হয়েছে। পৃথিবীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে কোনো দেশের অস্তিত্ব আজ আর নাই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে পাত্রিস লুমুম্বার নাম ছেঁটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। যারা তাঁকে মেরেছিল, তারা আজ ক্রেমলিনের নেতাদের বন্ধু।
আমার এক নানার চেহারা ছিল পাত্রিস লুমুম্বার মতো। নানা কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরতেন, ঠিক পাত্রিস লুমুম্বার মতোই তাঁরও থুতনিতে ছিল এক রত্তি দাড়ি।
বাবা আমাকে বলেছিলেন, ‘ওরা যে বছর প্যাট্রিস লুমুম্বাকে খুন করে, তখন তুমি নেগেটিভ ফাইভ ইয়ার্স সিক্স মান্থস্। আর যখন চেকে মারে, তখন প্লাস ফিফটিন মান্থস।’

আমি বাবাকে বলেছিলাম, ‘আপনি প্যাট্রিস লুমুম্বা আর চে গুয়েভারার ভক্ত হয়ে আমার নাম কেন রেখেছেন হাবিবুর রহমান? হাবিব একটা নাম হলো?’
বাবা হেসেছিলেন। বাবা উনিশ শ ষাটের দশকে কমিউনিস্ট হওয়ার আগে নাস্তিক ছিলেন, কমিউনিস্ট হওয়ার পরে হয়েছিলেন ধার্মিক।

একটু দাঁড়ান। ধার্মিক কথাটা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার।

আমার এক দূর সম্পর্কের দাদু ব্রিটিশদের আন্দামানে কয়েদ খেটেছিলেন। তার আগে তিনি হয়েছিলেন অনুশীলন সমিতির সদস্য। সদস্য হওয়ার জন্য তিনি গেছেন সেই গুপ্ত বিপ্লবী সংঘের নেতাদের কাছে। প্রবল উৎসাহের সঙ্গে বললেন, তিনি সদস্য হতে চান।
ভালো কথা। কিন্তু পরীক্ষা দিতে হবে।

কী পরীক্ষা?

সান্তাহার থেকে রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে পাবর্তীপুর। ফ্রম সান্তাহার জাংশন টু পাবর্তীপুর জাংশন রেললাইনে কতগুলো স্লিপার আছে তা একটা একটা করে গুনে এসে বলতে হবে। বানিয়ে একটা সংখ্যা বলে দিলেই চলবে না, কারণ স্লিপারের সংখ্যা পরীক্ষক নেতাদের জানা আছে।

সেই কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে আমার সেই দাদু অনুশীলন সমিতির সদস্য হয়েছিলেন।

আমার বাবা কমিউনিস্ট হওয়ার পর ধার্মিক হয়েছিলেন ––এই কথার মানে এটা না যে তিনি নামাজ-পড়া বা রোজা-রাখা শুরু করেছিলেন। কথাটার মানে হলো, পার্টির নেতারা যা বলতেন, কেন্দ্রীয় কমিটিতে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, তিনি সব বিনাবাক্যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। সাপ্তাহিক একতা, মাসিক সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত নারী, উদয়ন, সোভিয়েত লিটারেচার, স্পুৎনিক ইত্যাদি পত্রিকা, প্রগতি ও রাদুগা প্রকাশনীর সমস্ত বইপত্রে যা-কিছু লেখা হতো তিনি সবই বিশ্বাস করতেন সেইভাবে, যেভাবে মুমিন মুসলমানেরা বিশ্বাস করে কোরান-হাদিসের সব কথা ।

আমি সেই বাবা আর ওই রকম এক দাদুর বংশধর। কী রকম হতে পারি আমি?

তাহলে আরও বলি।

সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ওরফে সিপিবির একটা গোপন শাখা ছিল। কেন গোপন, আমি জানি না। বাংলাদেশে পূঁজিবাদ, সামরিক স্বৈরতন্ত্র, অথচ সেখানেই সিপিবি গোপন কোনো পার্টি নয়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নে আনুষ্ঠানিক সমাজতন্ত্র, এখানে কেন একটা কমিউনিস্ট পার্টিকে গোপনে কাজ করতে হবে—এই প্রশ্নের সদুত্তর কেউ আমাকে দেয়নি।

যা হোক, সেই সিপিবির সোভিয়েত ইউনিয়ন শাখার এক নেতা ছিল। অজর অমর অক্ষয় নেতা: সেই ১৯৭২ সালে সোভিয়েত সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়তে এসেছে মস্কো শহরে, ১৯৯০ সালেও শুনি, তার পড়া শেষ হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের বাঙালি মহলে তাকে নিয়ে কেচ্ছাকাহিনির শেষ নাই। ১৯৮৮ সালে তার অসুস্থ মাকে দেখার জন্য দেশে যাওয়ার সময় তাকে আমরা আয়েরোফ্লতের টিকেট কিনে দিয়েছিলাম চাঁদা তুলে। আর ১৯৯১ সালে সে মালিক হয়েছে একটা দাচার, কমপক্ষে তিনটা বিএমডব্লিউ গাড়ির, এবং আরও যে কত কিছুর, আমরা জানতে পারিনি। শুধু জেনেছি, তার টাকা-পয়সার শেষ নাই, এবং এখন টাকাই তার ঈশ্বর।

...তো, সে ছিল আমাদের নেতা, কার্ল মাকর্সের মতো দাড়িগোঁফ লালনপালন করত। আমরা তার সামনে ভক্তিতে গলে গলে শেষ হয়ে যেতাম। আপনারা যারা বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন করেননি, তারা বুঝবেন না, ‘ক্যাডারভিত্তিক’ এইসব দলে নেতা ও কর্মীদের মধ্যেকার সম্পর্ক ঠিক কিসের মতো। আমি অনেক ভেবেচিন্তে দেখেছি, সম্পর্কটা ঠিক পীর ও মুরিদের মতো।

মনে করুন ভয়ঙ্কর শীতকাল, ধরুন ডিসেম্বরের পনের তারিখ রাত বারোটা, তাপমাত্রা নেমে গেছে শূন্যের পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে, আমার সেই নেতা আমাকে বলল, ‘হাবিব, যাও, রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো সারা রাত,’ আমি সত্যিই গিয়ে দাঁড়াতাম রাস্তায়, খোলা আকাশের নিচে। তুষার ঝরছে, না তুষারঝড় বইছে কিছুই ভ্রুক্ষেপ করতাম না। কনকনে শীতে বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতাম ভোর পর্যন্ত। একবারও জানতে চাইতাম না কেন, কী যুক্তিতে সেটা করতে হবে; করলে কীভাবে পার্টি উপকৃত হবে। এটা আমার কোনো অজানা অপরাধের শাস্তি কি না, বা গোপন কোনো কৃতিত্বের পুরস্কার কি না —এসবের কিছুই জিজ্ঞাসা না করে বিনাবাক্যব্যয়ে আমি গিয়ে দাঁড়াতাম রাস্তায়, খোলা আকাশের নিচে। ভয়ঙ্কর ঠান্ডায় দাঁতকপাটি লেগে বরফের উপর ধপ করে পড়ে মরে থাকতে পারি — এরকম চিন্তা মনে এলে আনন্দ পেতাম এই ভেবে যে পার্টির জন্য শহিদ হয়ে যাচ্ছি।

আপনারা তাহলে বুঝতেই পারছেন, ধার্মিক বলতে আমি কী বুঝি এবং বোঝাতে চাই।
এবং আমার ধারণা, প্রাচ্যের কমিউনিস্টদের মন আসলে ধার্মিকের মন।

কিন্তু আপনারা নিশ্চয়ই এও বুঝতে পারছেন, আমি এখন আর ওই রকমের ধার্মিক নই। আমার বাবাও অন্ধবিশ্বাসের আরামদায়ক গুহা থেকে সম্ভবত বেরিয়ে পড়েছেন। গত শীতে তিনি আমাকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন: বেশি ইমোশন ক্ষতিকর। চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। চিন্তা করতে হবে। ‘ইউ নিড টু কিপ ইয়োর রিজন সাউন্ড।’

সাউন্ড রিজন! ফুহ্! ভারসাম্যপূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কের কথা ভাবতে ভাবতে চলে এলাম পাগলাগারদে!

হাসবেন না, প্লিজ! এটা মস্কোর ১৪ নং হাসপাতাল। এই হাসপাতাল সারা সোভিয়েত ইউনিয়নে বিখ্যাত। ভদ্রলোকেরা বলে মানসিক হাসপাতাল, কিন্তু সোজা কথায় এটা একটা বদ্ধ পাগলাগারদ। আমার বন্ধুরা আমাকে ধরে–বেঁধে এখানে রেখে গেছে।#

আমার প্রকাশিতব্য উপন্যাস “লাল আকাশ” থেকে।

ফেসবুক থেকে নেয়া

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়