মহি মুহাম্মদ: ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি।
শহরে বসে থাকা মানে খাবারদাবারে কষ্ট পাওয়া। আর পকেটের দিকে তাকিয়ে থাকা।
দু একটা টিউশনি করি। তবে টাকার পরিমাণ খুব কম। ১৯৯২ সাল। চিঠির যুগ।
বাবা পত্র পাঠিয়েছেন, শহরে বসে না থেকে বাসায় ফিরে যেতে।
বাবা চা-বাগানে চাকরি করেন। মা আছেন। ছোটো ভাইবোন আছে। শহর থেকে একদিন বেলা দশটার দিকে রওয়ানা হলাম, মা-বাবার কাছে যাবো বলে। বাসে এসে নামলাম নতুনবাজার। কৈয়াছড়া চা-বাগানের ভিতর দিয়ে ৪/৫ মাইল হাঁটলে বাসায় পৌঁছব।
দুপুরের রোদ বেশ কড়া। কিছু দূর এগিয়ে যেতেই দেখলাম ৪০/৫০ জন লােক মিছিল করে এগিয়ে আসছে।
ওদের কাঁধে একটা খাঁটিয়া। আমার বুকের ভিতর মুচড়ে উঠল।
কে মারা গেল?
লোকগুলোকে আমি চিনতে পারছি। চা বাগানের সমর দাশ, মানিক সিকদার, নায়েব আলি, শহীদুল বাবু। সবাই বাবার সহকর্মী। চা-শ্রমিকদের অনেকেই আছে।
আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল। কোনোরকম নিজেকে টেনে নিয়ে চললাম। কাছে যেতেই সবাই আমাকে দেখে চমকে উঠলো। এ যেন দৈব যোগাযোগ!
সমরদা এগিয়ে এসে বলল, মহি কান্নাকাটি কইরো না। খাঁটিয়ায় তোমার আব্বা আছেন। কিছুক্ষণ আগে ট্রাক অ্যাকসিডেন্ট করেছেন।
আমি খাঁটিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। বাবা, 'মা, মা,' বলে কাতরাচ্ছেন। আমাকে দেখে খুব অসহায়ভাবে বাবা চোখের জল ফেললেন। আমিও কেঁদে ফেললাম। খালি চিৎকারটা গলার ভেতর আটকে থাকল। আর একটা কষ্টের বল বুকের ভেতর অসহায়ভাবে লাফালাফি করছে। কিছুতেই বেরুতে পারছে না।
কেউ কিছু বলছে না। সবার মুখ থমথম করছে। আমার হাত-পা শক্তিহীন! বাড়িতে মা আর অন্যরা কি করছে, কে জানে! নতুনবাজার থেকেই একটা অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেল। সবাই বাবাকে খাঁটিয়া থেকে গাড়িতে তুলে দিল।
বাবার পা রক্তাক্ত। রক্ত থামছে না। বাবার ডান পা কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। গাড়িতে তোলার চেষ্টা করতেই ব্যথায় বাবা চিৎকার করে উঠল। কোমরের নিচে ডান পায়ের ওপর দিয়ে গেছে পাতি বোঝাই ট্রাকের চাকা। এখনও বেঁচে আছে বাবা, এটাই নাকি ভাগ্যি!
অ্যাম্বুলেন্স শেষ বিকেলে চট্টগ্রাম হাসপাতালে এসে পৌঁছলাে। ছুটোছুটি করতে করতে বাবার জায়গা হলো, ১৩ নং ওয়ার্ডের ১২ নং বেডে। বিভাগের নাম অর্থোপ্যাডিক। অবশ্য প্রথমে বেড মিলেনি। অনেক পরে বেড মিলেছে। বাবার চিৎকার দেখে কত যে চোখের জল ফেললাম কিন্তু কষ্ট কমলো না।
বাবার পায়ে ব্যান্ডেজ পড়লো আর পা-টা ঝুলিয়ে দিল উপরে। আরো কদিন পরে পায়ের পাতার আশেপাশে রড ঢুকিয়ে কিসব টানা দিল। অদ্ভুত কষ্ট। ব্যথায় বাবা ঘুমুতে পারেন না। আমি শুয়ে থাকি বাবার বেডের পাশে, ঠান্ডা ফ্লােরে। কি যে কষ্ট, কাউকে কিছু বলি না। বাবা সুস্থ হয়ে যাক, এটাই শুধু কামনা করি। রাত বারোটার দিকে ঘুমুতে যাই, কারণ বাবার অষুধ আছে। তাছাড়া বিছানায় সময় সময় প্যান এনে বাহ্যকর্ম সম্পাদন করতে হয়। আর হাসপাতালে যে কত লোকের আনাগোনা আছে, তা বোঝানো যাবে না।
বাবার প্রতি পদে পদে বিপদ। জন্মের পর সাত বছর বয়সেই পিতাকে হারিয়েছেন। আবার ছোটো বয়সেই চা-বাগানের চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে। আমার জন্মের আগে বাবা আরেকবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছিলেন। সে ঘটনাটা এখানে না বললই নয়!
স্থানীয়দের সঙ্গে চা বাগানের মালিকের বিরোধ ছিল, জায়গা দখল নিয়ে। বাবা একদিন কাজ করছিলেন শ্রমিকদের নিয়ে। আর স্থানীয়রা ওই সময় আক্রমণ করেছিল। শ্রমিকরা যেদিক পারল, ছুটে পালাল।
বাবাকে ওরা মেরে ফেলার জন্য তাড়িয়ে নিয়ে জঙ্গলে ঢােকাল। হাতে বল্লম, লাঠি, কিরিচ। জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে ওরা চারদিক দাঁড়িয়ে ছিল। বাবা বের হলেই ওরা মেরে ফেলবে। বাবা বের হয়ে ছিলেন। জঙ্গলের ভেতরে নাশিতে ক্রল করে বাইরে বেরিয়ে আসেন। তারপর নারী চা-শ্রমিকের শাড়ি পরে ওদের চোখে ধূলো দিয়েছিলেন। সেদিনও চা-বাগানে বাবার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছিল।
হাসপাতালে সেদিন বসে আমার অনেক কথাই মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল, ক্লাস নাইনে বাবা আমার বই কেনার জন্য ক্যাশিয়ারের কাছে টাকা ধার চেয়েছিলেন। বাবাকে ক্যাশিয়ার টাকা ধার দেয়নি। এই খবর শুনে একজন নারী চা-শ্রমিক আমার বই কেনার টাকা ধার দিয়েছিলেন। সেই চা শ্রমিকের নামটি এখনও আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি-তারামণি।
তাঁরামনি বেঁচে নেই। না হয় তাকে সাহায্য সহযোগিতা করতে মন টানছিল।
বাবাকে ঘিরে আরো অনেক কথাই আমার মনে পড়ে। কারণ বাবাই আমার স্বপ্নের নায়ক।
রাতে বাবার শিয়রে বসে বসে আমি কবিতা, গান এসব রচনা করতাম। বাবা মাঝে মধ্যে প্রশ্ন করতেন, কিরে এতো কি লিখিস?
আমি বলতাম, কিছু না আব্বা।
দিনের বেলা লেখাগুলো বাবার বেডের নিচে লুকিয়ে রাখতাম। একদিন এক ডাক্তার আবিষ্কার করল আমার কবিতা ও গান। বাবাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, এসব কে লিখেছে? বাবা বলছিলেন, আমার ছেলে।
দীর্ঘ এক মাস পনেরাে দিন পর আমরা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলাম। বাবা ক্রাচ দিয়ে হাঁটতেন। হাঁটার সময় বাবার খুব কষ্ট হতো। চোখ মুখ কুঁচকে থাকতো ব্যথায়। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে বাবার কষ্ট অনুভব করতাম।
তবে আরো কিছুদিন পর । শহর থেকে আমার কয়েকজন বন্ধু চা-বাগানে বেড়াতে এসেছিল। বন্ধুদের নিয়ে চা-বাগান ঘুরে আসছিলাম আমি। এমন সময় এক বন্ধু বলে উঠলো, দ্যাখ দ্যাখ লোকটি মনে হয় ক্র্যাচ পিছলে পড়ে গেছে!
আমি এ কথা শুনে দৌড়ে এগিয়ে গেলাম। বন্ধুরাও আমার পিছু পিছু এলো। আমি বাবাকে ধরে তুললাম। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করলো, কিরে মহি, উনি কে?
আমি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিলাম না। শুধু অস্ফুট স্বরে বললাম, উনিই আমার বাবা।
বাবা আমাদের মধ্য আরো দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। নানা ঝড় ঝাপটায় বাবা আগলে ছিলেন আমাদের। তবে গত পাঁচ/ ছয় মাস যাবৎ বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলেন। পেটের একপাশে খুব ব্যথা ছিল। কিছুই খেতে পারতেন না। এমনিতেই বাবা স্বল্প আহারি ছিলেন। এনিয়ারিজম ধরা পড়ার পর খাওয়া-দাওয়া আরো কম যেতে থাকল। করোনা সংকটের মধ্যে বাবার চিকিৎসা করাতে পারলাম না।
বাবার পাসপোর্ট হাতে পেয়েছিলাম। আমার পাসপোর্ট কি কারণে যেন আটকে গেল!
বাবা আফসোস করে বললেন, আমার বুঝি আর চিকিৎসা করা হবে না।
ঠিক তাই হলো। গত মে মাসের চৌদ্দ তারিখ বাবা না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
শুয়ে আছেন তাঁর চাকরিস্থল আছিয়া চা-বাগানের কবরে। চা-বাগানকে খুব ভালোবাসতেন বাবা।
ভালোবাসতেন সবুজ গাছপালা। কত ফলের গাছ লাগানো তাঁর হাতে। আর কতো মানুষ যে তাকে চেনে! অবাক হয়ে মানুষের কাছে শুধু বাবার গল্প শুনি। বাবার এত গল্প! কিন্তু কিছুই শুনিনি আমরা। এখন মানুষের কাছে আমরা বাবার কথা শুনি।
আমাদের অনেক বেদনা আর হতাশার সাগরে ডুবিয়ে বাবা চলে গেলন। মনে খুব ব্যথা লাগে, বাবার চিকিৎসা করাতে পারলাম না। বাবার কথা মনে হলেই বুকটা ভার হয়ে থাকে। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। চোখে অবিরল ধারায় জল উপচে ওঠে।
মনে মনে বলি, বাবা গো তুমি ভালো থেকো। যদি আকাশের তারা হয়ে সব দেখতে পাও, তবে ওই তারার দেশে, ভালো থেকো বাবা। বাবা, একটা কথা তোমাকে কোনোদিনও বলতে পারিনি। আজকে তারাদের তুমি এ কথাটি জানিয়ে দিও।
বাবা, তোমাকে খুব খুব ভালোবাসি।
ফেসবুক থেকে