পীর হাবিবুর রহমান : যাদের কলিজা পুড়বে, গায়ের চামড়া ঝলসে যাবে তারা কখনোই এই স্ট্যাটাসে কমেন্ট করবেন না প্লিজ। ধর্মের আবেগ অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে কোরআনের তাফসিরের নামে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওয়াজ মাহফিল করে বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিলেন। সেই জনপ্রিয়তা অর্জনের নেপথ্য আয়োজনে শক্তি ছিলো মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী। ধর্মপ্রাণ মানুষেরা তখন তার বাগ্মিতায় মুগ্ধই নন, ভক্ত। যখন আদর্শিক ছাত্র রাজনীতির তারুণ্যের শক্তি তাকে রুখতে চেয়েছে, তখন অনেক দেরি। সাঈদীও পরে জামায়াতের নেতা হিসেবে আবির্ভূত। বিদেশেও ওয়াজে ওয়াজে ধর্মের নামে আল্লাহ রাসূলের (সা.) নামে মানুষের কোমল মনকে টেনে হাজার হাজার ডলার তোলেন, জামায়াতের দর্শন প্রচারে সফল হন। সেই সাঈদীকে নিয়ে যারা ওয়াজের আয়োজন দেশে-বিদেশে করতেন তারা সবাই জামায়াত মূর্তি নিয়ে আবির্ভূত হন। জামায়াত শক্তিশালী হয়। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির রায় হতেই কী ভয়াবহ আন্দোলনে নামে তার সমর্থকরা। গ্রামের নারীরা শিশুদের মানববর্ম করে বেরিয়ে আসে।
চাঁদে দেখা গেছে তার মুখ, এমন গুজবে ভাসে সরল মানুষ। পরেরটা সবার জানা। সাঈদী এখন আজীবন কারাদ-ে দ-িত। জামায়াত সংঘাতে শক্তিক্ষয়ের পথ এড়িয়ে নীরবে সংগঠনকে এগিয়ে নিচ্ছে অনেকদূর। দেশে আদর্শিক রাজনীতির মরুকাল চলছে। আদর্শিক তারুণ্য নির্ভর ছাত্র রাজনীতির যৌবন সেই কবে মরে গেছে। এর মধ্যে গ্রাম-গঞ্জে চলছে ওয়াজ। ধর্মের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার নামে একদল বক্তা ভাঁড়ের আচরণ করছেন। নাচছেন। ইউটিউভ খুললেই তাদের আসর। মিলিয়ন শ্রোতা দর্শক। কেউ গান গায় জেমস, আইয়ুব বাচ্চুর সুরে, কেউ গায় হিন্দি ও লোকগানের সুরে। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে কাদাছোড়াছুড়ি করে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ায়। বিদ্বেষও ছড়ায়। পহেলা বৈশাখে মুসলমানের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরাকেও হারাম বলে। কয়েকদিন আগে আমি এক ফ্যাশনেবল স্মার্ট ইংরেজি, বাংলা, আরবিতে ওয়াজ নসিহত করা বক্তা মিজানুর রহমান আজহারীর কথা লিখে কৌতূহল প্রকাশ করেছিলাম, তিনি কি জামায়াতের নতুন সৃষ্টি? যেভাবে সাঈদীকে নামিয়েছিলো জামায়াত সেভাবেই নামিয়েছে? যার ওয়াজে লাখো মানুষের ঢল নামে। শ্রোতাদের বাগ্মিতায় মুগ্ধ করে দেন। মিসরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আল আজহার থেকে পড়াশোনা করায় নামে আজহারী যুক্ত। অনেক টাকাও পান ওয়াজে গিয়ে। স্ট্যাটাসে কৌতূহল দেখাতে গিয়ে দেশ-বিদেশের সাইবার কর্মীদের চরম আক্রমণের মুখে পড়ি। মুছে ফেলি। গত ক’দিন আবার ইউটিউব দেখে আজহারীকে ভীষণ চতুর ও কৌশলী উত্তেজক বক্তা মনে হয়। জামায়াতের দর্শনই প্রচার করেননি, সাঈদীকে সিংহ ও তাদের সিংহ সন্তান দাবি করেন। ঘরে ঘরে সাঈদী চান। অনেক সুন্দর বাণীর মধ্যে অন্য ধর্মকে আঘাতই করেন না, চরম বিদ্বেষ ছড়ান। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও ক্রিকেটের কথাও বলেন, আবার নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন। সাঈদীর কারাজীবন নিয়েও কথা বলে উত্তেজিত করেন। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যোগদানের দাবিও করেন। আর তার ওয়াজে যান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের এমপি-নেতা।
মিজানের গুরুর গুরু সাঈদীর আরেক শিষ্য হলেন তারেক মনোয়ার। দু’জনে জড়িয়ে আবেগে কাঁদেন। তারেক দাবি করেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেয়েও যাননি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় নাকি তাকে তিনবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ঘোষণা করেছে, তিনি তার পরিবারকেও বলেননি। সব ধর্মের স্বাধীনতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে। ধর্ম পালনের, প্রচারের স্বাধীনতার নামে বিদ্বেষ, অন্য ধর্মকে আক্রমণ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী বক্তব্য, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের পক্ষে কথা বলার দুঃসাহস দেয়নি। বর্ণচোরা সুবিধাবাদী আদর্শহীন সমাজে এসব ওয়াজে আওয়ামী লীগ নেতা-এমপিরা যান কীভাবে? দল সরকার কি তাদের তৎপরতা বক্তব্য দেখে না? কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই? রাজনৈতিকভাবে আদর্শিক জায়গায় ও সংবিধান আইনের আলোকে নিয়ন্ত্রণ হবে না? আমিও মুসলমান।
আমিও ধর্মপ্রাণ আল্লাহভীরু মুসলিম পরিবারের সন্তান। আলেমদের প্রতি পারিবারিকভাবেই সম্মানবোধ রয়েছে। কিন্তু ধর্ম, ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে, রাজনৈতিক জীবনে নয়। কোনো ধর্মই রাজনীতিতে অশান্তি ও হিংস্রতার আগুন ছাড়া কিছু দিতে পারেনি। একাত্তরে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্মের মানুষ যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে। সেদিন ইসলামের নামে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হয়ে নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে লড়েছে। মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ করেছে। এই অভিশপ্ত ধর্মান্ধ রাজনীতি আর নয়। কারও ধর্মের আবেগ অনুভূতিতেও আঘাত নয়। এটাও বিকৃতিই নয়, সমাজে অশান্তির আগুন জ্বালায়। এভাবে চললে একদিন ভয়ংকর মাশুল গুনতে হবে। আমার এ স্ট্যাটাসে যাদের কলিজা পুড়বে, গায়ের চামড়া ঝলসে যাবে তারা এটি পড়বেন না, কমেন্ট করতেও আসবেন না। ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :