আশিক রহমান : দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ধর্ষণ। নৃশংসতাও বাড়ছে সমানতালে। আইনজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিদদের মতে, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল, ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ও তাদের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। তাদের হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছর প্রতি মাসে গড়ে একশজনেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঘটনা ঘটেছে ৬৩০টি। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ জন নারীকে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসেবে ঘটনার মাত্রা আরও ভয়াবহ। প্রতিদিন গড়ে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ১১টি। ২০১৮ সালে পুরা বছরজুড়ে এক হাজার ২৫১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেব বলছে, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে মোট ধর্ষণ মামলা হয়েছে ২০ হাজার ৮৩৫টি।
ধর্ষকদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, নারী নির্যাতকদের শাস্তির জন্য প্রচলিত যে আইন রয়েছে তা আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এতে ধর্ষণের মতো বীভৎস কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত হওয়ার চেষ্টা করে তারা হয়তো নিবৃত্ত হতে পারে। কিন্তু সামাজিক প্রতিরোধটাই সবেচেয়ে আগে করা দরকার। আমাদের আইন আছে, কিন্তু তা যদি আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজন হয়, নিশ্চয়ই সরকার বিবেচনা করতে পারে। তিনি আরও বলেন, যেভাবে দেশে নারী-শিশু ধর্ষণ-নির্যাতন শুরু হয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রচলিত আইনকে আরও শক্তিশালী করা উচিত, যাতে নির্যাতনকারী সাহস না পায় এ ধরনের বীভৎস ঘটনা ঘটাতে। নারী-শিশু নির্যাতনের বিচারের যে সময় এখন আইনে লেখা আছে তা কমিয়ে আনা দরকার। সেক্ষেত্রে সরকার যদি প্রয়োজন মনে করেন, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেও নির্যাতকদের দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, নারী-শিশু নির্যাতনকারী, ধর্ষকদের যদি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা না হয়, তা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্সুয়াল এডুকেশন নিয়ে আমরা স্কুল-কলেজে কথা বলি না। যৌনকর্মীদের আমরা চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছি। যাদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা আছে, মানসিক বৈকল্য রয়েছে তা থেকে সুস্থতার জন্য আমরা চিকিৎসা করি না। আমরা মনোবিদদের কাছে যাই না। সেক্সকে আমরা মনে করি একটা ট্যাবু। মাদকের যথেচ্ছ ব্যবহার- আমাদের ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যেভাবে ধর্ষণ বাড়ছে, শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। সমাজে মানুষে মানুষে অবিশ্বাস বাড়ছে। শহরে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা চলছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও বীভৎসতার শিকার হচ্ছে। এ নিয়ে আমরা হতাশ। দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। তবে হতাশ হয়ে বসে থাকলে চলবে না। ধর্ষণ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা করতেই হবে। অপরাধীর বিচার আমাদের করতেই হবে। আমরা এখানে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা প্রায় বন্ধ করতে পেরেছি বলা যায়। একই পদ্ধতি ধর্ষণ প্রতিরোধেও ব্যবহার করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ থাকবে, নারী-শিশু নির্যাতন বা ধর্ষণ প্রতিরোধে হার্ডলাইনে যেতে হবে সরকারকে। কঠোর থেকে কঠোর হতে হবে, ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই ধর্ষকদের। পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজটিও আমাদের জোরালোভাবে করতে হবে।
মনোবিদ অধ্যাপক ডা. মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ধর্ষণের বীভৎস রূপ এখন আমরা দেখছি। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব আর অবশিষ্ট থাকছে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যেভাবে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে, ঘটছে প্রতিনিয়তই, তাতে পরিষ্কার যে, মানুষের মধ্যে পশু-প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে উঠছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে অবাধ, লুটপাটের লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে সহজে। ফলে মানুষের মানবিকতা হারাচ্ছে। অমানবিক মানুষেরাই সমাজে পুরস্কৃত হচ্ছে। কিন্তু মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ অবমূল্যায়িত হচ্ছে। ভালো কাজের স্বীকৃতি পাচ্ছেন না তারা। যে কারণে সমাজে বিকৃত রুচির মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিকৃত মানসিকতার মানুষ থেকে সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সন্তানদের গৌরব বা মর্যাদাপূর্ণ কাজে উৎসাহিত করা।
তিনি আরও বলেন, বিবেক জাগ্রত করতে হবে আমাদের। সেটা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসঙ্গে করতে হবে। বিকৃত রুচির নারী-শিশু নির্যাতনকারীদের দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টান্তমূলক বিচারের চেয়ে তাৎক্ষণিক বিচারের দিকে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। এই তাৎক্ষণিক বিচার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার করতে পারে, সমাজ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও করতে পারে। অর্থাৎ যখনই এ ধরনের বীভৎস ঘটনা ঘটবে তখনই অপরাধীর বিচার করতে হবে, যাতে অন্যরাও সতর্ক হয়। কোনোভাবেই অপকর্ম করার সুযোগ, পরিবেশ-পরিস্থিতি যেন না পায় ধর্ষকেরা। সুস্থ ও মানবিক মানুষদের এ বিষয়ে সবসময় অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে হবে। নারী-শিশু নির্যাতনকারী ধর্ষকদের প্রয়োজন অনুসারে মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠানো যেতে পারে। মনোবৈকল্য অত্যন্ত খারাপ জিনিস। একজনের মনোবৈকল্যের শিকার অন্যজন ভোগ করতে পারে না। রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে।