রমজান আলী : বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অন্যতম হিসেবে পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির সাথে অনেক বেশি সম্পৃক্ত। ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থ, বাণিজ্য ও রাজনীতিতে সংঘটিত নানা পরিবর্তন আমাদের জন্য বিভিন্ন আশংকার পাশাপাশি সম্ভাবনার সুযোগও তৈরি করছে।
সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে ‘ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০১৮’ এর মোড়ক উম্মোচনে প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক শ্লথ প্রবৃদ্ধির হার ও নানামুখী ঝুঁকি সত্ত্বেও নিম্নমুখী মুদ্রাস্ফীতি, রেমিটেন্স ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি এবং আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রবৃদ্ধি সহায়ক নীতিমালার পাশাপাশি শক্তিশালী রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল রয়েছে। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতের মূলধন পর্যাপ্ততা ও তারল্য ন্যূনতম আবশ্যকীয় হারের চেয়ে বেশী ছিল।
তিনি বলেন, দেশের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে ঋণ ও আমানতের সুদের হার এক অংকে নামিয়ে আনার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া ইলেকট্রনিক পেমেন্ট ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধির ফলে সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকি বিষয়ে সকলকে সচেতন থাকার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানান।
তিনি বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি সার্বিকভাবে স্থিতিশীল ছিল। প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭.৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে যা পূর্ববর্তী অর্থবছরে ৭.৩ শতাংশ ছিল। ২০১৮ সাল সমাপনান্তে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৫ শতাংশ এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের স্থিতি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় কিছুটা কমে ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য অর্থবছরে রপ্তানি বাণিজ্য এবং ওয়েজ আর্নার’স রেমিটেন্স যথাক্রমে ৬.৪ ও ১৭.৩ শতাংশ বাড়লেও আমদানি বানিজ্য ২৫.২ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় চলতি হিসেবের ঘাটতি ৯.৮ বিলিয়ন ডলারে (যা জিডিপি’র ৩.৬ শতাংশ) দাঁড়িয়েছে। চলতি হিসেবের ঘাটতি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সামগ্রিক ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঋনাতœক প্রবণতা দেখা দেয়।
ব্যাংকিং খাতের কর্মদক্ষতা : ২০১৮ সালের সমাপনান্তে ব্যাংকিং খাতের সম্পদ ১১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ঋণ ও আগাম ১৪.১ শতাংশ এবং আমানত ১০.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মোট আমানতের মধ্যে মেয়াদী আমানতের পরিমাণ অর্ধেকেরও বেশী যা ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক অর্থায়নে স্থিতিশীল উৎস হিসেবে ভ‚মিকা রেখেছে। ২০১৮ সালে ব্যাংকিং খাতে মূলধন ও ঝুঁকি-ভিত্তিক সম্পদের অনুপাত কিছুটা কমে ১০.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে যা আবশ্যকীয় ন্যূনতম হার (১০ শতাংশ) অপেক্ষা বেশী। ব্যাসেল-৩ মূলধন কাঠামোর আওতায় ঈধঢ়রঃধষ ঈড়হংবৎাধঃরড়হ ইঁভভবৎ (ঈঈই) এর নির্ধারিত মাত্রা শতকরা ১.৮৭৫ এর বিপরীতে ব্যাংকিং খাত ০.৫০ শতাংশ সংরক্ষণ করেছে। এছাড়া, ব্যাংকিং খাতে খবাবৎধমব ৎধঃরড় ৪.১ শতাংশ ছিল, যা আবশ্যকীয় মাত্রা ৩ শতাংশের তুলনায় বেশী।
তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের নিট মুনাফা ৫৭.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সম্পদের বিপরীতে আয় হার (ROA) ৪০ বেসিস পয়েন্ট কমে ০.৩ শতাংশে এবং মূলধনের বিপরীতে আয়-হার (ROE) ৬০০ বেসিস পয়েন্ট কমে ৪.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতের তারল্য পরিস্থিতি ২০১৮ সালে তুলনামূলক চাপের মুখে ছিল। বছর শেষে আগাম আমানত অনুপাত (Advance-to-Deposit Ratio, ADR) বেড়ে ৭৭.৬ শতাংশে উন্নীত হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরি পলিসিতে নির্ধারিত সীমার মধ্যেই ছিল। এই সময়ে কলমানি হারে মিশ্র প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় যা ডিসেম্বর ২০১৮ তে দাঁড়ায় ৪.১ শতাংশ। ব্যাংকিং খাতে ব্যাসেল-৩ তারল্য নির্দেশক Liquidity Coverage Ratio (LCR) এবং Net Stable Funding Ratio (NSFR) এর আবশ্যকীয় হার ১০০ শতাংশ অপেক্ষা বেশী ছিল। আলোচ্য বছরে আমানত বীমা ট্রাস্ট তহবিল (Deposit Insurance Trust Fund, DITF) ৭৪.৩ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত হয়, যা ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট বীমাযোগ্য আমানতের ২৩ শতাংশ এবং এর দ্বারা ৯২.১ শতাংশ আমানতকারীর আমানত দায় (সর্বোচ্চ ১,০০,০০০ টাকা) পরিশোধ করা সম্ভব।
ব্যাংকিং খাতে ২০১৮ সালে মোট শ্রেণীকৃত ঋণের (Gross Non-Performing Loan) হার ছিল ১০.৩ শতাংশ এবং নীট শ্রেণীকৃত ঋণের (রক্ষিত প্রভিশন সমন্বয়ের পর) হার ২.২ শতাংশ ছিল। বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট শ্রেণীকৃত ঋণের হার ৬০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে ৫.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি সহনীয় মাত্রায় ছিল। সার্বিক ঝুঁকি পরিমাপক নির্দেশক, জরংশ-ডবরমযঃবফ অংংবঃ উবহংরঃু জধঃরড়, সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকিং খাতের মোট ঝুঁকি ভিত্তিক সম্পদের মধ্যে ঋণ ঝুঁকির পরিমাণ ছিল ৮৮ শতাংশ। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহের পৎবফরঃ ৎধঃরহম অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থিতিশীল ছিল এবং ব্যাংকিং খাতে সুদের হার, মুদ্রা বিনিময় হার, ইকুইটি মূল্য এবং তারল্যের উপর ংঃৎবংং ঃবংঃ এর অভিঘাত সহনক্ষম ছিল।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রধান নির্বাহীগণ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট এন্ড রেগুলেটরি অথরিটি ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি এর প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।