চিররঞ্জন সরকার : সবকিছু পাল্টাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে সময়, পাল্টাচ্ছে রুচি-পছন্দ, পাল্টাচ্ছে জীবনযাত্রার ধরন ও মান, পাল্টে যাচ্ছে চাওয়া-পাওয়ার নিয়ম। আমি, আপনি, সবাই কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছি সময়ের তালে তাল মিলিয়ে। কারণ পাল্টে যাওয়াই নিয়ম। পাল্টানোর হাত ধরেই আসে বিবর্তন, ঘটে আর্থ-সামাজিক বিকাশ ও উন্নয়ন।
যার লক্ষ্যে সারা পৃথিবী উত্তাল, সেই ‘আরও একটু ভালো থাকা’র জন্য প্রতিনিয়ত পাল্টাতে হয় নিজেদের, মানিয়ে নিতে হয় পাল্টে যাওয়া পরিবেশ-সংস্কৃতি-মূল্যবোধের সঙ্গে। এটাই স্বাভাবিক, চিরন্তন। এভাবে চলতে চলতে মানুষ যে কবে তার নিজের আবিষ্কার করা যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছে সে খেয়াল করার সময় আমরা হাতে পাইনি। পাল্টানোর হাত ধরে খুঁজতে চেয়েছি সুখ, আরও সুখ। ভেবে দেখার চেষ্টা করিনি যে ‘এরা সুখের লাগি চাহে’ কী? সুখ আনতে গিয়ে দুঃখের ভরা জোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি কাউকে?
এ কথা অনস্বীকার্য যে সুখ আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সর্বদা হাত ধরাধরি করে চলে। একটু আগে-পরে। উন্নয়ন না হলে সুখ কল্পনামাত্র। তাই উন্নয়নের পিছু পিছু আসে সুখ বা আপাত সুখ। অর্থনীতির সনাতনী ভাবনায় উন্নয়ন আসে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির সাহায্যে। তাই শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো আবশ্যক। আর এ কাজে যন্ত্রের বিকল্প মেলা ভার। যতো বেশি উৎপাদন, ততো কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি, তার সঙ্গে বাড়তে থাকা ভোগের পরিমাণ। এতেই নাকি তরতরিয়ে চলতে থাকে উন্নয়নের রথ। উন্নয়নের এ ধরনের সংজ্ঞা যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয় তা বলাবাহুল্য। তবে সে প্রসঙ্গ আজ থাক। বরং ফিরে যাই মূল প্রতিপাদ্যে। যা বলছিলাম, যন্ত্র যখন উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ কমতে থাকে। একসময় প্রযুক্তি শ্রমের বিকল্প হয়ে উৎপাদনের পরিমাণের বিরাট সম্প্রসারণ ঘটায়। কিন্তু অনিবার্যভাবে কর্মহীন হয়ে পড়ে কিছু শ্রমিক। তাই এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, প্রযুক্তির হাত ধরে আসা উন্নয়নের ফলে চাকরিতে বহাল থাকা মানুষদের সুখ নিশ্চিত হয় বটে, কিন্তু মহাফাঁপরে পড়ে চাকরি খোয়ানো মানুষজন। দুঃখ তাদের সঙ্গী হয় পাল্টে যাওয়া আর্থ-সামাজিক চালচিত্র। সুখ তো আপনা থেকেই এলো, এলো দুঃখও। সুখে থাকা মানুষজন অবশ্যই আহ্লাদিত। কিন্তু দুঃখে থাকা গরিব-দুঃখী পরিবার? তাদের দায় রাষ্ট্রের, তাদেরও সুখের দিনে ফেরানোর কর্তব্য সরকারের। সেটাই তো অন্তর্ভুক্ত উন্নয়ন। তার মানে পাল্টে যাওয়া যুগে উন্নয়নের সঙ্গে কিছু উৎখাত ও স্থানচ্যুতি হবেই এবং অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে সৃষ্টি হবে সুখী ও দুঃখীদের মধ্যে দ্ব›দ্ব। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে সে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা হবে। এটাই হয়ে আসছে এবং এটাই সংবেদনশীল পদ্ধতি।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে স্থানচ্যুতি ও উৎখাতের সম্পর্ক চিরকালীন। লক্ষণীয় যে, উৎখাত হয় শুধু শ্রমিকের। কারণ শ্রমিকের চলনশীলতা। জমি তো উৎখাত করা সম্ভব নয়, তাই তার স্থানচ্যুতি ঘটে না। শুধু ব্যবহারের পরিবর্তন হয় মাত্র। শ্রমিকের এ উৎখাত ঘটায় মূলধন। তাতে লাভ করে মূলধন, ক্ষতি হয় শ্রমিকের। তবে সব শ্রমিকের হয় না। উল্লেখ্য যে, স্থানচ্যুতি প্রধানত দুই ধরনের। একটি ভৌগোলিক এবং অপরটি পেশাগত। ভৌগোলিক উৎখাত আমরা সহজেই বুঝি। জমির মালিক, শ্রমিকরা জমি বিক্রি করে অন্যত্র গমন করেন। তুলনায় বেশি শিক্ষিতরা নতুন কলকারখানায় কাজ পেয়ে যান। অন্যরা নতুন কাজের আশায় পরিযায়ী পাখির মতো দেশে-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় আস্তানা গাড়েন। অপরদিকে পেশাগত উৎখাত একটু ভিন্ন ধারণা। নতুন শিল্পে যারা কাজ পেলো না, তারা হয়তো শিল্পের চাহিদামতো কাজ করার যোগ্যতা ও দক্ষতাহীন। তাদের যদি ভৌগোলিকভাবে স্থানচ্যুত না হয়ে থাকতে হয়, তাহলে পেশাগত পরিবর্তন ছাড়া উপায় নেই। যেমন শিল্পে কাজ না পেয়ে, চায়ের দোকান দেয়া, প্যাকেট খাবার বিক্রি, অটো চালানো, লন্ড্রিতে জামা-কাপড় ইস্ত্রি করা, আরও কতো কী। কিন্তু ভুললে চলবে না পেশাগতভাবে উৎখাত হয়ে নতুন কাজ করা কিন্তু মুখের কথা নয়। লাগে মূলধন এবং অল্প হলেও সেই পেশার খুঁটিনাটি সম্পর্কে অল্পবিস্তর ধারণা।
আপনাদের অনেকের হয়তো মনে থাকবে যে, একসময় পাড়ার মোড়ে বা বাজারে রেডিও সারানোর দোকান ছিলো। রেডিও শোনার দিন তো কবে গেছে। উঠে গেছে দোকানগুলোও। একটু স্মৃতি হাতড়ে দেখুন, সেই দোকানগুলোতে তারপর টেলিফোন বুথ চালু হয়েছিলো। তাও আর নেই। এরপর হলো মোবাইল বিক্রি ও রিচার্জের দোকান। সঙ্গে কিছু দোকানে চালু হলো কম্পিউটার সারানো এবং প্রিন্ট করা। অনলাইনে মোবাইল বিক্রি চালু হওয়ার পর সেসব দোকানে আজকাল কী হয়েছে খেয়াল করেছেন? হয় দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ, নয়তো কোনো সিন্ডিকেট বা ড্রাইভারস সেন্টারের অফিস বা ছোটখাটো ফাস্টফুডের দোকান। আর যারা এসবের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি, তারা অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট বা বিগবাস্কেটের মালপত্র বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার কাজ করে। লক্ষণীয় যে, পেশাগত স্থানচ্যুতির বদৌলতে ঘটে যাওয়া এসব পরিবর্তন হয়েছে মাত্র বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যে। ভাবুন তো, একজন মানুষের পক্ষে কী পাল্টে যাওয়া চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে এতো তাড়াতাড়ি পেশাগত দক্ষতার এতো পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব? অবশ্যই দুরূহ। তবু করতে হয়েছে পেটের দায়ে। উন্নয়নের সঙ্গে বেঁচে থাকতে হবে যে!
এই প্রসঙ্গেই নজর ফেরানো যাক সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচির দিকে যেগুলো একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ¯েøাগান নিয়ে ক্ষমতাসীনরা সরকার চালাচ্ছে। কিন্তু সরকারিভাবে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা খুব কম। পরিসংখ্যান সে কথাই বলে। গত কয়েক বছরে বেকারত্বের পরিমাণ বেড়েছে। এখনো প্রায় দুই-আড়াই কোটির মতো যুবক কাজ করতে চেয়েও সুযোগ পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় একমাত্র রাস্তা হলো নতুন নতুন ছোটখাটো ব্যবসা। সরকার তাদের ঋণ দিয়ে সাধ্যমতো সাহায্য করবে। সেসব উদ্যোগে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এতে যদি কিছুটা সুরাহা হয় বেকার সমস্যার। সেইসঙ্গে সরকারি-বেসরকারি যাবতীয় লেনদেনের ব্যাপারে স্বচ্ছতা রাখতে প্রতিটি হিসাব ও বিলি-বণ্টনের খতিয়ান রাখতে হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। এতেও আরও কিছু কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়। সে ব্যাপারে আগেই খানিক আলোচনা করেছি। এবার বুঝতে চেষ্টা করবো যে, একই সমস্যা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বজায় থাকে না লাঘব হয়।
বলাবাহুল্য যে, আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার শ্লোগানে দেশ ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে পরিবর্তিত হবে না। সেটাই স্বাভাবিক। বেশিরভাগ ডিজিটাল ব্যবসা সময়ের সঙ্গে চরিত্র পাল্টাবে। পাল্টে যাবে উৎপাদনের কাঠামো এবং উৎপন্নের ধরন-ধারণ। কিছু ডিজিটাল বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবেই নির্মাণ-বিনির্মাণের পথ ধরে এগিয়ে চলবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যাত্রা। মুশকিল হলো ডিজিটাইজেশনের কারণে উৎপাদনের চরিত্রবদল হবে। ফলে বদল ঘটবে শ্রমের চাহিদার। যে শ্রমিক যে দক্ষতার কারণে কাল কাজ করতেন, আজ তার দরকার ফুরোতে পারে। আর যেখানে বাজার অর্থনীতি শ্রমিকের প্রয়োজন নির্ধারণ করবে, সেখানে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি কর্মহীনতা। সরকারি ক্ষেত্রের বেলায় তেমন ঘটার সম্ভাবনা কম। কারণ সরকারি নিয়মকানুন দিয়ে শ্রমিক স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু বাজার সেসবের তোয়াক্কা করে না। প্রয়োজন ফুরোলে সেখানে ঘাড় ধাক্কা দেয়াই নিয়ম। অর্থাৎ যেটা বলতে চাইছি সেটা হলো, আজ যিনি যন্ত্রপ্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে কম্পিউটার টেকনিশিয়ান হলেন, দুই বছর বাদে তাকে প্রয়োজনের তাগিদে ফলের রস বানানোর প্রশিক্ষণ নিতে হতে পারে, আবার কিছুদিন বাদে শিখতে হতে পারে অ্যামাজনের প্যাকেজিং পদ্ধতি বা এসি সারানোর খুঁটিনাটি। এ কী সম্ভব? চরম অনিশ্চয়তার জীবন এমনিতেই দক্ষতা হ্রাস করে। তার সঙ্গে জুড়ে যায় অনিশ্চয়তার কারণে সৃষ্ট শ্রমিকের দরকষাকষির ক্ষমতার হিসাব। ফল হিসেবে পারিশ্রমিক বাড়া তো দূর অস্ত, কমেও যেতে পারে।
এ সমস্যা যে শুধু কম দক্ষ শ্রমিকের বেলায় প্রযোজ্য তা নয়। উচ্চ শিক্ষিত অধ্যাপক, আইনজীবী, ডাক্তার, সবাইকে মাঝে মধ্যে নতুন প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের আপ-টু-ডেট রাখতে হয়। নইলে বেকার হয়তো হতে হয় না, কিন্তু কোনো বিশেষ কাজে নিজের অপরিহার্যতা বজায় থাকে না। কিন্তু কম দক্ষ শ্রমিকের ক্ষেত্রে চাকরি খোয়ানোই একমাত্র পরিণাম। তাহলে উপায়? সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে নতুন সব উদ্যোগ। যাতে নির্দিষ্ট বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হওয়া শ্রমিক তার কাজের নিশ্চয়তা পান। পেশাগত স্থানচ্যুতির আশঙ্কা মাথায় নিয়ে কাজ না করতে হলে কিন্তু তাতেও উৎপাদনশীলতা খানিক বৃদ্ধি পায়। এতে দেশের ও দশের কল্যাণ। অর্থাৎ প্রয়োজনে ডিজিটাল সমাজ গড়ার কাজে আরও ভর্তুকি দিতে হতে পারে। তাতে আবার অন্য সমস্যা। ভর্তুকি পেতে থাকা প্রতিষ্ঠান ঐতিহাসিকভাবে দক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র তো আর অনন্তকাল ধরে ভর্তুকি দিয়ে যেতে পারে না। অন্তত সুস্থ, স্বাভাবিক অর্থনীতি এ ধরনের নীতি সমর্থন করে না। এর চেয়ে বরং ভালো ভর্তুকির সমপরিমাণ অর্থ সার্বজনীন আয় হস্তান্তর নীতির মাধ্যমে বণ্টন করা। তাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছি সরকারের আগামী কর্মসূচিগুলোর দিকে।
লেখক : কলামিস্ট