ড. এমদাদুল হক
আত্মোপলব্ধির যদি কোনো উপায় থাকে, তবে তা প্রেম। প্রেম কোনো মতবাদ বা অনুশাসন নয়। প্রেম হলো বাস্তব যোগ। কেবল প্রেমই দূর করতে পারে অহংয়ের দুর্ভেদ্য আবরণ। কেবল প্রেমই মনকে শুদ্ধ ও স্বচ্ছ করে আত্মোপলব্ধির জানালা উন্মুক্ত করতে পারে। কেবল প্রেমই হৃদয়কে অভাবনীয় সত্য গ্রহণ করার জন্য উন্মুক্ত করতে পারে। কেবল প্রেমই পারমার্থিক, যা পার্থিব হিসেবে উপস্থিত হয়। মানুষকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠার পথটি বাতলে দেয় প্রেম। অহং বিসর্জনের পথটি বাতলে দেয় প্রেমই। প্রেমের পাত্র দৈহিকভাবে নিজের মতোই আরেকজন মানুষ। যেহেতু তার সান্নিধ্যে হৃদয়ে প্রেমের সঞ্চার হয়, সেহেতু এই মানুষেই আছে সেই মানুষ। প্রেম হয়ে গেলে সে আর ব্যক্তি নয়, সে তখন নারী নয়- পুরুষও নয়- সে তখন প্রতিনিধিত্ব করে মহাকালের। তার দৃষ্টি থেকে তখন ছড়িয়ে পড়ে করুণা- জীবনের লালন-পালন। সে আকারে সামনে থাকে নিরাকারে বিরাজ করে মহাবিশ্বে। সে যখন হৃদয়ের অধিপতি হয়ে যায়- তখন কর্মবিধায়কও হয়ে যায়। সে তখন আর ব্যক্তি থাকে না- হয়ে উঠে জীবন চালনার নীতি। এই নীতির অনুসরণই যথার্থ ধর্ম। ব্যক্তি যখনই তাকে বিচার করতে থাকে তারই মতো রক্ত মাংসের একজন মানুষ হিসেবে, ধরা পড়ে অসংখ্য ত্রুটি- প্রেম তখন হয়ে যায় কাম, মহাকাল হয়ে যায় কাল। তাই প্রেমের সিঁড়িতে উঠার আগে মনকে শুদ্ধ করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে বোঝা যাবে যে এটি প্রেমের সিঁড়ি? কে বুঝে? বুঝে মন। তাই মনে যদি শুদ্ধতা না থাকে, কোমলতা, ন¤্রতা না থাকে, মনের যদি মননশীলতা না থাকে, তবে বোঝা যায় না। শোনা কথায় প্রভাবিত হলে প্রেম খোঁজাখুঁজি করে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া অনিবার্য। তাই প্রেমের উপলব্ধি আত্মোপলব্ধির সমান্তরাল। জগৎকে অনুবাদ করি আমি। আমি যদি প্রেমময় না হই, তবে জগতে প্রেমের উপলব্ধি অসম্ভব ব্যাপার। কোথায় থাকেন ঈশ্বর? ভেতরে। কার ভেতরে? আমার ভেতরে, সবার ভেতরে, সবকিছুর ভেতরে। আমের মিষ্টতা কোথায় থাকে? আমের ভেতরে। আমের আকার দেখা যায়- মিষ্টতা দেখা যায় না। আমের মিষ্টতা কী বাইরে নেই? আছে তো? কিন্তু বাইরে তাকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমের বাহ্যরূপ দেখে কে বলতে পারে এটি কেমন মিষ্টি! শ্রী রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরকে বললেন, ‘এঁটো হয়ে গেছ, বেদ-বেদান্ত সব এঁটো হয়ে গেছে’। অবাক হলেন বিদ্যাসাগর- ‘এঁটো হলো কীভাবে’? ‘মুখ দিয়ে বের হয়েছে না!’- তাই এঁটো। এঁটো হয়নি ব্রহ্ম। কারণ কেউ মুখ দিয়ে বলতে পারেনি ব্রহ্ম কী? আম এঁটো হয়। কিন্তু এঁটো হয় না আমের স্বাদ। এই স্বাদ যে গ্রহণ করে, তারই থেকে যায়। একেক আমের একেক স্বাদ। আমের স্বাদ সে-ই পায়, যে খায়। প্রেমের স্বাদ সে-ই পায়, যে প্রেম করে। স্বাদ এঁটো হয় না, কারণ কেউ তা বর্ণনা করতে পারে না। যার স্বাদ তাকেই নিতে হয়। শিনায় শিনায় স্বাদ সঞ্চারণের ব্যবস্থা আদিকালে হয়তো ছিলোÑএখন আর নেই। দেবদূতরাও আর আসে না প্রেমের চিঠি নিয়ে! চিঠির দিন শেষ হয়ে গেছে সেই কবে! পুরনো চিঠি পড়ে কান্নাকাটি করা অবসেশনÑস্নায়ুবিক রোগ। এই রোগ হলে রোগীর মাথায় অনাকাক্সিক্ষত ও পীড়াদায়ক চিন্তা আসে। ফলে রোগীর মনে অস্বস্তি, আশঙ্কা, ভয় ও বিষণœতা উৎপন্ন হয়। রোগী তখন উদ্ভট কিছু একটা করে বিষণœতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে। এ ধরনের কাজকে বলা হয় কম্পালসন। প্রেম অবসেশন নয়। দুঃখজনক যে, আধ্যাত্মিকতায় অবসেশনকেই এখন প্রেম বলা হচ্ছে। যার কম্পালসন হলো মৃতকে জীবিত মনে করা, তথাকথিত জীবিত ব্যক্তির কবরে সাত লাখ টাকার গিলাপ চড়ানো, কবরের চারদিকে ঘুরে হজ পালনের তৃপ্তি, মানবসেবার নিশান উড়িয়ে একশো ১টি গাড়ি নিয়ে কাফেলা যাত্রার অভিলাষ... ফেসবুক থেকে
আপনার মতামত লিখুন :